যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
বিকট শব্দে হর্ণ কন্ডাক্টটারের চিৎকার ছাপড়া হোটেলের থালার বাড়ি হকারের ঘ্যানঘ্যানানি ভিখিরির প্যানপ্যানানি সার্জেন্টের অসভ্য সাইরেণ ধাতুদৌর্বল্যের মলমঅলার রেকর্ডেড পয়ার কুকুরের অহেতুক ঘেউ ঘেউ ঝোলানো মুরগির কক কক মাছের আঁশটে গন্ধ রমণীদর্শণে রিক্সাচালকের সিটি হোটেল বয় এর ফাঁটাবাঁশের মত হাকডাক সার্ভিস বাসের লম্বা হর্ণ আর ভারি ভরাট গুমগুমে আওয়াজ বুকে নিয়ে আরও একটা দিন শুরু করল মতিঝিল।
বিমান ভবনটার পেছনে একটা তেকোনা পার্কমত। বেসিক্যালি গার্বেজ। বিভিন্ন অফিসের ওয়েস্টেজ ঝাড়ার মোক্ষম জায়গা। পাশে সার সার ছাপড়া হোটেল।
একসময় রিকসা-ঠেলা চালকদের দখলে ছিল,এখন সায়েবরা দখলে নিয়েছেন। সামনেই চায়ের ঘুমটি দোকান। অনবরত বলে চলেছে , মামা বসেন,ছার বসেন,চা দিতাম ? বিশেষ ভাবে বানানো মিনিমাইজ সাইজের কাপে ফাটিয়ে চামচ মেরে যা ’মামা’র সামনে হাজির করা হয় তার বংশ পরিচয় নিয়ে বেজায় শংকা থাকলেও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলে না। এই না-বলা মানে এই নয় যে, বাঙালি ইদানিং কম বলছে।
হঠাৎ সবাইকে হতচকিত করে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে গেল এক নারী! ছুটে চলা শুধু নয়, সাথে সাথে চিৎকার করে চলেছে... বাবু.....বাবু .....বাবুরে...
বেঞ্চে বসা কয়েক জন এ ওর মুখ দেখাদেখি করল,কেউ কোনরূপ জ্ঞানগম্ভির সিদ্ধান্তে আসতে পারল না।
ঘুমটিঅলা অবজ্ঞার সুরে মামা দের আশ্বস্থ করল,
_কিচু অয় নাই মামু,পাগলি,ওই ডাস্টবিনের পাশে থাহে।
_বাবু বাবু করতাছে যে.. মামুদের একজনের জিজ্ঞাস্য।
_অর পুলা, লৌরাইছে যেনি কেউ।
_তুমি চিন ক্যামতে?
_চিনি কেডা কইল? এইহানে আহে,এইডা ওইডা চাইয়াচিন্তে খায় আরি..
উৎসুক হয়ে ওঠা মামু ফড়াৎ করে বড় একটা চুমুক মেরে 'বাবু চিন্তা' সরিয়ে দেয়।
১০টা ৪৫।
ব্যাংকের সামনে দাঁড়ানো জনা পাঁচেক ক্লায়েন্ট এবং জনৈক ব্যাংক কর্তা। তাদের আলাপের বিষয় দুপুরে লাঞ্চটা এখনই সেরে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত। অথবা আদৌ সম্ভব কি-না? কে কবে কিভাবে সকালেই দুপুরের কাজাটা সেরে আবার দুপুরেও সেরেছিলেন সেই ইতিহাস বয়ান করতে লাগলেন এক জন। ইতিহাস বলায় বাঙালির জুড়ি নেই। এত দ্রুত সেল্ফ মেইড ইতিহাস বোধকরি আর কোন জাতির পক্ষে বলা সম্ভব না।
যখন সিদ্ধান্ত হয়েই গেল যে তারা এখনই গিলবেন ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের গা ঘেসে দৌড়ে গেল পাগলি.....সেই একই চিৎকার.....বাবু....... বাবু.....বাবুরে.......
১১টা ১৫। দিশি এবং বিদেশী সঙ্করের এক ব্যাংকের কাউন্টারে পঁচিশ-ত্রিশের মধ্যে বয়সের দুই তরুণ। কাউন্টারের ওপাশে ২০ থেকে ২২ এর বিপাশা বসুর কপি। কপি নিবিষ্ট মনে ল্যপটপে কাজ করে চলেছে। ২৫/৩০ এর একজন খুক করে কেশে সাহস সঞ্চয় করে বলে বসল,
_ম্যাডাম কি নর্থ সাউথের?
