আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর...

... ... ... ...

সত্যি বলতাছি, ব্যস্ততা আমাকে অবসর দেয় না। কিছু না করাতেই ব্যস্ত থাকি। তবু অবসরের আশায় থাকি। কিছু না করাটা আমার চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে মা-বাবার। " বিলগুলো দিয়ে আয়।

ব্যাংকে অনেক ভিড় হতে পারে, ঈদের আগে তাড়াতাড়ি দিয়ে আসলেই ভাল। " গেলাম ব্যাংকে। বিশাল লাইন। মেজাজ গেলো খিঁচড়ে। কাজের মধ্যে কাজ, কম্পিউটার নিয়ে রাত-দিন পড়ে থাকা।

কেন যে উঠতে গেলাম! ব্লগ পড়ি ব্লগ লেখি , এগুলা কি কোনো কাজের মধ্যে পড়ে না? আর মা-বাবা সুন্দর বলে দিলো সংসারের প্রতি কোনো দায়িত্বই নাই! কোনো কাজই নাকি করি না! কয়েকদিন ধরে কুঁইড়ার বাপ বলে ডাকাও শুরু করে দিছে। বললাম ," কুঁইড়া বলো, ভালো কথা। আমারে বলো। আমার পোলারে বলো কেন?" কোনো সদুত্তর নাই। বিশাল লাইনের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে মেজাজ খারাপ করে এইসব হাবিজাবি ভাবতেছি।

পিছনে এক মধ্যবয়স্ক লোক এলেন। কেন যে এলেন ! কমসে কম দুই ঘন্টা দাঁড়ায় থাকতে হবে, আর দুই মিনিটের মাথায় এই লোক পাগল করে ফেলবে! ঃভাই, আপনি কি লাইনের শেষে? ঃহুমম। (মনে মনে বলতাছি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেস ! দেখতেই ত পাইতাছস আমি লাইনের শেষে, ওইটা আবার জিগাইতেও হইবো?) ঃও...কতোক্ষণ হইছে আসছেন? ঃবেশিক্ষণ না(সকালে নাশতা না খাইয়া বাইর হইছি, বেটার কথায় মনে পড়ছে। এখন ছুঁচো না চিকা কে যেন পেটে বুক-ডন দেয়া শুরু করছে! ) আরো ভটর-ভটর কইরা কিসব যেন জিগাইলো...কয়জন কইরা ভিতরে ঢুকাইতাছে, কয়টা কাউন্টারে বিল নিতাছে, বাসা কই...এইসব। ফালতু প্যাচালে না যাইয়া কানে তুলা দিয়া হুম হুম কইরা সব কথা কাটায় যাইতে লাগলাম।

তুলা অবশ্য ছিল না, তাই মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম আজকে ব্লগে কি লেখমু...এই চিন্তায় ওই বেটার কথা না শুনার টেকনিক আর কি! লাইনে দাঁড়ানোর দুঃখের কথা আর কি কমু! প্রতিবার লাইনে দাঁড়াই আর মনে হয় যেন সারাটা জীবন ধইরা লাইনে দাঁড়ায় আছি...চিন্তা করতে থাকি কেমনে লাইন ভাংগা যায়। পিছনের ভটর-ভটর কথার ইঞ্জিন তখনো ফুল-স্পীডে চলতাছে। ইঞ্জিনের কিছু আওয়াজ আপনাদেরও শুনাই। ঃ দেখছেন নি, একজন একজন কইরা ভিতরে ঢুকাইতাছে। কতোক্ষণ লাগাইতাছে।

খায়-দায়, গল্প করে আর বিল নেয়। একটা কাগজে সই করে আর পান চিবায়। সবগুলা কাউন্টারে বসায় রাখছে মাইয়া মানুষ। সারাক্ষণ ফুসুর-ফাসুর ফুসুর-ফাসুর, এইগুলানরে ঘরে বসায় রাখা দরকার...... কিছু কথা কানে যাইতাছে আর আমার মেজাজ খারাপ হইতাছে। আমার মা-ও একজন ব্যাংকার, আমি জানি কি কষ্ট এই চাকরিটাতে।

ক্যাশিয়ারদের যে কতোবার নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে হিসাব মিলাতে হয় তা আমার ভালো জানা আছে। বাইরের মানুষ খুব কমই জানে... হিসাবের পর হিসাব, তার মধ্যে নাম্বার দিয়ে সিরিয়াল করা, দিন শেষে হিসাব মিললো কিনা...কোথাও কোনো ভুল হয়ে গেলো কিনা... ... ...আমি চুপচাপ শুধু শুইনাই গেলাম। কিছুই বললাম না। দুই ঘন্টা পরে ব্যাংকের ভিতরে ঢুকতে পারলাম। সেখানেও মোটামুটি সাইজের একটা লাইন দেখা যায়।

