আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিষ্প্রাণ মাটিতে প্রাণ গড়ার বিশ্বকর্মা...

জীবন একটাই; জীবনের জয় অনিবার্য..

ওরা শিল্পী। আমাদের সবার মত হাত-পা-নাক-পেট ওয়ালা মানুষও ওরা। এদের হাতেই কাদামাটি, পানি, খড় আর রঙের আচড়ে তিলে তিলে জন্ম নেয় একেকটি প্রাণ। অনন্ত প্রতীক্ষায় এদের শ্রমে ঘামে প্রতিষ্ঠা পায় একেকটি মুর্তি। নিষ্প্রাণ মাটিতে প্রাণ গড়ে তবেই হাসি ফুটে ওদের মুখে।

জীবন জীবিকার তাগিদে এটাই ওদের পেশা; এটাই ওদের নেশা। একতাল মাটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় তাদের সে কি প্রাণিপাত! চাই অখন্ড মনোযোগ আর প্রখর দৃষ্টি। চাই সাধনার সবটুকুকে উজার করে দিতে পারার দক্ষতা। আরো চাই কায়োমন বাক্যে একজন সদা পরিপূর্ণ সৃষ্টিশীল মানুষের শিল্পী মন। তবেই সম্ভব একজন মুর্তি গড়ার যোগ্য মানুষ হওয়া।

ওরাই নিষ্প্রাণ মাটিতে প্রাণ গড়ার বিশ্বকর্মা! সমকালের ‘প্রিয় চট্টগ্রামের’ পক্ষ থেকে গত ২২ সেপ্টেম্বর গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের হাজারীগলিতে দুর্গা প্রতিমা বানানোর কারখানায়। পুজার বাকি আছে আর মাত্র ১৫ দিন; মুর্তির গায়ে এখনো লাগেনি বাহারি রঙ। খড়ের উপর মাটির নিপুন কাজে চলছে মুর্তি গড়ার পালা। হাজারীগলিতে এ কারখানার স্বত্তাধিকারী দেশের বিখ্যাত মুর্তি কারিগর জীবন পালের মুখোমুখি হলাম আমরা। আমাদের শুনতে হল একজন শিল্পীর মুখে তার অভিজ্ঞতা, আনন্দ আর কষ্টের কথা।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের মনে দাগ কাটলো কেবল শিল্পীর কষ্টটুকুই। জীবন পালের মুর্তি প্রতিবারের মত এবারো যাচ্ছে চট্টেশ্বরী, রাজাপুর রেইন, হাজীবাজার আর খোদ হাজারীগলির পুজা মন্ডপে। যাচ্ছে নোয়াখালির পথেও। কাজ করছেন সহকর্মী আট জনকে নিয়ে। এবছর তিনি গড়ছেন ২৫টি মূর্তি।

সবচেয়ে বড়, চোখ ধাঁধানো আর জাঁকালো মুর্তিটি এবারও হাজারী গলি পুজা মন্ডপের জন্য। এবারের হাজারীগলি পুজা মন্ডপে পাওয়া যাবে জঙ্গলের আদিমতার আভা। তাই দুর্গাও দেবীও নাকি দেখতে হবে অনেকটা ‘জংলি’! তিনি জানালেন, আশ্বিনের এই মূর্তির জন্য কাজ শুরু করতে হয় সেই বৈশাখ থেকেই। তার মাটির যোগানদাতা স্বয়ং কর্ণফুলি নদীর তীর। ‘বাবু আমাদের মিস্ত্রিদের চারআনাও দাম নাই।

এত কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর আছে বলে মনে হয় না। অথচ অধিবাসের দিন মুর্তি নিয়ে গেলেই আর আমাদের প্রয়োজন পড়ে না কারো’, বললেন ক্ষোভ মিশিয়ে। এক ঘন্টার আলাপচারিতায় বুঝলাম এটি তার মনের গোপন ব্যাথা। যে ব্যাথা তিনি সয়ে আসছেন গত ৬০ বছর ধরে। বাহারি পোশাক আর স্বাদে গন্ধে পুষ্টিকর মন্ডা-মিঠাই নিয়ে আমরা সকলে যখন সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আর বিজয়া দশমী পালন করি তখন এদের জীবনে ঘটে না কোন আলাদা বৈচিত্র্য।