_ওহ নো,কেন বলুন তো?
_না মানে ঠিক আপনারই মত দেখতে আমাদের এক ফ্রেন্ড ছিল.....
_ওহ আই সি,মোষ্ট লাইকলি...... মেয়েটি জানে এই চান্দুদের মতলব।
রোজ কম করে হলেও এই মাপের জনা দশেক কেস ওর ফেস করতে হয়। এক্সপেরিয়েন্স ! মুখে বলল, আপনারা জাস্ট একটু ওয়েট করুন,কার্ডটা ওকে করে দিচ্ছি.....হুড়মুড় করে ব্যাংকের ভেতরেই ঢুকে পড়েছে সেই বাবুর মা। যাকে আমরা এতক্ষণ পাগলি বলে চলেছি।
কেউ জানে না ঠিক কবে থেকে ও আর ওর ছেলে এখানে ঘাঁটি গেড়েছে। মতিঝিলের নিয়ম হলো সন্ধ্যের পর জায়গাটা শ্মশানের মত শুনশান হয়ে যায়।
রাতে ওই মেয়েটি বা ছেলে কি করে কোথায় থাকে কেউ জানে না। কিন্তু সকাল হতেই তাদের মা-বেটাকে দেখা যায়। যেহেতু পাগলি সেহেতু আমরা তার কাছে কিছুই জিজ্ঞেস করতে যাব না। কেননা আমরা পাগল বিশ্বাস করি না। যেমন আমাদের বড়কর্তারাও পাব্লিককে বোকাচোদা আর পাগল ধরে নেওয়ায় দু পয়সা দিয়েও বিশ্বাস করে না।
এই বাবুর মা হতে পারে কোন একটা অজ গ্রাম থেকেই কোন এক কালে এসেছিল। হয়ত একাই ছিল। হয়ত কোন এক গবেটমারানী ক্যাপ ছাড়াই কাম বানিয়েছিল। হয়ত তারই সোদা আঁশটে গন্ধ বস্তু থেকে বাবুর সৃষ্টি ! আমরা এই ক্রোনোলজি নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাব না। মাথা ঘামানোর মত হেভি সব আয়োজন আছে আমাদের।
ব্যাংকে ঢুকে তিনটা পাক দেওয়ার সাথে সাথে দারোয়ান চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে আছড়ে ফেলল বাইরে। ওখানেও সেই একই চিৎকার......বাবু ......বাবু ......বাবুরে.......
১২টা ১০। দুজন মাঝ বয়সী চ্যাপ্টা মত মানুষ এক দপ্তর থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এলো। একজন আর এক জনের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হবে ওই সাথী বোধ হয় এই মাত্র মেইডেন সেঞ্চুরি করে ফিরল !ব্যাপার তা নয়।
যেখানে বাপের জন্মেও তুলা আবাদ হয় না সেই রকম এক জেলা শহরে কম্পোজিট স্পিনিং মিলের প্রজেক্ট পাশ করিয়ে ফেলেছে আজ। কেল্লা শুধু ফতে নয় কেল্লা এখন ঢাকাতেই।
_আগে বাড়ি,গোসল করে তার পর ফাইভস্টার
_না, আগে বার, গলা পর্যন্ত গিলব, তার পর অন্য কথা।
_তুই না.....আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিল,শেষ হলো না, দুজনের মাঝখানে ঘসা দিয়ে পাগলি ছুটে গেল..
বাবু......বাবু ......বাবুরে.....................
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শরীর থেকে ময়লা ঝেড়ে এক জন বলল, যাঃশালা,সাদা জামাটার ইয়ে করে দিল ? শালার এই সব বালছাল যে কোত্থেকে আসে.....
