আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রমশঃ মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ধাবমান সমাজের কর্ণধারদের কি নিদারুণ আত্মসমর্পণ !!

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি

"মান্দার" নাটকটি নিয়ে রাবি প্রশাসন,সরকার,তথাকথিত সুধীজনের একশ' আশি ডিগ্রী ঘুরে যাওয়া এবং আমাদের 'বীরপুঙ্গব' লড়াকু সৈনিকদের অনায়াস মস্তিষ্ক অবনমন !! লালন ভাষ্কর্য ধ্বংসের পর ধর্মীয় গোষ্ঠীর আগ্রাসী থাবা এবার পড়েছে নাটকের ওপর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মান্দার’ নাটকটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওই নাটক প্রদর্শনের জন্য রাবির ধূমকেতু নাট্য সংসদকেও নিষিদ্ধ করেছে সেখানকার প্রশাসন। ইসলামের প্রিয় নবীকে ‘অবমাননার’ মিথ্যা অভিযোগকে পুঁজি করে ছাত্রশিবির ধর্মঘট ডেকে পরিস্থিতি তাঁতিয়ে তুলে নাটকটি এবং ধূমকেতু নাট্য সংসদকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি তোলে। অন্যদিকে আল ইহসান পত্রিকায় নাট্যকারকে ‘খতম’ করার ডাক দিয়ে ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়।

তাদের এসব আইনবিরুদ্ধ দাবি মেনে রাবি প্রশাসন গত ১৯ নভেম্বর একতরফাভাবে ধূমকেতু নাট্য সংসদকে নিষিদ্ধ এবং ‘মান্দার’ নাটকটির পরিবেশনা নিষিদ্ধ করে। এসবই হয়েছে মুক্ত সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ ইসলামী ছাত্রশিবির এবং উগ্র সংগঠন আল বাইয়্যিনাতের মুখপত্র দৈনিক আল ইহসান (রেজিষ্টার্ড নং : ডিএ ৩০২৮)-এর চাহিদামাফিক। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উগ্র ধর্মীয় মাফিয়া গোষ্ঠীর দোসরগিরি, অন্যদিকে প্রকাশ্যে একজন নাট্যকারকে হত্যার হুমকিদাতাদের আইনের আওতার বাইরে থেকে যাওয়ায় নাগরিক হিসেবে, শিল্পী হিসেবে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। ‘মান্দার’ একটি নিরীহ পরিবেশবাদী নাটক। নাটকের একটি চরিত্রের নাম "রসুল মিয়া" হওয়ায় এবং ওই নাটকের খলচরিত্রের তাকে গালি দেওয়া নিয়েই যাবতীয় আপত্তি।

বিমানবন্দরে ভাষ্কর্য অপসারণের বেলায়ও প্রশাসনের অতি আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এখন জিজ্ঞাস্য হলো, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কি তাহলে সভ্য দুনিয়ার রীতিনীতি ফেলে ধর্মীয় গোষ্ঠীর আনুগত্য করবে? বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাহিদার তোয়াক্কা না করে ক্ষুদ্র স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আঘাত করতে থাকবে? এভাবে পুরষ্কার ঘোষণা করে হত্যায় প্ররোচিত করার ক্রিমিনাল আচরণও প্রশাসন মেনে নেবে? এই বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে চীনাদের "চ্যাং" নামটা এদ্দিন পর্যন্ত বিশ্বে সবচে বেশি ব্যবহৃত নাম ছিল,কিন্তু সর্ব শেষ জরিপে দেখা যায় "মুহম্মদ" নামই হচ্ছে বর্তমানে সবচে' বেশি ব্যবহৃত নাম। এখন এই নামের যে হীন,নীচ ব্যক্তি তাদের অপকর্মগুলো করে বেড়াবে, তার দায় কি "মুহম্মদ"এর উপর পড়বে? নাকি পড়তে পারে? বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম মাফিয়া সন্ত্রাসীর নাম "দাউদ ইব্রাহিম"। দুই দুইজন পয়গম্বররে নাম নেয়ে এই চাঁদু গত কুড়ি বছর ধরে আকাম করে যাচ্ছ! এবং এই নামটিকে দিনে কোটি কোটি বার ধিক্কার দেওয়া হয়,গালাগালি দেওয়া হয়।

