মাহবুব লীলেন
সংকীর্ণ হৃদয় খানি
এত ভালবাসা
মিটে নাই মিটিল না
মিটিবে না আশা
পুরো বাড়ির একমাত্র অলংকার। মুক্তির সিথানের ওপরে বাঁশের বেড়ায় ঝোলানো ফ্রেমটি। পুরনো এক টুকরো সাদা কাপড়ে পুরনো শাড়ির পাড় থেকে খুলে নেয়া লাল সুতায় পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া হাতে খুব যতেœ শব্দগুলো লিখেছে মুক্তি এবড়ো-থেবড়ো করে। কোনো কবির নাম নেই। নিচের দিকে ডান কোণায় নীল সুতায় ছোট্ট করে লেখা- মুক্তি।
হয়ত মুক্তিরই নিজের লেখা পংক্তি। বিষণœতায় সব মানুষ কবি হয়ে যায়। কিংবা কবিতা ছাড়া বিষণœতা প্রকাশের বিকল্প ভাষা নেই। প্রত্যেক মানুষ যখনই নিজের নাম নীল অক্ষরে কল্পনা করে তখন সে কবি হয়ে যায়। মুক্তিও হয়ত তাই।
জীবনে প্রথম ও শেষবার নীল অক্ষরে নিজের নাম লিখে ফ্রেম করে ঝুলিয়ে রেখেছে নিঃসঙ্গ সিথানের উপরে প্রহরী দেয়ালের গায়। অনন্তকাল থেকে। অনন্ত কালের জন্য
এ ঘরে ঝোলার মতো অন্য কোনো অলংকার নেই। বেড়া থেকে বেড়ায় কাপড় রাখার দড়ি ঝোলে। মশারির খুঁট ঝোলে।
বুররাক- কাবাঘর- গণেশের ছবি- দেবী দুর্গা- যিশু- গৌতম বুদ্ধ- তাজমহল কোনো কিছু ঝোলে না এ ঘরে। শুধু একটি ফ্রেম ঝোলে। পুরনো। এবড়ো-থেবড়ো। বিশ্রী
মুক্তির বিছানাটা দুজন মানুষের।
ঘুমায় সে একা। অথচ বিছানায় সব সময় দু’জোড়া বালিশ। বাম পাশেরটা নির্দিষ্ট মুক্তির জন্য। ডান পাশের বালিশ দুটো সে সরিয়ে রাখে না কোথাও। ওখানে কাউকে শুতেও দেখেনি কেউ।
তার নিজস্ব বালিশে কোনো তোয়ালে নেই। ডান পাশের বালিশে সব সময় ফুল তোলা ঝকঝকে তোয়ালে। ওগুলোর অব্যবহৃত কভার বদলানো হয় প্রতি বছর। কিন্তু তার নিজেরটা ব্যবহারে মলিন
ডান পাশের বালিশজোড়া এভাবেই থাকে প্রতিদিন। খুব যত্নে।
মাঝে মাঝে শুধু হঠাৎ মাঝরাতে মুক্তির আলিঙ্গনে তার বুকের ভেতরে পিষ্ট হতে হতে অনর্গল অশ্র“তে ভিজে যায় বালিশজোড়া। বালিশজোড়া বেঁচে থাকে মুক্তির অশ্র“র রুমাল হয়ে। রাতে মুক্তির চোখ বন্ধ হলেই দরজা খুলে যায়। বিজয় এসে ঢোকে। সম্পূর্ণ শরীর তার আলোর তৈরি।
মুক্তির ঘর হয়ে ওঠে রুপালি প্লাবন। মুক্তি শুয়ে থাকে ভেসে যেতে যেতে আলোর বন্যায়। মশারি সরিয়ে উঠে আসে বিজয়। মুক্তির কাপড়গুলো উড়তে থাকে কবুতর হয়ে। উড়তে উড়তে উঠে যায় আকাশে।
জমে জমে মেঘ হয়ে ঢেকে রাখে বিজয়-মুক্তিকে। মুক্তি বিস্তৃত হতে হতে বিশাল ধানক্ষেত হয়ে যায়। লাঙল কাঁধে নেমে আসে বিজয়। জমির আলে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে। সেজদা করে মাঠের বিশালত্বকে।
তারপর চুমু খায়। সমস্ত শরীরে। ঘামঝরা পরিশ্রমে লাঙল চালায়। সারা মাঠে। বীজ বুনে দেয়।
ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে তাকায় মুক্তির দিকে। মুক্তির তলপেট সোনালি শস্যের ভারে স্বর্ণাভ হয়। আরো হয়। আরো। মুক্তির গর্ভ থেকে দুই যমজ ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসে রুপালি আলোয়
এবং হঠাৎ মুক্তি দেখে বিজয় নেই
রুপালি আলোহীন অন্ধকার ঘর।
ছেলেমেয়েরা বিজয়কে খোঁজে সারা ঘর। খুঁজতে খুঁজতে তারা বুঝে যায় আলোকিত মানুষ অন্ধকার ঘরে নিখোঁজ থাকতে পারে না। তারা হাত ধরাধরি করে উড়ে উড়ে বেরিয়ে যায় ঘরের বাইরে। তারা আর ফেরে না সে রাতে। ফেরে না কোনোদিন
মুক্তির ঘুম ভাঙে।
পাশের বালিশজোড়া জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। তার ব্লাউজের বোতাম খোলা। দুটো স্তন থেকে দুধ গড়িয়ে পড়ার দাগ স্পষ্ট। মুক্তি মনে করতে পারে না ব্লাউজের বোতাম বিজয় খুলেছিল নাকি সেই খুলে দিয়েছিল শিশু দুটোকে। এভাবে প্রতিদিন।
