অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
পরাজিত মানুষের মুখ দেখি, মানুষের পরাজয় আনন্দময় কোনো দৃশ্য নয়। কোনো আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় না আদতে, কাংক্ষিত পরিণতি না পেলেও প্রতিটা আন্দোলনেরই একটা প্রভাব জনমানসে রয়ে যায়। সেখান থেকেই নতুন সূচনা হয়।
আন্দোলন কাংক্ষিত পরিণতিতে পৌঁছানোর পথ একটাই, সামগ্রীক সংশ্লিষ্ঠতা। এবং এই সংশ্লিষ্ঠতা ঘটতে হয়ু ব্যপক পরিসরে।
জাহাঙ্গীরনগরে যৌননিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা এবং অভিযুক্ত শিক্ষক সানোয়ারের অভিসংশনের আন্দোলন সফল হয় না কিন্তু একই শিক্ষাঙ্গনে মাত্র ১ দিনের মানববন্ধন শেষে নিরীহ ৪০০ গাছ পাখীদের নিরাপদ আশ্রয় আর আমাদের পরিবেশ সচেতনতার উদাহরণ হিসেবে বেঁচে যায়।
মানুষের জন্য গাছপালা প্রয়োজন, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ তবে গাছ আর পাখিদের নিরাপদ আবাসনের জন্য আহূত আন্দোলন যে মুহূর্তে সফল হয় সেই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাঙ্গনের দাবীর আন্দোলন সফল পরিণতি পায় না, এই দৃশ্যটা কুৎসিত।
অবশ্য আন্দোলনের দাবীর প্রতি আকাত্মতা বোধ করা কিংবা না করা অনেকাংশেই আন্দোলনের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। কতটুকু পরিসরে এই আন্দোলন দানা বাঁধবে তাও নির্ধারণ করে সেই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত মানুষদের গ্রহনযোগ্যতা। নৈতিকতার প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্নটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের।
মানবীয় শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে লোকগাঁথায় রয়েছে ইউনিকর্ণ, এক শিঙ্গে ঘোড়া, পৃথিবীর অমল শুদ্ধতার প্রতীক ইউনিকর্ণ। তাকে দেখবার সাধনা করে শুদ্ধ মানুষ, আমরা কবিদের শুদ্ধতা দাবি করি, তবে কবিরাই যখন নিজস্ব শুদ্ধতার দাবিকে নাকচ করে মূলত মৌনতা চান, নির্বাসন চান তখন আমাদের তাদের এই ব্যক্তিগত চাওয়াকেও সম্মান করতে হয়।
আন্দোলনের উদ্দেশ্যকেও প্রশ্ন করা যায়, মূলত সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিগণের সম্মিলিত চরিত্রও মানুষের সন্দেহবাতিকতাকে উস্কে দেয়, সেখানেই মানুষ বিচ্ছিন্ন বোধ করে। মূলত জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলনে সেই গণসম্পৃক্ততা তেমনভাবে নেই।
এটা নাট্যতত্ত্ব নামক একটা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব সমস্যা- মূলত এই জায়গাতে এসেই আন্দোলন মুখ থুবরে পড়ে, একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বাইরে এর প্রভাব তেমন থাকে না অবশেষে।
প্রথম আলোতে মোহাম্মদ রফিক যখন যৌন নিপীড়ন বিষয়ে নিজস্ব অবস্থান প্রকাশ করেন সেখানেও এই বিচ্ছিন্নতা দেখতে পাই। "যৌন নিপীড়ন" শিরোণামের উল্টো কমার খপ্পরে আটকে পড়া অবরুদ্ধ ভাবনার প্রকাশ হয়েছে সেটি।
তার আন্দোলনকুণ্ঠা, তার সম্পৃক্ত হতে না চাওয়ার স্বাধীনতাটুকু সম্মান করে বলতে চাই তার বক্তব্য বিশেষত সাম্প্রতিক সানোয়ার বিষয়ে চলমান অস্থিরতা, তার জানালার কাঁচ ভেদ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বেয়ারা উৎপাতের মতো ঢুকে পড়া শব্দাবলী তাকে আন্দোলন সম্পৃক্ত করে না। যারা এই আন্দোলনে নেই তারা নিপীড়কের বন্ধু এই বিশেষণ তাকে আক্রান্ত করে। যারা চলমান আন্দোলনের কাতারে দাড়াচ্ছে না তারা পীড়ক।
