মাহবুব লীলেন
আমার চেহারাটা কোন মতেই অন্য কোন বাঙালি থেকে আলাদা করার উপায় নেই। বাংলাদেশে যারা চোর ছ্যাঁচড়া ডাকাত অথবা পুলিশ অথবা বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী টাউট ও সুবিধাবাদী। আমাকে দেখলে তাদের থেকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। অনেকবার পুলিশের সন্দেহের তালিকায় পড়া এবং অনেকবার অনেকের মুখে অবিকল অমুকের মতো দেখতে কথাটা শুনে শুনে নিজেকে বাংলাদেশের সার্বজনীন অথবা ব্রান্ড চেহারা ভাবতে শুরু করেছি বহুদিন। ফলে মহিলাটি যখন ঘুম ভেঙ্গে হুড়মুড় করে উঠে ক্রাচটি টেনে কাছে নিয়ে ছালার ব্যাগটি কোলের কাছে লুকিয়ে আমার দিকে বিরক্তি ও প্রশ্নের চোখে তাকালো তখন আমার মোটেও বিস্ময় বোধ হয়নি।
অথবা খেয়ালও করিনি তাকে তেমন একটা। কারণ ধুমপানমুক্ত সংস্কৃতিতে জীবিকা সংস্থান করতে এসে আমাকে প্রায়ই ফুটপাতের নোংরা অথবা বারান্দার ভিখেরিদের কাছে দাঁড়িয়ে বদ অভ্যাসটির চর্চা করতে হয়। যে মিনিট পাঁচেক দশেক দাঁড়িয়ে কাটাই তার মধ্যে অনেক কুকুর, প্রেম, মারামারি কিংবা ভিক্ষা সবকিছুই আমাকে দেখতে হয়
এখানেও কিছুই আলাদা নয়। অডিটোরিয়ামের বারান্দায় ভিক্ষুক শুয়ে আছে তার পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছি। আলাদা হবার মতোও কিছু নেই।
কিন্তু তার ধড়মড় করে উঠে বসায় আমাকে তাকাতে হলো। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে সে। ভাবলাম ভিক্ষে চাইবে। বিড়বিড় করে কিছু বলল। শোনার চেষ্টা করলাম।
আরো গুটিয়ে গেল। চোখে আতংক। বিড়বিড় আরো বেড়ে গেছে। ক্রাচ আর ব্যাগটি এবার সে আরো জোরে আঁকড়ে ধরেছে। একটু পিছিয়ে এসে জানতে চাইলাম কী বলে।
অনেক কথা বলল উত্তরে। কিন্তু আমার পক্ষে এই দক্ষিণবঙ্গের ভাষায় বিড়বিড়ানো থেকে অর্থ উদ্ধার করা বেশ কঠিন। একটা শব্দ শুধু কয়েকবার শুনলাম- নকশাল নকশাল
- নকশাল কী?
- আমি নকশাল না। আমার ছাওয়াল নকশাল করে না
বাংলাদেশের দক্ষিণের এই জেলার সাধারণ জীবনে এখনো এই নকশাল শব্দটি একটি স্বপ্ন ও আতংকের মিশ্রিত উচ্চারণ। সে যে কোন কারণেই হোক ভয় পাচ্ছে আমাকে দেখে।
বিড়বিড় করছে এখনো। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম
- ছাওয়াল কই?
গুটিয়ে গেল আরো। ভেতরে কনফারেন্সে বেশ হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। বিতর্ক তর্কে চলে গেছে। আমার যাওয়া উচিৎ।
সম্মেলনটি থেকে যদি কোন ঐক্যমত্য না আনা যায় তবে বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে দক্ষিণের এই জেলাটির। মাতৃত্বজনিত জটিলতায় মায়েদের মৃত্যুর হার যেসব এলাকায় বেশি সেসব এলাকায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব আমার। ভেতরের পরিবেশ আবারো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমার সহকর্মীটির সেশন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দুর্দান্ত। আরেকটা বিড়ি ধরালাম
-আপনার ছাওয়াল কোথায়?
- নাই।
আমার ছাওয়াল নকশাল করে না
- আমি জানি সে নকশাল করে না। এখন থাকে কোথায় সে?
