মাহবুব লীলেন
সকালে এসেছিল ক্রান্তি। মাকে দিয়ে চক্ষু হাসপাতালের বড়ো ডাক্তারের কাছে একটা ফোন করিয়েছে। বড়ো ডাক্তার আমার চাচা। ক্রান্তির চোখ ট্যারা। চিকিৎসকরা নাকি আজকাল ট্যারা চোখ সোজা করতে পারেন।
মাকে দিয়ে সে বড়ো চাচাকে অনুরোধ করিয়েছে যেন তিনি ক্রান্তির চোখটা ভালো করে দেখেন
বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষেই উঠে গেছে চক্ষু হাসপাতালের টিলা। টিলার উপরেই হাসপাতাল আর বড়ো ডাক্তারের বাসা। গাছগাছালির ফাঁকে হাসপাতালটি তেমন একটা দেখা যায় না বাইরে থেকে। শুধু প্যাঁচিয়ে ওঠা সিঁড়িগুলো আংশিক চোখে পড়ে গাছের ফাঁকে
দেরিতে ঘুম ভাঙা অভ্যাস আমার। সকালে তন্দ্রায় ক্রান্তির গলা শুনেছি।
এখন হাসপাতাল টিলায় লোকজনের হৈচৈ শুনে ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে গেল। লাফ দিয়ে উঠে বাইরে যেতে চাইলে দরজা আটকে দাঁড়ালেন মা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন তোর বড়ো চাচার সাথে এলাকার লোকজনের গণ্ডগোল বেঁধেছে। লোকজন চারদিক থেকে অনবরত হাসপাতাল টিলায় ঢিল ছুঁড়ছে। এখন বেরোবি না।
ওরা তোকেও মারতে পারে।
মা কোনো কারণ বলতে পারলেন না। শুধু বললেন ক্রান্তি যাবার অল্প পরেই হৈচৈ শুরু হয়ে যায়
আমি বেরোলাম মাকে সরিয়ে। ক্ষিপ্ত লোকজন ঢিল ছুঁড়ছে হাসপাতালে। তিন চারটে তরুণ আমার দিকে তেড়ে এল।
হঠাৎ আবার থেমে গেল। একজন বয়স্ক গজরাতে গজরাতে এগিয়ে এল আমার দিকে- দেখো বাবা- দেখোতো কাণ্ডটা। তোমার বড়ো চাচা। আমাদের মুরব্বি। বয়স্ক মানুষ।
আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু মেয়েটা যেতেই তিনি তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার ঘরে। ...ছি ছি ছি। নিজের মেয়ের বয়সী মেয়ে। তিনি কি না তাকে নিয়ে গেলেন তার ঘরে... এলাকার ছেলেরা ছাড়বে কেন? তারাতো আর অবুঝ না।
চোখের ডাক্তার তিনি। বয়স্ক মানুষ। তিনি কেন...
- কোন মেয়ে?
- ওই যে ট্যারা মেয়েটা তোমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসে। সেই মেয়ে
- মেয়েটা কোথায়?
- আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাকে নামিয়ে আনতে। কিন্তু সে হাসপাতাল টিলা থেকে কিছুতেই নামতে চায় না
লোকজনের ঢিলের ফাঁকেই দৌড়ে উঠলাম হাসপাতালে।
বড়ো ডাক্তারের কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ক্রান্তি। আমি ওর হাত ধরলাম। ক্রান্তি অনড়- আমি যাব না
- পাগলামি করিস না ক্রান্তি। আয়
- যে সন্তানের বীজ নিয়েছি সে সন্তান জন্মানোর আগে আমি এ টিলা থেকে নামব না
ক্রান্তিকে বোঝানো কঠিন। আমি ঢুকলাম বড়ো চাচার কক্ষে।
চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। তার ঘরের ছাদে- জানালায় তখনও উড়ে এসে পড়ছে ঢিল- পাথর। আমাকে দেখে চোখ তুললেন
- আপনি কী করেছেন এটা?
বড়ো চাচা আমার চোখে চোখ রাখলেন- আমি ভুল করিনি। ওর চোখ ঠিক হবে না
- এসব বাজে কথা
- আমি তাকে বলেছি তার সন্তানের সুন্দর চোখের দায়িত্ব আমি নিতে পারি...
