মাহবুব লীলেন
তুই কি আমার প্রেমে পড়েছিস?
দেড় দিনে প্রসঙ্গের বাইরে এই প্রথম কিছু একটা জিজ্ঞেস করল সে। সমুদ্রের খোলা বাতাসে তার চুল আলতো উড়ছে। পায়ে ভেঙে পড়ছে ঢেউ। মাথাটা একদিকে কাৎ করে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে নীলা আপা। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে তার নীরবতা দেখছি আমি।
এই নীরবতাই তার সবচে অনন্য। কিন্তু কোনোদিনও ভাবিনি সাগরে এসে এরকম একটা আত্মবিশ্লেষণে সে আমাকে ফেলে দেবে
তার সাথে আমার দীর্ঘদিনের নীরবতা উদযাপন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি মুখোমুখি। একটা কথাও বলিনি। মাঝে মাঝে চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে হেসেছি কেউ।
খোলা দীর্ঘ চুলে ঢেকে থাকে তার মুখ। শরীর। দীর্ঘ অনেকটা দিন কেটেছে আমাদের এরকম সকাল থেকে সন্ধ্যা। বেলা শেষ হয়ে এলে এবার উঠি বলা ছাড়া কিছুই বলা হয়নি আমাদের। হঠাৎ নীলা’পা বলল- চল সাগরে ঘুরে আসি
রাস্তায় চলন্ত বাসে সারারাত আমার কোলে শুয়েছিল সে।
ঘুমায়নি। তার উজ্জ্বল বিষণœতা নিয়ে সে জেগেছিল চুপচাপ। আমার দিকে তাকিয়ে। তার গাল ঢেকে গিয়েছিল চুলে। আমি আলতো করে সরিয়ে দিয়েছি
- কিছু বলবি?
- চুলের জন্য তোমার মুখ দেখা যায় না
- চুল বাঁধব?
- না।
তাহলে তোমাকে অন্যরকম লাগে
নীলা’পা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়েছিল...। আর কোনো শব্দ নেই। শুধু তার চুড়ি আর দুল নিয়ে সারা পথ আমার খেলা করার ছোট ছোট আওয়াজ
চুল বাঁধলে তাকে কেমন যেন লাগে। এ জন্য সে আমার সামনে চুল বাঁধে না কোনোদিন। আমার জন্য কাচের চুড়ি পরে সে।
একবার খেলতে খেলতে চুড়ি ভেঙে ওর হাত কেটে গিয়েছিল। তার ফর্সা হাতে দাগটা এখনো সুস্পষ্ট। প্রায়ই দাগটার দিকে তাকিয়ে হাসে নীলা’পা- সব পাগলামিরই কিছু না কিছু দাগ থেকে যায়
নীলা’পা এখনো তাকিয়ে আছে- আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি না?
- আমি জানি না
- আজ যদি বেশি কথা বলি তুই মাইন্ড করবি?
- কথা বললে তোমাকে অন্য রকম লাগে
- সাগর সবাইকে অন্যরকম করে দেয়। এ জন্যই সাগরে এলাম
- আগে জানলে আমি আসতাম না
- এইতো সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সূর্য ডুবে গেলে আবার আগের মতো হয়ে যাব।
...অনেকগুলো নতুন চুড়ি এনেছি। ফিরে গিয়ে পরব। ...সম্ভবত তুই আমার প্রেমে পড়েছিস
- না
- তুই অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলিস না
- মেয়েদের আমার ভাল্লাগে না
- আমাকেও না?
- তুমি ছাড়া
- আমিতো একটা মেয়ে
- তুমি আলাদা
নীলা’পা সাগরে এসে বদলে গেছে। এ তার সম্পূর্ণ এক অন্য রূপ। নীরবতা ভেঙে চঞ্চল হয়ে উঠেছে নীলা আপা।
এক অচেনা আলোয় জ্বলছে তার চোখ- তুমি... তুমি মেয়ে নও নীলা’পা। ...তুমি আলাদা। অন্য রকম
সেই অদ্ভুত নিঃশব্দ হাসিটি হাসল সে। আলতো করে চাপ দিলো আমার হাতে- একুশ বছর বয়সে তোর অনেক কিছুই বোঝা উচিৎ
- সাগরে এসে তুমি বদলে গেছ। আমার ভাল্লাগছে না
- তুই বদলাবি না কোনোদিন?
- আমি জানি না।
কিন্তু তুমি বদলাতে পারবে না
- যদি বদলে যাই?
- নীলা’পা তোমাকে বিশ্রী দেখাচ্ছে। তুমি কথা বলো না
- চল সূর্যাস্ত দেখি
সে আবার আগের মানুষ হয়ে গেল। উজ্জ্বল বিষণ্ন। নীরব। হালকা হাওয়ায় উড়ছে তার চুল।
একটা হাত আমার হাতের মুঠোয়। শিরশিরে শীতে ঘন হয়ে বসেছি আমরা। সূর্য ডুবছে। ক্রমশ আবছা হচ্ছে নীলা’পার মুখ। অপূর্ব হয়ে উঠছে সে।
আমি আস্তে করে এক গোছা চুল এনে ছড়িয়ে দিলাম তার মুখে। নীলা’পা হাসল- তুই বড়ো বেশি তোর মতো রে...। আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম- নীলা’পা... সূর্য ডুবছে...
সূর্যাস্তের অনেক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকলাম আমরা। হোটেলে ফিরে তাকে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসালাম। লেপ টেনে পা ঢেকে দিয়ে আমার ব্যাগ খুলে তার জন্য নিয়ে আসা লাল চাদরটা পরিয়ে দিলাম তাকে
- এ পর্যন্ত আমার লাল চাদর কতটা হলো বলতে পারিস?