ভিড় ঠেলে, পায়ে দলে জনতা হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে মুর্তি দেখে বলে ‘ওমুক বাড়ির মুর্তিটা জব্বর হইছে’। হয়তো পাশেই শুনে আছে সেই কারখানার একজন শ্রমিক যার হাতে গড়া মুর্তিই আজ প্রশংসার দাবীদার। স্বার্থবাদী নাগরিক মনে একবারও ধরা দেয় না একতাল মাটিতে প্রাণ দেয়া বিশ্বকর্মা মহাশয় কোথায়? না; চারদিনের একদিনের জন্যও তাদের জন্য থাকে না কোন বিশেষ অনুষ্ঠান। জীবন পাল বললেন, ‘গতবার মিশরীয় আদলে তৈরি আমার হাজারী গলির প্রতিমা চট্টগ্রামের সেরা হিসেবে পুরষ্কার পেয়েছিল। অথচ সেই পুরষ্কারটি গেল পুজা কমিটির ঘরে।

আমি তখন কেউ না। ’ বংশ পরম্পরায় ঠাকুরদার কাছে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন এই জীবন পাল। চার ভাই আর তিন ছেলেরা প্রত্যেকেই আজ এই পেশায়। না; পেশা নয় নেশা বলাই উত্তম। কারণ এ পেশায় সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা আর প্রতিপত্তির বহর ছাড়াই দু’মুঠো অন্ন দিয়েই রোচে শুধু এদের জীবন।

কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই এরা কোন অংশে বিশ্বকর্মার চেয়ে কম নয়। কিন্তু দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিদ্যা শিখতেই আমাদের চলে যায় পাঁচ-ছয়টি বছর। এদের জন্য প্রশিক্ষণ আর আলাদা হল রুমের বরাদ্দ করা গেলে এ শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এর মধ্য দিয়েই হয়তো মাটি দিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর এই মাটির মানুষগুলো একটু স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দ লাভ করবে। এবারের শরতে এই হলো বিশ্বকর্মাদের প্রত্যাশা।

কোন শরতে? শরৎ কি তাই, যখন কাশফুলের সারি দেখলেই মনে পড়ে সত্যজিতের পথের পাঁচালীর কথা? শরৎ কি তাই, যখন বাতাস চঞ্চল, চিত্ত চঞ্চল আর ধরণীও ব্যাকুল হয়? শরৎ কি তাই, বোধনের দিনে জয়ঢাকের বাদ্যে যখন কোনো প্রেমের আবেগ কাছের মানুষের দিকে আরেকটু তাকাতে বলে? তা যদি হয়, তবে শরৎ এখন বিরাজমান। শরৎ এসেছে প্রকৃতিতে, মানুষের মনে, পুজার মণ্ডপে আর অবশ্যই বাংলা পঞ্জিকায়। তবে অনেকদিন হলো শরৎ আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনছে না। রোগ-শোক-জরা-ব্যাধির কূপে আটকা পড়েছে যেন শরৎ। তাই এ নাগরিক জীবনে কাশফুল নেই, এ ঋতুর আগমনী সংকেত জানবে কিভাবে লক্ষ নাগরিক প্রাণ? এখানে ইট কাঠ কংক্রিটের দালানে শরৎ এসে কোন ফাঁকে চলে যায় টেরটি পাওয়াও মুশকিল।

মেঠোপথের সাদাকালো ধুলোর সেই অপু আর দুর্গাই বা কই যে সারাদিনমান সমস্ত বাধন টুটে ছুটবে? তবুও শরৎ এসেছে; বাজবে ঢাক আর নাকে লাগবে পোড়া ধূপের গন্ধ। আর বীরেন্দ্র চট্টপোধ্যায় এর কথায় নিষ্প্রাণ মাটিতে প্রাণ গড়ার বিশ^কর্মাদের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় ‘তার ঘর পুড়ে গেছে অকাল অনলে/তার মন ভেসে গেছে প্রলয়ের জলে/তবু সে এখনো মুখ দেখে চমকায়/এখনো সে মাটি পেলে প্রতিমা বানায়। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।