- এলাকায় সব জানাজানি হয়ে গেছে
- এলাকার মানুষ মূর্খ। ওরা বোঝে না কিছুই
- তার চিকিৎসা যদি আপনার সাধ্যের বাইরে ছিল তবে তাকে ফিরিয়ে দিলেই হতো
- ডাক্তার হিসেবে তার চিকিৎসা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল।
কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়
- আপনার কাছে সে ডাক্তারের চিকিৎসার জন্যই এসেছিল
- সেও মানুষ আমিও মানুষ
- কিন্তু আপনি করেছেন পশুর কাজ
- এক অর্থে তাই। পশুর সাথে আমাদের অনেক কিছু মিলে যায় বলেই অপাশবিক অনেকগুলো আরোপিত কাজ করে আমরা নিজেদেরকে মানুষ প্রমাণ করতে চাই
- আপনি তা করেননি মোটেও
- করিনি। কারণ ডাক্তার হিসেবে আমি জানি মানুষের চিকিৎসা থেকে পশুদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। আর এজন্যই গরুর বাচ্চা গরু হয়। কুকুরের বাচ্চা কুকুর।
...আমার চোখ খুবই সুন্দর। ক্রান্তির চোখ ট্যারা। এক্ষেত্রে একমাত্র পশুদের পদ্ধতিতেই আমি আমার চোখটা ওকে দান করতে পারি। মানুষের পদ্ধতিতে নয়
এই লোকের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। ফিরে আসলাম বারান্দায়।
ক্রান্তি দাঁড়িয়ে আছে। ক্রান্তি বিধ্বস্ত। ক্রান্তির বাবা এসেছেন। ...ক্রান্তি যাবে না। সে আর ফিরে যাবে না বাড়িতে।
ওর বাবা আমার দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে নেমে হারিয়ে গেলেন ক্ষিপ্ত জনতার মাঝে। আমি ক্রান্তির হাত ধরলাম- চল
- তুই যা। আমি সন্তানের জন্য অপেক্ষা করব
- এ সন্তান তুই চাসনি। তোকে জোর করে দেয়া হয়েছে
- তবুও সন্তানটা হবে আমারই
- সুন্দর সন্তানের জন্য তোকে কোনো না কোনো ঘরে থাকতে হবে।
এটা একটা উঠান। উঠানে মানুষ দাঁড়ায়। থাকে না
ক্রান্তি গভীরভাবে তাকাল আমার দিকে- বাবার ঘরে ফিরে যাব না আমি। ওরা আমার সন্তান জন্মের পথ বন্ধ করে দেবে
- আমাদের ঘরে চল
- না। সেখানেও না।
যদি তুই আমাকে একটা নতুন ঘর দিতে পারিস তবে যাব
এই শহরের সবগুলো ঘরই লোকজনে ঠাসা। নতুন কোনো ঘর নেই। নতুন মানুষেরা দাঁড়িয়ে থেকে ঘর বানায় এ শহরে। তারপর দখল করে বসে সব। এই শহরে থাকার মতো খালি ঘরের সন্ধান জানেন মাত্র একজন।
তিনি আব্দুর রশিদ। শহরের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোকে তিনি বেকার ও বৃদ্ধ মিস্ত্রিদের নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখেন পথে দাঁড়ানো মানুষদের ছায়া ও আশ্রয় দেয়ার জন্য
আব্দুর রশিদ বললেন- আছে। পাওয়া যাবে। কিন্তু সে বাড়িতে জুতা পায়ে যাওয়া যাবে না। জুতা পিছলে যেতে পারে
ক্রান্তিকে নিয়ে আব্দুর রশিদের পিছু পিছু ছয় তলার সিঁড়ি ভেঙে যখন উপরে দাঁড়ালাম তখন মাথার উপরে স্পষ্ট খোলা আকাশ।
কোনো ঘর নেই। আব্দুর রশিদ আঙুল তুলে দেখালেন- ওইযে। ওখানে থাকতে হবে তোমাদের
সামনে লোহার রডের জালি। মাঝে মাঝে দু’-এক টুকরো সিমেন্ট ঝুলে আছে। বোঝা যায় এক সময় এখানে ছাদ ছিল।
কিন্তু সব সিমেন্ট-বালি খসে গিয়ে শুধু রডের জালিটিই টিকে আছে। রডের জালির ওপারে একটা ঘর দেখা যায়। কোনো এক কালে হয়ত সিঁড়ি-ঘর ছিল ওটা
- তোমাদের জুতা খুলে ফেলো। আব্দুর রশিদ বললেন
- আর কোনো রাস্তা নেই ওখানে যাবার?