বিজয় আসে। মুক্তি গর্ভবতী হয়। যমজ দুই শিশু স্তন্যপান করে। বিজয়ের নিখোঁজ সংবাদ। এবং বিজয়কে খুঁজতে শিশু দুটি বের হয়ে যায়।
মুক্তি ঘুম ভেঙে দেখে ওর ব্লাউজের বোতাম খোলা
পঁয়তাল্লিশ বছরের মুক্তি পারেনি যুদ্ধের আগে গর্ভবতী হতে। সে চেয়েছিল তার আগে বিজয় সামলে নেবে সংসার। মুক্তি গুছিয়ে নেবে ঘর। তারপর তারা নেবে সন্তান। কিন্তু বিজয় সামলাতে পারেনি।
মুক্তি গোছাতে পারেনি। মাঝখানে ঝড় এলোমেলো করে গেছে সব। মুক্তির গর্ভবতী হবার সুযোগ হয়নি আর
সুযোগ ছিল। মুক্তি নেয়নি সে সুযোগ। প্রতি রাতে বিজয় এসে স্মরণ করিয়ে দেয় সে কথা।
সে ঘটনা। প্রতিদিন একবার সে স্মৃতিতে হাত বোলায় মুক্তি। বিজয় কি বুঝতে পেরেছিল কিছু? নইলে বাসর রাতে ওরকম কথা বলবে কেন সে? তিন বছরের প্রেমে সে ওরকম উচ্চারণ করেনি একবারও। সে বলত যারা মৃত্যুর কথা বলে তারা আত্মবিশ্বাসহীন। তবে কি বিজয় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল? নাকি সত্যিই জেনেছিল কিছু? নইলে ওমন কথা বলবে কেন?
চিৎ হয়ে শুয়ে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরেছিল মুক্তিকে বিজয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উচ্ছল বিজয় গম্ভীর হয়েছিল প্রথম ও শেষবার। মুক্তি চমকে উঠেছিল ভেতরে। তবে কি বিয়েতে অসুখী বিজয়? দুহাতে মুক্তির মুখ তুলে কপালে চুমু খায় বিজয়। নাম ধরে ডাকে। মুক্তি শোনে কোন গভীর সমুদ্র থেকে যেন তরঙ্গ হয়ে ভেসে আসে ওর নাম।
অবাক বিস্ময়ে মুক্তি গেঁথে রাখে তার চোখে বিজয়ের চোখ। বিজয় অন্ধের লাঠির মতো তাকে বুকে পিষে উচ্চারণ করে- মুক্তি একটা কথা দেবে? একটা প্রতিজ্ঞা করবে আমার সাথে?
মুক্তি বুঝতে পারে না কিসের প্রতিজ্ঞা। অপলক তাকিয়ে থাকে। সম্মোহিত বিজয় দূরাগত স্বরে উচ্চারণ করে- যদি আমরা হঠাৎ কেউ হারিয়ে যাই তবে আমরা আজীবন অন্যজনকে খুঁজে যাব। মুক্তি কথা দাও
এ কী কথা।
কী কথা এসব। পৃথিবীতে এখনতো আর নিখোঁজ হবার মতো জায়গা নেই। হারিয়ে যাবার মতো নির্বাসন নেই। তবে কেন এমন বলছে বিজয়। বিজয়কে ভয় হয় মুক্তির।
হয়ত আরো ভয়ংকর কোনো কথা বলবে বিজয়। মুক্তি এ রকম আর কিছু শুনতে চায় না আজ। মুক্তি তার মুখ বিজয়ের মুখের কাছে নিতে নিতে বলে- আমি আমাকে জানি বিজয়। আমি তোমাকে চিনি
বিজয় নির্বাক। নিজের বুকের সাথে আপ্রাণ চেপে ধরে মুক্তিকে।
মুক্তি দুলছে চিন্তা-শূন্যতায়। স্তব্ধ বিজয়। কিন্তু মুক্তি চায় না এমন দ্বীপান্তরি নীরবতা। সে চায় মুক্তি। চায় বিজয়কে।
যাকে সে চেনে
মুক্তি নেমে যায় বিজয়ের বুক থেকে পাশে। গলা জড়িয়ে ঝাঁকি দেয়- কী ভাবছ এসব। ওঠো। ...বিজয় জেগে ওঠে। মুক্তি তাকে জাগিয়ে তোলে কালাপানির বিষণ্ন ঘুম থেকে।
বিজয় আবার হয়ে ওঠে পরিচিত মানুষ। উচ্ছল। উৎসব। মুক্তির সমস্ত লজ্জা একে একে সরে যায় বিজয়ের উল্লাসে। মুক্তি হয়ে ওঠে আদিম মুক্তি।
অকৃত্রিম
এর পরদিন... তারপর... কিংবা অন্য কোনোদিন বিজয়ের কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি হয়নি সেই কথা। হয়ত সে ভুলে গেছে। অথবা নিজের প্রতিজ্ঞা নিজের ভেতর রেখে মুক্তির কথা থাকতে দিয়েছে মুক্তির ভেতরে। এমনকি শেষ যে দিন শেষবারের মতো চলে গেল সে। সেদিনও বলেনি কিছু।
শুধু মুক্তিকে বুকে জড়িয়ে বলেছিল মুক্তি আমি আসছি
তার মুখে কোনো বিষণ্নতা ছিল না সেদিন। যেন সে মুক্তির তৈজস আনতে শহরে যাচ্ছে। বিজয়ের সে সদাই মুক্তি কোনখানে কী সাজাবে তাই যেন ভাবতে ভাবতে যাচ্ছে বিজয়। মুক্তি কাঁদে। মুক্তি ধরে থাকে বিজয়ের হাত।
নিজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বিজয় বলে- তুমি কি চাও তোমার প্রথম সন্তান ক্রীতদাস হোক?
