munirshamim@gmail.com
এক.
ধর্মীয় জঙ্গীবাদকে শ্রেণী সংগ্রাম হিসেবে দেখার মধ্যে হয়তো একটা বিদ্যাজাগতিক কৃতিত্ব আছে। কিন্তু এ ধরনের কৃতিত্ব প্রদর্শনের ফলাফলটা হয় ভয়াবহ। কারণ আলোচনা-বিতর্কটা শেষ পর্যন্ত শুধু বিদ্যাজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি সমাজেও সংক্রমিত হয়। এ সংক্রমণ প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কম তথ্য জানা মানুষের জন্য বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাগুলো বেশি তৈরি হয়।
অপরদিকে মৌলবাদ-জঙ্গীবাদের প্রচার মাধ্যমগুলো এ ধরনের তত্ত্বকে রেফারেন্স হিসেবে হরহামেশা ব্যবহার করতে থাকে। এ কারণেই সব সময় ব্যতিক্রম থাকার প্রচেষ্টারত বিদ্যাজাগতিক পীর-মুরশিদদের অবস্থান শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় জঙ্গীবাদ-মৌলবাদের পক্ষেই যায়। প্রগতিশীল চিন্তার ব্যানারে এ ধরনের ফতোয়া প্রকাশ্যে সক্রিয় মৌলবাদী-জঙ্গীবাদী থেকেও ভয়াবহ হয়। হতে বাধ্য। কারণ সাধারণ মানুষ তাকে প্রগতিশীল হিসবে বিশ্বাস করে।
অপরদিকে মৌলবাদী-জঙ্গীবাদী প্রচার মাধ্যম এ ধরনের ব্যাখ্যাগুলোকে বিজ্ঞাপন হিসেবে বাজারজাত করে।
দুই.
বিমান বন্দরের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়াকে একটি পক্ষ সরাসরি যৌক্তিক বলেছেন এবং এর পক্ষে সমর্থন যুগিয়েছেন। কোন রাখঢাক ছাড়াই। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, মনোজাগতিক পরিচয় কোনটিই নতুন করে বলার দরকার নেই। এ দলটির পাশাপাশি আরও কিছু মতামত চোখে পড়ছে।
এ মতামতগুলো এসেছে দৃশ্যত: প্রগতিশীল চিন্তার ব্যানারে। কিন্তু সেখানে ভেজালটা মেশানো হয়েছে খুব কৌশলে। ধর্মীয় জঙ্গীবাদের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম এর অস্তিত্ব খোঁজার ফর্মে।
এদের কারও কারও মতে বিমান বন্দরের সামনে ভাস্কর্যটা তৈরি হয়নি। তার আগেই সেটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
জনগণ যেহেতু এটি দেখেনি সেহেতু সরিয়ে নেয়া ভাস্কর্য নিয়ে কারও মাঝে কোন আবেগও তৈরি হওয়ার কথা নয়। সুতরাং ভাস্কর্য প্রতিস্থাপনের যে চলমান আন্দোলন-দাবি তা শিক্ষিত মানুষের অযৌক্তিক আচরণ। এবং এ সম্পর্কিত আবেগ-অনুভূতি-ভাবনাগুলো স্বত:স্ফুর্ত নয়, আরোপিত।
দ্বিতীয়ত: সারা দেশের ভাস্কর্য-শিল্প দর্শনে তার/তাদের মনে হয়েছে আলোচিত ভাস্কর্যটাও যথাযথ শিল্পমান সম্মৃদ্ধ হতো না। সুতরাং হুজুররা আন্দোলন করে পরিণামে নিম্ন মানের শিল্প সৃষ্টির হাত থেকে নাকি দেশকে বাঁচিয়েছেন।
শিল্পকে বাঁচিয়েছেন।
তৃতীয়ত: সারা দেশে স্থাপিত ভাস্কর্যগুলো নাকি এখন পর্যন্ত কোন ধরনের আবেদন তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং আবেদনহীন ভাস্কর্য থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। অতএব ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার মাঝে তেমন কোন অন্যায় কর্ম নেই।
চতুর্থত: ভাস্কর্য শিল্প চর্চায় নিয়োজিত শিল্পী-ঠিকাদাররা নাকি আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
সুতরাং হুজুরদের এ ধরনের ভূমিকা শিল্প চর্চাকে নাকি দুর্নীতিবাজ শিল্পীদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
তিন.