ক্রান্তির প্রশ্নে ভারি চশমার কাচের ভেতর দিয়ে তাকালেন আব্দুর রশিদ- আর কোনো পথ থাকলেতো বাড়িটা পরিত্যক্ত হতো না এতদিন। পথ নেই কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে বলেইতো লোকজন ছেড়ে গেছে বাড়িটা।
আর আমিও আমার খাতায় তুলে নিয়েছি এর নাম
আব্দুর রশিদ লোহার জালে অভ্যস্ত পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। ক্রান্তির হাত ধরে আমি যখন পা বাড়ালাম; সাথে সাথে দুলে উঠল লোহার জালি। ক্রান্তি ভয়ে আঁকড়ে ধরল আমাকে। খুব একটা এগুতে পারিনি আমরা। আব্দুর রশিদ পৌঁছে গেছেন ওপারে।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন- ভয় নেই। এসো
- ভেঙে পড়ে যাবে তো
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন আব্দুর রশিদ। ভাঙবে না। এগুলো লোহার রড। লোহার রড বাঁকা হয় কিন্তু ভাঙে না।
আর সিমেন্ট পাথর বাঁকা হয় না কিন্তু ভেঙে পড়ে। দেখো না সব সিমেন্ট পাথর পড়ে গেছে কিন্তু লোহা পড়েনি। এসো
- ভয় লাগে
আবারো হাসলেন আব্দুর রশিদ। দাঁড়াও পরীক্ষা করে দেখাচ্ছি তোমাদের। তোমরা ওখানে দাঁড়াও
আব্দুর রশিদ লোহার জালের এক মাথা ধরে ঝাঁকুনি দিতে শুরু করলেন।
আমাদের নিয়ে কেঁপে উঠল পুরো দালানটা। চিৎকার করে উঠল ক্রান্তি। ওদিকে প্রচণ্ড রকম শব্দে হাসছেন আব্দুর রশিদ; ভাঙে না- ভাঙে না। লোহা ভাঙে না। একটা আরেকটাকে কামড়ে ধরে থাকে লোহা।
লোহার মায়া খুব বেশি। তোমাকে দোলাবে কিন্তু ফেলবে না
আব্দুর রশিদের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে অভ্যাস আর সাহস দুটোই হয়ে গেল আমাদের। সেই সাথে বিশ্বাসও হলো লোহা ভাঙে না। শুধু দোলে
আব্দুর রশিদ ঘর দেখিয়ে দিলেন। বসবাসের উপযুক্ত না ঘরটা।
কিন্তু বসবাসের জন্য ভালো। ইচ্ছে করলেই তোমরা এটাকে উপযুক্ত করে নিতে পারো। আর না চাইলে এ অবস্থায়ও চলতে পারে। কোনো অসুবিধা নেই
আব্দুর রশিদের ঘরটাকে তার নিজের মতো করে উপযুক্ত করে নিয়েছিল ক্রান্তি তার
সন্তানের জন্মের আগেই। ক্রান্তির সন্তান সুন্দর হয়েছে।
চোখ দুটোও বড়ো চাচার মতো সুন্দর। কিন্তু সে সন্তান বৃদ্ধ। মাথায় একরাশ সাদা চুল। ক্রান্তি অস্থির হয়ে উঠল চক্ষু হাসপাতালের বড়ো ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য
বড়ো চাচা তার পাকা চুলে হাত বোলালেন। পশু পদ্ধতির চিকিৎসার এটাই নিয়ম।
বৃদ্ধের সন্তান বৃদ্ধই হয়। সন্তানের পিতা নির্বাচন করেনি ক্রান্তি। সে শুধু একটা পিতৃত্ব পেয়েছে
বড়ো ডাক্তারের টেবিলের উপর বৃদ্ধ শিশুটিকে শুইয়ে রেখে বেরিয়ে এল ক্রান্তি
- আমি যাচ্ছি
- কোথায়?
- আমার পরবর্তী সন্তানের পিতা হওয়ার জন্য আমার একটা শিশু দরকার
২০০১.০১.০৮ সোমবার
..........................................................
উকুন বাছা দিন
প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।