মাহবুব লীলেন
রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
আন্ধেলা পুকুরে
- লালন ফকির
ধর ধর ধর...। ওই গেল। ওই সামনে। মার শালাকে মার। অসংখ্য লোক ছুটছে।
হাতে বল্লম-সড়কি-বর্শা-লাঠি। সামনে দৌড়াচ্ছে একজন। চাঁদের আলোয় ঝিলিক উঠছে তার হাতের ধারালো অস্ত্রে। দৌড়াচ্ছে। একটা ঘর।
সুড়ৎ করে ঢুকে গেল লোকটা। ধাওয়া করা মানুষেরা ঘিরে ফেলল বাড়ি। নিশ্ছিদ্র মানববন্ধন। সশস্ত্র। মাত্র এক মিনিট।
হামলে পড়ল সবাই ঘরের ভেতর। নেই। ভোজালিটা পড়ে আছে মেঝেয়। ভোজালির মালিক হাওয়া। শুধু একজনের চোখে পড়ল খড়ের চালে দ্রুত লুকিয়ে গেল একটি তাগড়া কালো মাকড়সা
দুই.
সরকার ডাকাতি করলে মানুষকে খুনি হতে হয়।
আর সরকার খুনি হলে বাঁচতে হয় ডাকাতি করে। খুনি ছাড়া ডাকাত নেই। ডাকাত ছাড়া সরকার নেই। বড়ো বড়ো ডাকাতেরা তাদের দলের নাম দেয় সরকার
মার খেতে খেতে গুরুর চোখে পড়ে সে। নিরন্ন।
আর মারতে মারতে হয়ে ওঠে প্রিয়পাত্র। ওস্তাদ। তারপর মুখস্থ করে নেয় গুরুর এই কথা বিনা তর্কে। কেউ দেখেনি তার গুরুকে। শুধু জানে প্রতিটা কাজের আগে সে তার গুরুর উদ্দেশ্যে জোড় হাত কপালে ঠেকায়।
বছরে একবার ওরস করায় গরু মেরে। লোকজন বলে মন্ত্রের সেলামি। যে মন্ত্রের জোরে বিপদে সে কালো মাকড়সা হয়ে লুকিয়ে পড়ে। আর সে বলে- ছোট মানুষের গুরু লাগে। ছোট মানুষ বুঝে উঠতে পারে না কোনটা করা ঠিক আর কোনটা ঠিক না।
গুরুরা ছোট ছোট মানুষের জন্য সাধনা করে ঠিক আর বেঠিকের ফর্দ জোগাড় করে। সেই ফর্দ যে মানুষ মান্যি করে সে আর ছোট থাকে না। দশজনে তারে বড়ো করে দেখে। আমি এক ছোট মানুষ। লোকজন বলত ছোটলোক।
তারপর গুরু আমারে বিদ্যা দেয়। সে বিদ্যা আমি মানি। আজও গুরুর অবাধ্য হইনি কোনোদিন। সে জন্য কিছু লোক আমারে মানে। কিছু লোক ডরায়।
গুরু বলত যার যত বড়ো পেট তারে ততটুকু খেতে দিবি। তারপর বাকিটা নিয়ে যাবি। কেউ তাকাবেও না। দরকার মনে করলে তোর ভাগ থেকে সিকি-আধুলি ভিক্ষা তুলে দিবি। মানুষ দয়া বড়ো বেশি পছন্দ করে।
আমি তাই করি। তাই আমাকে ধরা পড়তে হয় না। আর কিসের ধরা। ধরা খেয়েইতো আছি। গুরু বলত সবাই বান-ভাসা মানুষ।
পিতামাতার অভ্যাসের বানে ভেসে আমরা এই দুনিয়ায় আসি। তারপর যে যেখানে ঠাঁই পাই সেখানেই আটকাই। আর যারা পায় না তারা যায় সাগরের নতুন দ্বীপে। না হয় পাতালে
তিন.
গোটা বিশেক মানুষ পড়ে আছে এলোমেলো। শিশু নারী পুরুষ।
সবার মুখে হাতে পায়ে শক্ত বাঁধন। দু’দরজায় দুই বন্দুকধারির সতর্ক চোখ। বিভিন্ন ঘরে তল্লাশি দলের হাত ঘুরে একটি চাদরে জমা হতে থাকে টাকা- অলংকার- পাথর। এবার তারা ফিরে আসে এই ঘরে। লোহার সিন্দুকে।
ভাঙা যাচ্ছে না তালা। তুলে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব। বাইরে দাঁড়ানো ওস্তাদের কাছে খবর যায়। ওস্তাদ আসে। নিঃশব্দে দাঁড়ায় বুড়ো জমিদারের কাছে।
মুখের বাঁধন খুলে দেয় একজন। জমিদার গোঙাচ্ছে ভয়ে। ওস্তাদ কথা বলে- নমস্কার। বুড়ো হাউমাউ করে
- আমার শেষ সম্বল....