ততক্ষণে একটা বাজে। ব্যাংক আওয়ার শেষ। তবু বিল নেয়া চলতাছে। ব্যাংকের অন্য সেকশনের সবাই লাঞ্চ নিয়ে ব্যস্ত। কেউবা ব্যাংক ছেড়ে বাইরে খাইতে যাইতাছে।

ক্যাশের লোকগুলো শুধু ব্যস্ত... বিল নিতাছে। এর মধ্যে এক ক্যাশিয়ার মহিলা উঠলেন, সম্ভবত টয়লেটের দিকে গেলেন। আমার পিছনের ভটরভটর ইঞ্জিন আবার স্টার্ট দিল, "দুই মিনিট পরপর উইঠা যায়...কেন যে মাইয়ামানুষরে কামে বসায়!" আমিও যথারীতি চুপচাপ শুইনাই গেলাম। একসময় ভাগ্য সদয় হইলো..... আরেক কাউন্টারে আমাকে পাঠায় দিলো, ইঞ্জিনের আওয়াজ থেকে বাঁচলাম। লাইনে সবার সামনে এখন আমি।

লাইনটা তিনভাগে ভাগ করছে। পাশের কাউন্টারেই ভটরভটর ইঞ্জিন। ওইদিকে পাত্তা দিলাম না, নিজের কাউন্টারে বিল দিলাম , আমার বিল নিচ্ছেন একজন মাঝবয়সী মহিলা। কাউন্টারের গ্লাসের ওপাশে পিছনে দেখতে পারছি বিলিং সেকশনের যে হেড, তার সামনে এক ছোট্ট মেয়ে খাতা নিয়ে বসে কি যেন লিখছে। ব্যাংকের মধ্যে বাচ্চা কাউকে দেখলে আমার নিজের ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে।

আমিও এরকম বয়সে মায়ের অফিসে যেতাম বেড়াতে। হেড যিনি, তিনি বয়স্কা মহিলা। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মনে হলো নাতনী হবে। তখন হেড আমার বিল নিতে থাকা মহিলাটাকে বললেন,"আফরীন, তোমার মেয়ে তো সব পড়ে ফেলছে...A B C D অ আ ক খ সব লিখে ফেলছে। " বলে মেয়ের লেখা খাতাটা নিয়ে এলো।

বুঝলাম যে হেডের নাতনী না, আমার বিল যিনি নিচ্ছেন তাঁর মেয়ে। মেয়ের মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি গলায় বললো,"বাহ মামুনি, খুব সুন্দর হয়েছে। " আমি চুপচাপ দেখতে লাগলাম...বাচ্চা মেয়েটা পিছনের টেবিল ছেড়ে মার কাছে এলো। আস্তে আস্তে বললো,"মামণি, বাসায় যাবো। " বুঝতে পারলাম, ব্যাংকের এই ব্যস্ততায় মা মেয়েকে একটু সময়ও দিতে পারছে না, কথাও বলতে পারতাছে না।

মেয়েও ভীষণ আনইজি ফীল করছে। হয়তো বাসায় একা থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়েই বলেছিল মায়ের অফিসে আসবে...সে কি বুঝেছিলো এরকম হবে অফিস?! মা বললো,"আগেই তো বলছিলাম আসতে না...হুমম। এখন তোমাকে কে নিয়ে যাবে? একটু বসো। মা হাতের কাজটা শেষ করেই বাসায় যাবো। " মেয়ে মায়ের আঁচল ধরে গাইগুই করতাছে।

মা বলতাছে,"ওখানে যেয়ে খেলো। যাও ... কিচ্ছু হবে না। " কোথায় খেলবে এইটুক একটা মেয়ে? ক্যাশ কাউন্টারের ভিতরে কোনো জায়গা নাই, বাইরেও মানুষের বিশাল লাইন। মেয়ে মায়ের চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখভরা পানি...নিঃশব্দ।

মেয়ের মা আমার বিল সাইন করতাছে। আমার পাশের কাউন্টারেই ভটরভটর ইঞ্জিন দাঁড়ায় আছে। আমিই শুধু মেয়েটার চোখের পানিতে হারিয়ে যাচ্ছি... ... (বানায়-বুনায় কিছু লেখবো ভাবছিলাম, পারলাম না। আমি আবার বানাইতে খুব ভালো পারি। আজকে কি যে লেখলাম...মনটা খুব খারাপ )


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।