_বালছাল ঠিকই,পাগল ভাব নিতাছে,দেহগা রাইত হইলেই হুইয়া পরছে.....এগো আমি ভাল কইরা চিনি
_ফিগার দেখছো? শালী পাগলি,কিন্তু ঠিকই জিনিস মেনটেইন করছে ! বক্তা মুহূর্তে চলে গেছে অবসেশনে.......কন্ঠার হাড় দুইটা একটু উঁচু। একটু নিচে মাই দুইটা টোল খাইয়া আবার মাথা তুলছে।
একদম খাড়া যারে কয় তা না। এইরম টোল খাওয়া জিনিস সহজে চোখে পড়ে না। তার পর কমোরটা ? দুই হাতে ধরা যাইব! নাভি ? গোল না, ক্যামন লম্বাটে একটু চেরা ধরণের। অবসেশন আরো নিচে নেমেছিল। অবসেশনে আক্রান্তের শরীরী পরিবর্তন চেক করলেই ধরা যেত।
ধরা উচিৎ না। জগতটা এই রকমই। 'মদ-মাগী-মাল’এ টিকে আছে। অনেক ক্ষণ পর ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে তারা চলে যায়।
১২টা ৪৫।
আমাদের বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি জায়গা চক্কর দিয়ে এসেছে পাগলি। কোথাও বাবুর সন্ধান মেলে নি। ফিরে এসে বসেছে সেই ডাস্টবিনের পাশে। পাগল রা নাকি কাঁদতে পারে না। এমটাই বয়ান টয়ান শোনা যায়।
পাগলদের নাকি ঘুমও হয় না। ঘুম হলেই নাকি পাগলামি সেরে যায়। পেশাদার চিকিৎসা ব্যাপারীরা বলেন।
১টা ৩০। সেই আগের জায়গায় আর নেই পাগলি।
অনেকক্ষণ কোন হাকডাকও শোনা যাচ্ছে না। তবে যে সকল শব্দ নিয়ে মতিঝিল শুরু হয়েছিল তার সবই আছে। আয়োজনে বেড়েছে। শত শত মানুষ যার যার কাজকর্ম করে যাচ্ছে। কোথাকার কোন পাগলির ছেলে হারালে কার কি?ব্যাস্ত ওই অঞ্চলের জীবন যাত্রায় সামান্যতম পরিবর্তন আসেনি।
আসার কথাও নয়। যাদের সংবেদনশীল মন আছে তারা হয়ত এই ছেলে হারানোর ঘটনাটা নিয়ে কল্প রাজ্যে অনেক দূর অব্দি হারিয়ে যেতে পারেন। যদি এই হতো? যদি ওই হতো? আরো কত কি..এই সময় আবারো দেখা গেল পাগলি কে। এখন আর ছুটছে না। কন্ঠস্বরও বসে গেছে।
ফ্যাস ফ্যাস করে, বিড় বিড় করে বলে চলেছে.....বাবু.....বাবু......বাবুরে......বাজান কই গেলি......................
এই প্রথম বাবুর বাইরে আর একটা শব্দ শোনা গেল!
২টা ২০। ভক ভক করে ভূনা খিঁচুড়ি আর কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধ বেরুচ্ছে। হামলে পড়া মানুষগুলো হা-ভাতের মত গিলছে,যেন লাব্বায়েক শব্দটা বলা শেষ,যেন শিঙ্গা ফুঁকে দিয়েছে, আর সময় নেই!ঠিক এই সময় দেখা গেল একটা দুই আড়াই বছরের ছেলে কে বুকে জাপটে ধরে পাগলি হাউমাউ করে কাঁদছে আবার হাসছে!চোখের জল গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে ময়লা কেটে। সেখান দিয়ে একটা চিকন দাগ রেখে যাচ্ছে! ছেলেটা মায়ের বুকে বাদুড়ছানার মত লেপ্টে রয়েছে। এবার জনা পাঁচেক মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল বায়োস্কোপের শেষ দৃশ্য দেখার জন্যে।
কেউ কেউ দুএকটা মন্তব্য চুঁড়ে দিচ্ছে। পাগলি তার ছেলেকে সেই যে জাপটে ধরেছে আর ছাড়ার নাম নেই। উন্মাদের মত ছেলের সারা গায়ে মুখ ঘসছে। কলিজার টুকরা ফিরে পেলে মানুষ পাগল হয়, না পাগল মানুষ হয় সেই গবেষণা করার কেউ এখানে নেই। আদর করতে করতে একসময় পাগলি বেড়ালের মত গোল হয়ে কুকড়ে শুয়ে পড়ে..ওই ভাবেই শুয়ে থাকে..পরম মমতায় বাবু মাটি পাগলি একাকার হয়ে যায়...............
অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচাপাকা চুলের এক গম্ভির মানুষ পেছন ফিরে চলে যাওয়ার সময় বলে,'একটা নোংরা খেলনা পুতুলকেই ছেলে মনে করে জড়িয়ে কি না কি করছে....... পাগল !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।