মুক্তির চোখে নির্বাক জল। তৃতীয় বিশ্বের অন্ধকার গ্রামের সহজাত উদ্ভিদ সে। তার পায়ের শেকল খুলে বন্ধ খাঁচায় ফেলে দিলে নিজেকে সে ভেবেছে মুক্ত। পায়ে শেকল পরালে কাঁদে। নির্বাক।
তার জন্য শেকল আঁচড়ে সুন্দর নখ রক্তাক্ত করার কথা জানে না সে। শেখেনি সে। বিজয় তাকে উপহার দিয়েছে কিছু নতুন শব্দ। স্বাধীনতা। কিন্তু সে জানেনি তার কাছে তার সংসার বড়ো না স্বাধীনতা বড়ো।
মুক্তি জড়িয়ে ধরে থাকে বিজয়ের শরীর। বিজয় আবার ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয় মুক্তির আলিঙ্গন। তারপর দুহাতে মুক্তির মুখ তুলে মুক্তির জীবনে দ্বিতীয়বার ও শেষবার তার কপালে চুমু খায় বিজয়। মুক্তির ঠোঁট তখন চোখে পড়ে না বিজয়ের...
তারপর বিজয়ের চিঠি আসত খামবন্দী ভালবাসা নিয়ে মুক্তির জন্য
যুদ্ধফের্তা মানুষ কেউ অক্ষত- কেউ আহত- কেউ লাশ হয়ে ফিরে ঘরে। বিজয় নেই তাদের মাঝে।
কেউ কেউ ফিরে সংবাদ হয়ে। তাদের ভিড়ের এক কোণে বিজয়ের নাম। কিন্তু বিজয় নিহত নয়। বিজয়কে বন্দী করে নিয়ে যাবার খবর। তাদের টিমের বাকিরা পালায়।
বিজয় পারে না
বিজয়কে ওরা গুলি করে মারে না। তার কাছে তারা তথ্য চায়। জোড়া জোড়া বুট- রাইফেলের বাট নেমে আসে তার ওপর। বিজয় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চিৎ করে তার কণ্ঠনালীতে একজন চেপে ধরে বুট।
বিজয়ের জিহ্বা বেরিয়ে আসে দু’ঠোঁটের ফাঁকে। আরেকজন খড়ের গাদায় আগুন জ্বালিয়ে বেয়নেট লাল করে চেপে ধরে বেরিয়ে থাকা মুমূর্ষু জিহ্বায়। ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দে লাল ধাতুর ফলা ঠান্ডা হতে থাকে বিজয়ের ভেজা জিহবায়। জান্তব যন্ত্রণায় ছটফট করে বিজয়। কিন্তু শব্দহীন।
আবার। বারবার চলতে থাকে প্রক্রিয়া। বিজয় বলে না। বলতে চায় না। তারা বিজয়কে হত্যা করে না।
করতে চায় না। আধমরা বিজয়কে ওরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় অন্য কোথাও
খবর এ পর্যন্তই শেষ
আর কোনো খবর আসে না মুক্তির কাছে। বিজয়ের মৃত্যুর কোনো খবর নেই কোথাও। মুক্তি জানে বিজয় যাবার বেলায় বলে গেছে- আসছি। বিজয় যাচ্ছি বলে যায়নি।
বিজয় ফিরে আসবে। বিজয় বেঁচে থাকবে। সে মরতে পারে না। সে আছে। শুধু ফিরে আসার পথ খুঁজে ফিরিয়ে আনতে হবে তাকে।
মুক্তি প্রতিদিন যমজ সন্তান জন্ম দিয়ে পাঠায় বিজয়কে খুঁজতে। হয়ত একদিন হঠাৎ তার সন্তানরা পেয়ে যাবে তার সন্ধান
১৯৯৩.০৩.১৪ সোমবার
............................................
উকুন বাছা দিন
প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।