জাদুনগরের কড়চা
(প্রারম্ভ ) (পর্ব ১ )
(পর্ব ২)
শাটল বাসগুলোর যাত্রা শুরু হয় গ্রান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজ থেকে। মাইল খানেক পর পর একএকটি পয়েন্ট, যেখানে বাস থামে, আর বিভিন্ন দিক থেকে ক্যানিয়নের সৌন্দর্যকে উপভোগ করা যায়। সেই বাসে চেপে আমি আর জারিয়া রওনা হলাম, গ্রীষ্ম কাল বলে পর্যটকদের ভীড় খুব বেশি, নানা দেশের নানা জাতির লোক বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে চলেছে আসেপাশে।
সেই সকালে নাস্তা করেছি, বেলা সাড়ে বারোটার দিকে বেশ খিদে পেয়ে গেলো। দেশে হলে চা নাস্তার দোকান গিজগিজ করতো, কক্সবাজার সী বিচে বসে খাওয়া দাওয়ার কোনো সমস্যা দেখিনি।
কিন্তু মার্কিন প্রকৃতিপ্রেমিকেরা প্রকৃতির সৌন্দর্য নষ্ট করে দোকানপাট খোলার বিরোধী, তাই এখানে রেস্তোঁরার সমাগম নেই। তবে প্রায় ১০০ বছর আগে এখানে কয়েকটা হোটেল খোলা হয়েছিলো, সেই ঐতিহ্যবাহী হোটেলগুলো এখনো চালু আছে।
এখানে আসার আগে একবার ভেবেছিলাম ক্যানিয়নের ভেতরের হোটেলে থাকবো। কিন্তু সেগুলোর ওয়েবসাইটে গিয়ে তো চোখ চড়কগাছ ... একে তো ভাড়া আকাশছোঁয়া, তার উপরে এখানে থাকতে গেলে ৮-১০ মাস আগে থেকে বুকিং দেয়া লাগে! হোটেলগুলোর সামনে এসে বুঝলাম কারণটা কী ... ছিমছাম পুরানো দিনের স্থাপত্যে কাঠের তৈরী হোটেলগুলো ক্যানিয়নের ঠিক পাশে, হোটেলের বারান্দা থেকে মনোরম দৃশ্য দুচোখ ভরে উপভোগ করা যায়। কাজেই হোটেলগুলোতে প্রচন্ড ভীড় লেগে থাকে সারাবছরেই।
থাকতে নাহয় নাই বা পারলাম, হোটেলগুলোতে ঘুরতে আর খেতে তো সমস্যা নেই! তাই নেমে পড়লাম "এল টোভার" হোটেলের সামনে। পুরানো বনেদী হোটেল, পুরোটা ১৯০৫ সালে তৈরী, কালচে কাঠের কারুকাজ করা। ভেতরে আদিবাসীদের শিল্পকর্ম শোভা পাচ্ছে। একশো বছর আগে যেভাবে সাজানো, এখনো সেভাবেই রাখা আছে সবকিছু। রেস্তোঁরার মেনু অবশ্য যথারীতি গলাকাটা, তাই হালকার উপরেই দুপুরের খাবার সারতে হলো।
খাওয়ার জায়গাটার পাশের জানালা দিয়ে তাকালেই বোঝা যায়, এই হোটেলের জনপ্রিয়তার কারণ -- ক্যানিয়নের মাত্র ৬ মিটার দূরে হোটেলটা তৈরী হয়েছে।
হোটেলের সামনেই "হোপি হাউজ", হোপি আদিবাসীদের ঘরবাড়ির আদলে তৈরী। ভেতরে হোপি ইন্ডিয়ানদের তৈরী করা গয়না, পালকের মুকুট, পুতুল -- এসব কিছু বিক্রি হচ্ছে ছোট্ট একটা দোকানে। যা দাম, তাতে অবশ্য কেনার উপায় নেই কিছু।
বাইরে তখন রোদ বেশ চড়া।
শাটল বাস রওনা হলো হারমিট রোড (সন্ন্যাসী সড়ক) ধরে। চমৎকার এই রাস্তাটি নির্মিত হয়েছিলো ১৯৩৪-৩৫ সালের দিকে। প্রায় ৭ মাইল দীর্ঘ এই রাস্তায় মাইল খানেক পরে পরেই পর্যটকদের জন্য এক একটি পয়েন্ট বা পর্যবেক্ষণ স্থান রয়েছে। হোপি পয়েন্ট, মারিকোপা পয়েন্ট, মোহাভে পয়েন্ট এরকম করে বিভিন্ন নামের এই পয়েন্টগুলোর একেকটাতে একেক রকমের দৃশ্য দেখা যায়। আমরা দুএকটা বাদে সবগুলো পয়েন্টেই নামলাম।
কিন্তু চমক অপেক্ষা করছিলো হারমিট রোডের শেষ মাথায় ...ক্যানিয়নের একেবারে কিনারা ঘেঁষে তৈরী হয়েছে একটা টাওয়ার, পাথর দিয়ে তৈরী টাওয়ারটার নাম Hermit's Rest, তথা সন্ন্যাসীর আস্তানা। সাধাসিধে গড়নের টাওয়ার, জাঁকজমকের আতিশয্য নেই, দেখলে আসলেই মনে হয় কোনো সন্ন্যাসী ধ্যান করছে এর চুড়ায় বসে। পাশেই পাথরের দেয়াল, তার নিচেই ১ মাইল গভীর গিরিখাত।
ওখানে যখন পৌছালাম, সূর্য তখন অস্তগামী, বিকেলের সোনালী আলোর আভা আলোকিত করে তুলেছে পুরো গিরিখাতের লালচে কমলা পাথর-ভাষ্কর্যগুলোকে। অনেক নিচে, কালো সুতার মতো দেখা যাচ্ছে স্রোতস্বিনী কলোরাডো নদীকে, যার প্রবহমান জলরাশির আঘাতে পাথর ক্ষয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই প্রকৃতির বিষ্ময়ের।
পাথরে খোদিত এতো কিছুর মাঝেও রয়েছে প্রাণের ছোঁয়া। মাঝে মাঝেই ডানা মেলছিলো বিভিন্ন পাখি, ক্যানিয়নের মাঝের দেয়াল ঘেঁষে গজানো গাছে তাদের বাস। আর হারমিটস রেস্টে যখন দাঁড়ালাম, সামনে এসে পাথুরে দেয়ালে হাজির হলো এক কাঠবেড়ালী, জুলজুল চোখে তাকিয়ে রইলো আমাদের দিকে।
অবশেষে নেমে এলো সন্ধ্যা, নেমে এলো অন্ধকার। আক্ষরিক অর্থেই।
পুরো এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ধরে রাখার স্বার্থে এখানে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে -- রাস্তা ঘাটে তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই আঁধারের মাঝে হাতড়ে হাতড়ে গাড়ি খুঁজে বের করে ফের শুরু করলাম আমাদের মহাযাত্রা, গুগল থেকে ইলিনয়ের ভুট্টা ক্ষেতের পানে।
পেছনে পড়ে রইলো ইতিহাসের সাক্ষী গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, আর কলোরাডো নদীর চির প্রবহমান জলরাশি। আর প্রকৃতির অপার, অবাক বিষ্ময়।
(শেষ)
(নামাংকিত ছবিগুলো আমার তোলা, আর বাকিগুলো নেয়া হয়েছে পার্কের সাইট থেকে )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।