- আমি হিসেবে কাঁচা
- কিন্তু এ্যাবসল্যুট
- আমরা সাগর থেকে চলে এসেছি।
তুমি আর অন্যরকম হতে পারো না
- চুড়ি পরব না?
- এখন না। এখন আমি তোমাকে সামনে থেকে দেখব
উল্টোদিকের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে লেপে পা ঢেকে বসলাম আমি। নীলা’পা হাসল- আমার জন্য সুন্দর দেখে একটা খাঁচা বানিয়ে ফ্যাল
- তোমার জন্য আমি আয়না বানাব
আর কোনো কথা নেই। অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকলাম আমরা। সামনা-সামনি
- নীলা’পা তুমি বিয়ে করো না কেন?
- কেন?
- তোমার বয়স আটাশ হলো
- তুই কি চাস আমি বিয়ে করি?
- না
- তবে?
- তবুও
- সাগরে এসে তুইও বদলে গেছিস?
- তোমার পরিবর্তন আমাকে কীরকম যেন করে দিয়েছে
- বিয়ে করলেতো আমাকে আর এভাবে দেখতে পারবি না।
... আমার বিয়ে হলে তুই কী করবি?
- আমি তোমার বিয়ে হতে দেবো না
সে হাসল। আরো অনেক্ষণ কেটে গেল চুপচাপ। নীলা’পা কথা বলল- এভাবে আর কতদিন আমাকে দেখবি?
- জানি না
- আমাকে অন্যভাবে দেখতে চাস?
- কীভাবে?
- প্রকাশিত?
- দেখেছি
- কখন?
- যখন তুমি সামনে থাকো না। তখন আমি তোমাকে সব ভাবেই দেখি
- ছুঁয়ে দেখেছিস?
- হ্যাঁ
- তখনও আমাকে নারী মনে হয়নি?
- জানি না। আমি কোনো নারীকে চিনি না
- আজকে তোকে সামনা-সামনি দেখাব
নীলা’পা লাল চাদরটা সরিয়ে নিল।
ধীরে ধীরে তার শরীর থেকে সরে গেল সব। স...ব। খুলে ফেলল গলার চেইন- কানের দুল। তার শরীরে সামান্য যে আড়াল থাকল তা শুধুই ওর দীর্ঘ চুলের। নীলা’পা উঠে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল মেঝেতে- দেখছিস?
- এভাবে তোমাকে অনেকদিন দেখেছি আমি
আমিও উঠলাম।
ওর নতুন চুড়িগুলো পরিয়ে দিলাম। গলার চেইন। কানের দুল। ...নীলা’পা হাসল- ছুঁয়ে দেখবি না?
- দেখেছি
- জড়িয়ে দেখেছিস?
- অনেকবার
লাল চাদরটা কুড়িয়ে নিয়ে ওকে ঢেকে দিলাম। ...নীলা’পা শীত লাগছে?
- হ্যাঁ।
আমাকে জড়িয়ে ধর
জড়িয়ে তাকে নিয়ে বিছানায় এলাম। লাল চাদরের নিচে শুধু অলংকার পরা নীলা আপা। আমার হাতে বাজছে তার চুড়ির টুংটাং- নীলা’পা তুমি বিয়ে করো না। বিয়ে করলে তোমাকে প্রতিদিন খুব দ্রুত প্রকাশিত হতে হবে
- এই রাতে আমার প্রকাশকে মহান করতে চাস তুই?
- তোমার আড়ালটাই মহান। প্রকাশিত হলে অন্যরা মহান হতে পারে।
তুমি নও। প্রকাশিত হলে তুমি অসুন্দর হয়ে যাও
নীলা’পা আমার হাতে টান দিলো- আমার বুক একবার ছুঁয়ে দিবি না?
- হাতে নয়
ওর বুকে আমার মুখ নামিয়ে দিলাম আমি। নীলা’পা আমার মুখ চেপে রাখল তার বুকে
- তুমি কি আমার প্রেমে পড়েছ?
- তুই আমার সাত বছরের ছোট
- আমি ছোট শিশু নই
- তুই চাস আমি তোর প্রেমে পড়ি?
- না
- তবে?
- আজ হঠাৎ আমাকে তোমার শরীর খুলে দিয়ে তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছ?
- আমার নিজের বিশ্বাসকে প্রমাণ করছি
নীলা’পা আরো নিবিড় করে আমাকে জড়িয়ে ধরল বুকে
- তুই কি এখনো আমাকে দেখছিস?
- দেখছি
- তোর চোখ আমার বুকে চাপা
- আমি তোমাকে দেখছি নীলা’পা
- কী দেখছিস?
- পাঁচ বছর আগে তোমাকে প্রথম বার দেখার মতো। খোলা চুল। সাদা জামা।
হালকা শীতে একটা লাল চাদর জড়ানো। হাতে এক গোছা কাচের চুড়ি- মাথাটা একপাশে কাৎ করে তুমি হাসছ। আলতো করে আমাকে জিজ্ঞেস করলে- কী নাম তোমার?
- তুই কি আমাকে ওভাবেই দেখবি সারা জীবন?
- দেখব
- যদি আমি বদলে যাই তবুও?
- হ্যাঁ
- দেখিস। আমাকে ওভাবেই দেখিস তুই
অনেক্ষণ কোনো কথা বলল না নীলা আপা। আমাকে আবার চেপে ধরল বুকে- তোকে সাগরে নিয়ে এসেছি একটা কথা বলতে
- বলো নীলা’পা
- অনীক আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি...
২০০১.০১.১০ বুধবার
............................................
উকুন বাছা দিন
প্রকাশক- শুদ্ধস্বর।
প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।