- শেষ বলতে নাই। কয়েক হাজার বিঘা জমি থাকল।
সিন্দুক আবার ভরবে। চাবিটা দেন
- তোমার পায়ে ধরি
ওস্তাদ ছোট্ট চাকু বের করে। তীক্ষè ধারালো মাথা। চেপে ধরে জমিদারের কপালে। চাপ দেয়।
মোচড়ায়। জমিদার চিৎকার দিতে গিয়ে গোঙায়। ওস্তাদের হাতে চাপ বাড়ে। কপালের চামড়া ভেদ করে খুলিতে ডাবতে থাকে চাকু। রক্ত গড়ায় মুখে।
বুড়ো অনড়। ভোরের অপেক্ষা। ভোর মানে আশীর্বাদ। ওস্তাদ চাকু তুলে আনে। চেপে ধরে বাম চোখের ওপর।
কোটর ঘেঁষে। ডাবতে থাকে। ডাবে- আপনার চোখ খুলব। বলেন
- জানি না
হাত বাঁকিয়ে হেঁচকা টান। উপড়ে আসে পৃথিবীর গোল।
লাল
ওস্তাদ তাকায় অন্যপাশে। একটি কিশোরী। গুটিসুটি। আঙুল তুলে দেখায়- কে?
বাম চোখ হারানো- কপালে অতিরিক্ত চোখসহ তিন চোখের জমিদার এক চোখে তাকায়- আ...আমার মেয়ে
দুজন তুলে আনে তাকে ওস্তাদের ইশারায়। একজন টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় শাড়ির চামড়া
- দোহাই তোমাদের
- চাবিটা কোথায়?
- জানি না।
দোহাই
বুকের জামা ছিঁড়ে যায়
- দোহাই ভগবানের
- চাবিটা
- তোমরা আমার ভাই
আবার হস্তক্ষেপ। নগ্ন বাইনমাছ মোচড়ায় বালির চড়ায়
- এ আমার মেয়ে। তোর মেয়ে
- চাবি
- তুই আমার ছেলের মতো। বাবা দোহাই তোর
ওস্তাদ সরে যায় একপাশে। আদিম কারো বল্লমে বিঁধে যায় পাখি।
মুখ বাঁধা কিশোরীর আর্ত চিৎকার। চিৎকার রক্তাক্ত জমিদারের। - বলছি বলছি। ওকে ছাড়ো। বলছি।
সিন্দুকের পেছনে গুপ্ত কুঠরি...
লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান জমিদার। কিশোরী মুক্তি পায় ওস্তাদের আরেক ইশারায়। ততক্ষণে তার সন্ধিতে লাল স্রোত। ওস্তাদের চোখ গাঁথে মানুষের জন্মপথে। কপালে হাত ঠেকিয়ে আকাশে তাকায়- তুমি সবই দেখেছ গুরু।
শেষ দিনে তুমি সাক্ষী দিও। এই কুত্তার বাচ্চা বাপ হয়েছে। মানুষ হতে পারেনি গুরু। তারপর অজ্ঞান জমিদারের দিকে ঘুরে যায় সাঁই করে। ওস্তাদের হাতে ভোজালি।
সপাসপ কোপ পড়ে জমিদারের দেহে। আলগা মাথাটা গড়াতে থাকে বিহবল তিনটি বিচিত্র চোখসহ
বেরিয়ে গেছে সবাই। ওস্তাদ ফিরে আসে। হাতে রাইফেল। ঝুঁকে পড়ে কিশোরীর অর্ধমৃত মুখে- মা রে অভিশাপ দিস না।
এই করে খাই। মানুষের কলিজায় হাত না দিলে মানুষ টাকা ছাড়ে না। কিন্তু তোর বাপটা মানুষ না। মা রে এরপরে তুই বাঁচতে পারবি না। মরার থেকে মরা হয়ে বাঁচতে হবে তোর।
মাপ করিস মা। গুরু তুমি সাক্ষী দিও। ...দ্রিম দ্রিম। কিশোরীর নগ্ন বুকে বুলেটের গভীর চিহ্ন। হাতের বাঁধন খুলে দেয় ওস্তাদ।
পা খোলে। নিবর্ঁাধ হয় নির্বাক মুখ। শাড়ি কুড়িয়ে ঢেকে দেয় নগ্ন নিশ্চল দেহ
চার.
