গল্পে, কবিতায়, মানুষের প্রতিটি বর্ণনায় আমি কেবল হতাশা খুঁজে বেড়াই । নিজে নির্জন বলে; নির্জনদের, নীরবদের, বিষন্নদের গল্প না হলে মনের ভেতর থেকে অনুভুতি উঠে আসে না । রাস্তা পেরোতে গিয়ে বেয়াড়া গাড়ির চাকায় ঘ্যাঁচ করে থ্যাতলে যায় যে দুহপ্তা বয়েসী ব্যাঙ তার দুঃখে আমি দুইরাত কাটিয়ে দিতে পারি না খেয়ে, কেবল তারা গুনে । যে লোকটা সারাদিন পাখি বেচে গড়েছে সংসার/হলুদ পাখির মত যার বউ, সে কেনো গলায় পরে ফাঁস / সে লাশ পচার আগে মৃত এক পাখি, বউটিকে নিশীথে কাঁদাতে এসে দেখে / হা কপাল, আনন্দে উচ্ছল নারী হয়েছে উৎসবে দ্বিধাহীন / আয়নায় কাজল পরা দু'টি চোখ ক্ষুধায় উজ্ঝল.... পড়তে পড়তে আমি পাখিওয়ালার দুঃখের সাথে মিশে যেতে পারি অন্ধকারে গাছের পাতার ছায়ার মত ।
জীবনের তেরছা বাঁকে বাঁকে পাখিওয়ালার ফাঁসের দড়ির কথা আমি প্রতি বাঁকে কয়েকবার করে ভাবি ।
ভালোবেসে শ্যামল মেয়েরা বারবার আমার শূণ্যতাকে ভরে দিতে চেয়েছে শতশত নাগরিক, ছোটখাট, মানবিক স্বপ্নে । কখনো কখনো আমিও দেখতে শুরু করেছি তাদের ভিতরকার নানান রঙ । তারা আসে সইদের মত দলে দলে, একের সাথে আরেক । সেসব সময় কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই ।
অনুভুতির নরম মসলিনে আমাকে দিনমান জড়িয়ে রাখতে চাওয়ার স্বপ্ন নিলাজের মত বলে যায় সোহেলী ।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রবাহ আমি বুঝতে পারি না আমার শরীর বেয়ে । সে একসময় দুরের অচেনা মেয়েটি ছিল । এখন নেই, তাই সঙ্গমচিন্তার উথাল প্রবাহটিও এত ঘনঘন নয় এখন ।
যে মেয়ে একটি দুটি করে চোখের ইশারা, সহানুভুতিকথন আর সাময়িক উচ্ছলতার উদগিরনের নানা রঙ সুতো দিয়ে স্বপ্ন বুনা শুরু করেছে, তার স্বপ্নের বাড়িটি, সে যদি কোনো সম্পর্কহীন গল্পের নায়িকা হত, আমি চাইতাম ভেঙ্গে যাক আরো শব্দ করে । তার চরাচর দুঃখে ভরে যাক, প্রতিটি দিন তার কাছে প্রলয়ের প্রতিক্ষার মত দীর্ঘ মনে হোক ।
পাখিদের দেখে দেখে সে চোখ ভাসাক জলে । পার্বনে উৎসবে তার মুখ কালো হয়ে থাক বিষাদে । সন্ধ্যায় তার ঘরে ভীড় করে থাক দেশের সমস্ত অন্ধকার ।
কিন্তু যে কন্যার স্বপ্ন-গঠনের প্রতিটি পদক্ষেপ আমি দেখেছি, ছোট বোনের ছোট্র-ছোট্র থেকে বড় হয়ে যাওয়ার মত করে, তার জন্য এমন পরিণতি আমি চাইতে পারছি না । নিজের ভিতরের এই বৈপররিত্যের, একবার এপক্ষ একবার ও পক্ষ নিয়ে আমি ক্রমাগত অর্থহীন বোধের দিকে যেতে থাকি ।
তাই যত মানুষের যত বলার কথা আছে, যত কাহিনী আছে, যত অব্যক্ত কবিতা আছে সবকিছু খুঁজে খুঁজে আমি ধ্বংসই যে একমাত্র অবিনশ্বর সত্য তার পক্ষে প্রমান জোগাড় করি মগজে । কিন্তু মননে বারবার হেরে যেতে থাকি ।
আমি পারবো না নির্মোহ নীলিমার দিকে তাকিয়ে, আরো শক্ত করে কারো হাত চেপে ধরতে । নির্মোহ নীলিমার দিকে তাকিয়ে আমি কেবল ট্র্যাজেডির নায়িকাদের ব্যাক্তিগত শোকছটা খুঁজে যেতে চাই । সোহেলিকে এই কথাটি বুঝিয়ে বলতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ।
ওর ভেঙেচুরে যাওয়া মুখের দিকে চাইতেই পারছিলাম না । অনেক গাঢ় করে বুঝেছি গল্পের নায়িকাদের বাস্তব দুঃখের ভার নেয়া গল্প পড়ে খালিপেটে ছিদ্রহীন অন্ধকারের দিকে দুরাত তাকিয়ে থাকার মত সহজ নয় ।
আমার সমস্ত ভাবনার যাতায়াতের অধিকার বা নিজস্বতার দাবীর কোনোটাই নেই সোহেলির । সে চায় কেবল ঘোর শ্রাবণেও যেমন কখনও কখনও হলুদ সূর্য দেখা যায়, তেমন করে আমার নিশ্ছিদ্র শূণ্যতার মাঝের উদ্বেল মুহূর্তগুলোতে যেন সে শুধু থাকতে পারে । তা সে জীবনে একবারই হোক ।
ঐ একবারের জন্যই সে সবকিছু বাজি ধরতে রাজি ।
বলি মেয়েকে , সেটা হবার নয় । সে সাথে থাকলে আমি পারবো না নিজের মত করে শূন্যতাকে টেনে টেনে অন্তবিহীনভাবে দীর্ঘ করে যেতে ।
আমি পারব না এমন করে, একটি প্রত্যাখানের গল্প; যা দুলাইনে বলে ফেলা যায় তাকে এমনভাবে প্রতি ছত্রে ছত্রে হতাশা, শূন্যতা, বিষাদ দিয়ে মুড়ে, দীর্ঘ শোককাব্যে পরিনত করতে । যদি সোহেলি থাকে সাথে ।
মায়ার জন্য ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।