এরও দায় কি দাউদ নবী আর ইব্রাহিম নবীর উপর চালিয়ে দেওয়া যায়? যায় না। কিন্তু আমরা এমনই এক আইয়েমে জাহেলিয়াতের কাল সাপদের দুধকলা দিয়ে পুঁষছি যারা এই আধুনিক টেকনোলজি এন্ড ইনফরমেশনের যুগে দাঁড়িয়ে মানুষকে দাসযুগে ফিরিয়ে নিতে চাইছ। এবং বিস্ময়কর ভাবে চোখেমুখে 'প্রগতিশীলি,সেক্যুলার' তকমা লাগানো হিপোক্র্যাটদরে দল এই ষ্টেট এলিমন্টস,সুশীল,গণতন্ত্রী,মুক্তযুদ্ধের পক্ষের শক্তি গুলো 'দখা যাক কি হয়' নীতি নিয়ে বসে আছন! এই নাটকটি আসলে কি?সেটা বোধকরি এর বিরোধীতাকারীরা জানেনও না। সরকার, প্রশাসন, কর্তৃপক্ষের আস্কারা পেলে অতশত দেখা-জানার দরকারও করে না! তাদরে ইচ্ছা হয়ছে,ব্যাস। এটা কিসের আলামত?এটাকি সমগ্র বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর ড্রেস রিহার্সেল ?ওদের ব্যবহৃত চরণগুলো দখুনঃ "আল ইহসান পত্রিকায় ঘোষণা করা হয়েছে, "কাজেই দেরি নয়, এই নরপশু ইহুদি-নাসারাদের নরপিশাচ ধূমকেতু নাট্যপশু উদীচীর কুকুরছানাদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই কতল, হত্যা, মস্তক ছিন্নভিন্ন করার জন্য সকল মুসলমানকে একযোগে যার যেটা আছে তা হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে" (আল ইহসান, ১৯ নভেম্বর)।

পত্রিকাটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হজরত ইমাম সাইয়্যিদ মুহম্মদ দিল্লুর রহমানের (যার আরেক নাম মুর্দ্দা জিল্লুহুল আলী) উদ্ধৃতি দিয়ে চাররঙে যে ভাষ্য ছাপা হয়েছে সেটাও শিউরে ওঠার মতো। ধূমকেতু নাট্য সংসদ এবং ‘মান্দার’ নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ‘মুরতাদ’ ঘোষণা দিয়ে বলা হয় : ‘যে ব্যক্তি এই সকল মুরতাদকে কতল বা হত্যা করতে পারবে তাকে আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের পক্ষ থেকে উপযুক্ত পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হবে। " এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে একাধিক লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষককে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয়েছে। শারীরিক হামলার শিকার হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান ও হুমায়ুন আজাদের মতো ব্যক্তি।

হুমায়ুন আজাদের ‘রহস্যময়’ মৃত্যুও আমাদের দেখতে হয়েছে। বগুড়ার লোককবি মোসলেম উদ্দীনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশে এ রকম অজস্র ঘটনা সরবে-নীরবে ঘটে চলেছে। ফলে এসব উগ্রবাদী আজ ঠিক করছে, দেশে কী হবে আর কী হবে না। তাদের সামান্য অঙ্গুলি হেলনেই ভাষ্কর্য ধ্বংস হয়, নাটক ও গানের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হয়।

কিন্তু এক মাস ধরে সারাদেশের সংস্কৃতিকর্মীদের আন্দোলন চললেও সরকার ভাষ্কর্য বিষয়ের কোনো সুষ্ঠু মীমাংসা দূরে থাক, একটা ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। পুরো বিষয়টি ‘সাজানো নাটক’ বা ‘তামাশা’ মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ভাষ্কর্য কিংবা নাটক তাদের উপলক্ষ মাত্র। লক্ষ্য হলো মানুষের মতপ্রকাশ ও অধিকারের ওপর উগ্র ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন চাপিয়ে দেওয়া। আমাদের মনে হয়, দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করা তারই প্রস্তুতিপর্ব।

আজ তারা শিল্প ও শিল্পীকে আঘাত করছে, কাল হয়তো জনজীবন ও রাষ্ট্রের ভিতকেই কামড়ে ধরবে। শত শত বছর ধরে এই দেশে যত বিদ্রোহ,আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল,যত অনাচার অন্যায়ের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তার সবগুলোরই সূত্রপাত হয়েছিল সাংস্কৃতিক কর্মিদের দ্বারা। সেই সণ্ণ্যাস বিদ্রোহ থেকে শুরু করে একে একে তেভাগা হয়ে র্সবশেষ স্বাধীনতা সংগ্রামের গোঁড়াপত্তনও এই বাউলীয়া সম্প্রদায় বা সাংস্কৃতিক কর্মিদের হাত ধরে হয়েছিল। "তরাই কান্দেরে" গানটা দিয়েই গুরুদাস তালুকদার,হাজী দানেশ,রেবতী সাহা,অমল সেনরা সারা বাংলায় আধিয়ারদের তেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সত্তর দশকে সারা ভারত কাঁপানো কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাতও হয়েছিল সেই সময়কার গণনাট্য আন্দোলনের কর্মিদের দ্বারা।

এখন আমাদের বিবেক বলে পরচিতি শিক্ষিতজন,সুশীলজন,গণতন্ত্ররে ধ্বজাধারীরা,দেশপ্রমিক বিভিন্ন বাহিনীর 'দেশপ্রেমিক' রা, দুই বড় দলের মারাত্মক দেশপ্রেমিকরা, এবং ন্যায় নীতির পরাকাষ্ঠা "পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের" আল্ট্রা মর্ডাণ আমলারা যদি মনে করনে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র ! তাহলে সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন এই দেশে ওহাবি ডক্ট্রিনের তেকোণা ঝান্ডা উড়িয়ে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে মধ্যযুগীয় শ্বপদরা দাঁপিয়ে বেড়াবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.