কোনখানে ফাঁক রয়ে গেছে গুরু। এত করেও মেলে না হিসেব। মাটি ডাকাতিই বড়ো ডাকাতি গুরু।
মাটি থাকলে আপনাতেই সিন্দুক ভরে ওঠে নারী- অলংকার আর ক্ষমতায়। মানুষেরা মাথা নামিয়ে দেয় জুতায়। মাটি-মালিকেরাই দেবতা হয়। দেবতা থেকে ঈশ্বর। এইযে রাণী মা।
নাচোলের দেবতা বনে গেলেন হঠাৎ। তার মাটি ছিল। শখ হলো। বিলিয়ে দিলেন। হয়ে গেলেন দেবতা
পানিতে ডুবতে ডুবতে মানুষ খোঁজে মাটি।
দেবতার মূর্তি বানাতে খোঁজে মাটি। মৃত্যুর পরে চায় মাটি। টাকা পয়সায় ডুবিয়ে দিলেও মানুষ দুদিন পরে আর সালাম দেয় না গুরু। কারণ তিনদিন পর অর্ধেকটা যায় তার পেটে আর পোশাকে। বাকি অর্ধেকটা হয় হারিয়ে ফেলে নয় দেয় বিলিয়ে।
আর এক ছটাক মাটি দিলে আগলে রাখে চৌদ্দ পুরুষ। মানুষ সব ভুলে যায় মাটি ভোলে না গুরু। বানভাসি মানুষ মাটি চায় গুরু। গুরু সব হিসেব বুঝিয়ে দিলা মাটির হিসেব কেন দিলা না গুরু
আর এই লোকগুলো। কী চায় এরা।
কমিউনিস্টরা? সে বোঝে না। কেন তারা তার পিছু লেগেছে। তাকে কেন টানতে চায়। তোরা যা করার কর। আমিতো আটকাচ্ছি না তোদের।
আমাকে ওসব শুনিয়ে কী লাভ। আমি আছি আমার মতো। দেশ-জাতি দিয়ে আমার কী হবে। পেটের চিন্তায় যার পিঠে ঘা খেতে হয় তার কিসের দেশ? কী জাতি? আসোলে ওদেরকে সহ্য করতে পারে না সে। একেকটা সরকার।
বিষদাঁত লুকিয়ে রাখা গোখরা। ডাকাত। মানুষের মাথা ডাকাতি করে। রাক্ষস। মানুষ খেতে চায়।
আমিতো গুরুকে অমান্য করি না। পেট বুঝে খেতে দেই। ওরা উপুস রাখবে। অনাহারী মানুষের মগজে নাস্তা করবে ওরা। সব কথা সে বোঝে না।
এইটুকু বোঝে- এরা খুন চায়। লক্ষ লক্ষ খুন। নির্বিচারে। হয়ত তাকেও। সব সাপ ব্যাঙ খেলেও কিছু সাপ অন্য সাপকেও খায়।
কিছু খুনি খুন করতে চায় অন্য খুনিকে। কিছু ডাকাত ডাকাতি করতে চায় অন্য ডাকাতকে। এরা তাই
পাঁচ.
দৌড়। সাপের মুখ থেকে ব্যাঙের দৌড়। হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।
পেছনে অনেক লোক। সামনে মাঠ। একটা ঘর দরকার। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ভোজালিটা ছাড়া আর কিছু নেই।
রাইফেলটা ফেলে এসেছে। অবশ্য গুলিও শেষ। তাও ভালো। ওটাই আজ বাঁচিয়ে দিয়েছে দলের বাকিদের। লোকগুলোকে সে একাই ঠেকিয়েছিল রাইফেল হাতে।
যখনই বাকিরা নিরাপদে পেরিয়ে গেছে নদী। সে দৌড়েছে উল্টো। দৌড়াচ্ছে। পাওয়া গেছে। ওইতো... ওইতো ঘর...
লোকগুলো এসে গেছে প্রায় কাছে।
কেউ একজন চিৎকার করল- ঘরে ঢুকতে দিবি না। ঢুকলেই পালাবে। ...আরে আরে ঢুকে যাচ্ছে। গেল... সব গেল। পালাল
- আগুন লাগাও আগুন।
পেছন থেকে চিৎকার
ফস্ করে কেউ কাঠি জ্বালায়। দপ করে জ্বলে ওঠে খড়ের চাল। হইচই করে বেরিয়ে আসে ঘরের বাসিন্দারা। আর কেউ না। আর কোনো শব্দ নেই।
চাঁদনি রাতে ছাই হয়ে থুবড়ে পড়ে ঘর। কুঁড়েঘরের বাঁশবেত জ্বলে শেষ হয়ে গেলে ছাইয়ের স্তুপে দেখা যায় একটা ভোজালি জ্বলছে টকটকে লাল হয়ে। নিঃশব্দ। আর পরদিন থেকে সবার চোখে শক্ত বর্শার খুঁটি গেঁথে মাকড়সার আট পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে ‘মাকড়া বাজার’। ইউনিয়ন মীর্জাপুর।
থানা মিঠাপুকুর। রংপুর। বাংলাদেশ
১৯৯৭.০৪.১৭-২০ বিষুদবার- রোববার
......................
উকুন বাছা দিন
প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।