- থাকে না। নকশাল কই থাকে আমি জানি না। আমার ছাওয়ালও জানে না
ছাওয়াল আর নকশালে ঘুরপাক খাচ্ছেন বৃদ্ধা। ভেতরে কেউ একজন প্রায় কেঁদে ফেলছেন মা ও মাতৃত্বের গুরুত্ব বোঝাতে।
সহকর্মীটি একবার উঁকি দিয়ে গেল। বললাম চালিয়ে যান
অনেক্ষণ দেখার ফলেই বোধ হয় বৃদ্ধার চোখে আর ভয় নেই। কিন্তু তার ঘুম ভাঙ্গানোর বিরক্তিটা রয়ে গেছে। বৃদ্ধা যেমন ঘুরছে দুটি শব্দে আমিও ঘুরছি একটা ছাওয়াল শব্দের মধ্যে। দুর্বোধ্যআঞ্চলিক টান আর বয়সের জড়ানো কথা থেকে এবার আরেকটি শব্দ বোঝা গেল - পুলিশ
পুলিশ তার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে
দক্ষিণের অন্য যে কোন গ্রামীণ যুবকের মতো তার ছেলেও মাঝে মাঝে কৃষি- মাঝে মাঝে মজুরি- মাঝে মাঝে রিকশা আর প্রায়ই বেকার সময় কাটতো বাজারে বসে।
আর এই জেলার ঐতিহ্য মেনে মাঝে মাঝে রাতে এসে হতাশ গলায় মাকে বলতো আজ ছয় জনকে খাওয়াতে হবে। ওরা রাতে আসবে বলেছে। অথবা দুই জন থাকবে রাতে। সে জানে অন্য দশটা ঘরেও এরকম ঘটে। জানে মাও।
ওরা আসে। খায়। মাঝে মাঝে পুলিশের জন্য নিজের বাড়িতে থাকতে না পারলে এসে থাকে। ওদের কাজের জন্য ওদেরকে এভাবে থাকতে হয়। ওদের কাজের জন্য ওদেরকে সবার থাকতে দিতে হয়
সমস্যা ছিল না তাতে।
ওরা থাকবে জানলে গ্রামের দোকানীরাও বাড়িওয়ালাকে বাকিতে সওদা বেচে। এটাই নিয়ম এই এলাকার। কিন্তু পুলিশের নিয়ম অন্য। একদিন ওরা পরপর তিন দিন থাকার পর ভোর রাতে পুলিশ ওদের ঘুম ভাঙ্গায়। নিয়ে গিয়ে থানায় থাকবার ব্যবস্থা করে
- তুই কি দেখতে আমাদের থেকে আলাদা? তোর চেহারা কি রাজা বাদশার মতো? তাহলে পুলিশ তোরে নিল না কেন?
‘জানি না’ কথাটিকে যতভাবে বলা যায় বলার পরও এর অর্থ বোঝে না ওরা।
ওরা ওদের তৃতীয় প্রশ্নটিই করতে থাকে অনবরত। শেষমেশ ওরাই উত্তর দেয়- তুই পুলিশে বলেছিস আমরা এখানে আছি
বাংলায় 'না' শব্দের ভালো কোন প্রতিশব্দ নেই। দশবার 'না' বললে 'না' কথাটাকেই বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হয়। ওরা বিরক্ত হয়। - এতো না না করিস কেন।
তুই খবর দিয়েছিস
ওদেরও আর কথা বলতে ভাল্লাগে না বেশি। চাদরের তলা থেকে কিরিচ বের হয়ে পড়ে। মা লোকটার পেছন থেকে মাজা ধরে ঝুলে পড়ে। কিরিচের কোপটা পড়ে ঘরের বেড়ায়। লোকটা ঝাঁকি দিয়ে যতক্ষণে মাকে সরায় ততক্ষণে ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বহু দূর।
ওরা সব জায়গায় ঘরের বাইরে কাউকে তাড়া করতে পারে না। করেও না। ওদের রাগ গিয়ে পড়ে ঝাঁকি খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়া মায়ের ওপর। কিরিচটিও নেমে আসে। এলোপাথাড়ি দুই তিন কোপ।
বাম পায়ের হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত লাগে সব
সরকারি হাসপাতাল থেকে যখন বের হয় তখন এই কাঠের ক্রাচটি সাথে নিয়েই বের হয় সে। বাড়িতে ওরা আর আসতো না এর পর। ছেলেটা আসতো মাঝে মাঝে রাতে লুকিয়ে। থাকতো। পুলিশ আসেনি আর।
একদিন এলো
- তোর বাড়িতে নকশাল থাকে দরজা খোল
ওরা তার ছেলের ঘুম ভাঙ্গালো- এইতো নকশাল। চোরের মতো দেখতে।
- এইটা আমার ছাওয়াল। নকশাল করে না
- তুইও নকশাল। তোর পা গেল কেমনে?
ছেলেটা দ্বিতীয়বার দৌড় দিল।
মা দ্বিতীয়বার আগলানোর চেষ্টা করলো ছেলেকে। এবার এক পা নিয়ে সে ঝাঁকি খেয়ে পড়ে গেল অল্পতেই। পড়েই রইলো। ছেলে আগের মতো মাঠের দিকে দৌড়াচ্ছে । পুলিশ বাইরেও দৌড়াতে পারে।
পুলিশও দৌড়ালো। ভোরের আলোয় একটু পরেই কয়েকটা শব্দ হলো বন্দুকের
ভেতর থেকে বেশ গুঞ্জন ভেসে আসছে। সহকর্মীটি বের হয়ে এলো- এর পরে আপনার সেশন
ভেতরে সবাই ব্যস্ত মাতৃমৃত্যু রোধের উপর সুপারিশ তৈরিতে। এর পরে আমার সেশনের নাম মাতৃত্বের অধিকার
২৬- ২৭ আগস্ট ২০০৩/মঙ্গলবার-বুধবার
............................................
উকুন বাছা দিন
প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য।
২০০৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।