ওপরোক্ত ব্যাখ্যাগুলো এমন সব লেখা-বক্তব্যের মধ্যে এসেছে যেগুলোকে খুব সচেতনভাবে খেয়াল না করলে দৃশ্যত লেখাগুলোকে জঙ্গীবাদের বিপক্ষে মনে হবে। জঙ্গীবাদের বিপক্ষে নানা কথাবার্তাও রয়েছে ওসব লেখায়। কিন্তু একই সাথে ভাস্কর্য সম্পর্কিত ওপরোক্ত বক্তব্যগুলোও পরিবেশিত হয়েছে। যা প্রকৃতপক্ষে ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুধীতাকারী মৌলবাদী-জঙ্গীবাদীদের পক্ষেই যায়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পবোদ্ধা নই। ভাস্কর্য-বোদ্ধাতো নই-ই। সুতরাং ভাস্কর্যের শিল্পমান নিযে বিতর্কে যাবার কোন সুযোগ নেই আমার দিক থেকে। কিন্তু ভাস্কর্যগুলো আবেদনহীন এ ধরনের সাধারণীকরনের উৎস ও উদ্দেশ্যটা কী বিনীতভাবে জানতে চাই মান্যবরদের কাছে। অপরাজেয় বাংলা কতখানি শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে সে ব্যাখ্যা প্রদান শিল্প বোদ্ধার কাজ।
কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে এটি যে প্রতিবাদী হওয়ার সিম্বল হিসেবে ভূমিকা রাখে, সকল দুর্দিনে শিক্ষার্থীরা-সংগ্রামীরা এর আশে-পাশে সমবেত হয়েছে, প্রতিবাদী হয়েছে তার সর্বশেষ প্রমাণতো আমরা এ সেদিনও দেখতে পেয়েছি। জেলখানা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্তিপেয়ে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সেদিন আনন্দ-উচ্ছাস-আবেগ প্রকাশ করেছিল এ অপরাজেয় বাংলাকে ঘিরে। আর অপরজেয় বাংলাতো শুধু একটি ভাস্কর্য নয়, এটি একটি কালকেও ধারণ করে। মানুষের ইতিহাসকে বর্তমান বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবার জন্য এ ধরনের ভাস্কর্য সব সময় সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে বলেই জানি। তাহলে সারা দেশের ভাস্কর্যগুলো কোন আবেদন তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে যে বক্তব্য সেটি আসলে কোন পক্ষকে বিদ্যাজাগতিক সহায়তা প্রদানের জন্য এ রকম প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
আমার কাছে এ ধরনের প্রয়াসের উদ্দেশ্য অসৎ বলেই মনে হয়েছে।
বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের একটি বড় অংশ কিন্তু তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। ভাস্কর্য শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বলে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রীক এ ধরনের শিল্প চর্চাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে আমর মনে হয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, এসব শিল্পীদের দুর্নীতির সাথে সম্পর্ক রয়েছে তাহলেও কি ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়াটা বৈধ হয়ে যাবে? মোল্লারা দুর্নীতির কথা বলে ভাস্কর্যটা তো সরায় নি বা সরানোর দাবি তোলে নি। যারা ভাস্কর্য প্রতিস্থাপনের জন্য আন্দোলন করছে তারাও কোন বিশেষ একটি ভাস্কর্যের জন্য আন্দোন করছে না।
তারা এটিকে নিয়েছেন যে কোন নান্দনিক চর্চার ওপর আঘাত হিসেবে। তাহলে এমন দাবি ওঠার মনোজাগতিক উদ্দেশ্যটা কী।
ধরে নিলাম বিপুল জনগোষ্ঠীর মনোজগতে ভাস্কর্যগুলো আবেদন তৈরি করতে পারে নি। রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য-সংগীতও কি বিপুল মানুষ দ্বারা আস্বাদিত? তাহলে রবীন্দ্র-নজরুল চর্চা বন্ধের দাবির পক্ষেও দাঁড়াতে হয়। বলতে হয় ওগুলোও বন্ধ করে দাও।
এ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী রাজনীতির পক্ষেই যাই বলে প্রগতিশীলতার ব্যানারে এ ধরনের বিদ্যাজাগতিক চর্চার প্রতি আন্তরিক নিন্দাবাদ প্রকাশ করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।