এই সিদ্ধান্ত তাকে আহত করে। তিনি শুদ্ধতাবাদী মানুষ, তিনি নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থীদের ভর্তি এবং শিক্ষকদের নিয়োগ বিষয়ে অনৈতিকতা পছন্দ করে না না, এমন নি তার সুশীল কর্ণে নাট্যতত্ত্বের দুই একজন ছাত্রের মিনতির খবর পৌঁছালেও তিনি এ বিষয়ে নিস্পৃহ থাকেন, তিনি কথিত শিক্ষার্থী নিপীড়নের বিষয়ে খবরাখবর সংগ্রহ করেন নি।
জাগতিক ময়লা তিনি গায়ে মাখবেন না, যৌন নিপীড়নে মৌন সম্মতি দিয়ে তিনি ঘোষনা করেন জাহাঙ্গীরনগরে যৌন নিপীড়নের কবর রচিত হোক সরকারের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে, সংলাপের সুশীলিয় বাস্তবতা উপেক্ষা না করেই তিনি যখন বল ঠেলাঠেলি করে অন্য কোর্টে পাঠিয়ে দেন তখনও তার শুদ্ধতা কলুষিত হয় না।
মূলত মোহাম্মদ রফিকের লেখাটাই অনেকাংশে বলে দেয় কেনো আন্দোলনের দাবীর যথার্থতা থাকলেও সেটা ব্যপক পরিসরে দানা বাধলো না। আন্দোলনে মিছিলে দাঁড়ানো সবগুলো মানুষ হয়তো এই আন্দোলনের দাবিকে নিজের ভেতরে ধারণ করেছেন তবে সাধারণ মানুষেরা যারা পাশে থেকে সমর্থন জানান, তারা নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ানোতে ভুমিকা রাখেন তাদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয় এই সচেতনতা।
মূলত বল শেষ পর্যন্ত পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোর্টে, তারা একটা খসরা নীতিমালা তৈরির সংবাদ দিয়ে আশ্বস্ত করেছেন আমাদের। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শুধুমাত্র একটা প্রস্তাব দিতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা বাস্তবায়িত হবে না যদি বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট এটাকে অনুমোদন না দেয়।
এখানেই মূলত সমস্ত আন্দোলন স্থবির হয়ে যায়, সিনেটকে যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা মানতে বাধ্য করবে কারা? কিভাবে এই বাধ্যবাধকতা জন্ম নিবে? ভেতর থেকেই এই দাবি উঠতে হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়, এবং এটার জন্য আদতে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্ঠতাই কাম্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা অনেকাংশেই শিক্ষকের অনুকম্পাভাজন, শিক্ষকের অনুগ্রহের উপরে অনেক কিছুই নির্ভর করে, অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকে, নম্বর এবং গ্রেড প্রদানে শিক্ষকের মর্জির উপরে নির্ভর করে থাকা শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা তেমন নেই।
এমন ভারসাম্যহীনতা নিপীড়নের পথ খুলে দেয়।
একই সাথে শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতির দলাদলি, বিভিন্ন ছোটো ছোটো গোত্র এবং উপগোত্রে বিভাজিত হয়ে রাজনৈতিক দলের ছাতা ধরে আন্দোলনে আঁচ থেক শরীর বাঁচানো শিক্ষার্থীরাও ভবিষ্যত ভাবনায় কিংবা অর্থনৈতিক ভাবনায় আচ্ছন্ন থেকেই আন্দোলন এবং অস্থিরতা বিরোধি অবস্থান গ্রহন করেন।
যুথবদ্ধতা যখন প্রয়োজন তখন অনেক বেশী বিচ্ছিন্নতা দেখি। নিজেকে প্রশ্ন করি আদতে আমার পক্ষ কি। আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি আমার পক্ষ বর্তমানের নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রনয়নের পক্ষেই। তবে সবাই কি এটার প্রয়োজনীয়তা এবং যথার্থতা উপলব্ধি করে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।