লক্ষ করুন আমি তওবার সাথে সমার্থক শব্দ হিসাবে ফিরে আসা কে ব্যবহার করেছি। আসলে তওবা এমন একটি শব্দ যা অনেক সময় আমাদেরকে বিকর্ষন করে। আমরা এটাকে কঠিন ধর্মীয় বিষয় মনে করি এবং ভাবি –আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা যাবে..। কিন্তু ধর্ম বর্ণ নির্বেশেষে, আমি মনে করি তওবা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি বলবেন, সেটা কেমন, তওবা তো মুসলমানদের জন্য।
না, আসলে তওবা মানে হচ্ছে নিজের ভুল স্বীকার করে সৃষ্টিকর্তার কাছে মাফ চাওয়া। এবং এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। আমরা তো প্রতিনিয়ত আমাদের চলার পথে নানারকম ভুল করে থাকি । মানুষ মাত্রেই ভুল করে। এবং সেই ভুলের কারনে সে ভুক্তভোগী হয় কিন্তু নিজেই ।
আমাদের প্রতিটা ভুলেরই একটা সাধারন প্রতিক্রিয়া হয় আমাদের মধ্যে। আমরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের কোন ভুল স্বীকার করতে চাই না। যে কোন একটা ভুলের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিক্রিয়া কি হয়?
: আমরা আমাদের সেই ভুলকে স্বীকারই করি না।
: ভুলকে স্বীকার করলেও সেটাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি ।
: ভুলকে স্বীকার করি কিন্তু সেজন্য অনুতপ্ত হবার প্রয়োজন মনে করি না।
আমরা আমাদের যে ভুলগুলোর কথা বলছি তা সাধারন মানবীয় ভুল নয় । সাধারনত যা অপরাধ বা যা আমার জন্য করা মানুষ হিসাবে যুক্তিযুক্ত নয় সেগুলোর কথা বলছি। আপনি বাজারে গিয়ে একটা জিনিস কিনতে ভুলে গেলেন – এটা কোন অপরাধ নয় । কিন্তু আপনি একজন লোকের সাথে উদ্ধত আচরন করলেন, কিংবা আপনি কারো টাকা মেরে দিলেন বা আপনি কাউকে জেনেশুনে ঠকালেন এটা অপরাধ। এবং এই সকল অপরাধের জন্য আমাদের ক্ষমা চাইতে হয়।
মানুষ এই ধরনের অপরাধ করবে এটা সৃষ্টিকর্তা জানেন । এবং এজন্যেই তিনি মানুষের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা বা তওবা করার বিধান রেখেছেন। কেন মানুষকে তওবা করতে হবে বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে? কারন, মানুষ তার সামগ্রিক বিকাশ ও সুন্দরভাবে পৃথিবীতে বিচরন করার জন্য যে মূল চরিত্র বা ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, ভুল বা অপরাধ করার মাধ্যমে সে তার সেই চরিত্রে বা ক্ষমতায় বাধার সৃষ্টি করে। ফলে তার কর্মক্ষমতা এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, যেটা মানুষ বুঝতে পারে না। তখন তার সেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে অনুতপ্ত হতে হয় বা তওবা করতে হয়।
ধরুন আপনি পা পিছলে কাদা পানির মধ্যে পরে গেলেন, সমস্ত গায়ে আপনার কাদা ময়লা লেগে একাকার । এখন এ অবস্থায় কি আপনি আপনার কাজে যেতে পারবেন? না, আপনাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। না হলে আপনি আপনার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন না। একজন মানুষ অপরাধ করার মাধ্যমে আসলে নিজেকে এভাবেই কলুষিত করে ফেলে। যে যত্ক্ষন তওবা বা অনুতপ্ত না হয় , ততক্ষন সে এই অদৃশ্য ময়লা মেখে অবস্থান করতে থাকে ।
এটাই বাস্তবতা। একজন মানুষ যিনি ভুল করেন এবং অপরাধ করেন তিনি কখনোই ভেতর থেকে স্বাভাবিক থাকতে পারেন না, বাইরে যতই ফিটফাট থাকুন না কেন। এখানেই ফিরে আসার প্রশ্ন। তওবা করুন , ভুল স্বীকার করুন এবং ফিরে আসুন। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে ভুল স্বীকার বা তওবা কার কাছে? আমরা অপরাধ করি দুইভাবে:
১।
সৃষ্টির ক্ষতি করার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে ।
২। মানুষের সাথে সরাসরি অপরাধ ।
উভয় ক্ষেত্রেই সৃষ্টিকর্তার কাছে তো অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। তবে আরেকটি কথা আছে।
আপনি যার সাথে অপরাধ করেছেন, তার কাছেও আপনাকে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে । এটা তওবা করার একটা আপাত কঠিন দিক যা মানুষ সাধারনত করতে চায় না বা করতে পারে না । তবে এই অভ্যাস মানুষের জন্য একটা পরম ক্ষমতায় রূপান্তরিত হতে পারে। আর একটা সত্য হল যে মানুষ এভাবে ক্ষমা চাইতে পারে এবং তওবা করতে পারে , তার ভুলের পরিমান স্বাভাবিকভাবেই কমে যেতে থাকে ।
এখন এই তওবা করা বা ফিরে আসার মাধ্যমে আমরা কি অর্জন করতে পারি?
১।
প্রথমত বিশুদ্ধ ব্যক্তিত্ব। একজন অপরাধী আর একজন নিরপরাধী কি সমান?
২। আমরা জীবনযাত্রায় আমাদের ভুলের পরিমান ক্রমশ কমাতে পারি।
৩। আমাদের মেধার বিকাশ হবে স্বত:স্ফুর্ত ।
কারন মেধার বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা আমাদের ভুল বা অপরাধ।
৪। অপরাধ স্বীকার করার মাধ্যমে আমরা পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারি । এভাবে যে সম্পর্ক ভেঙে গেছে তাও জোড়া লাগানো সম্ভব।
৫।
আমরা যারা আধ্যাত্মিকভাবে নিজেদেরকে অগ্রসর করতে চাই তাদের জন্য তওবা একটা অবশ্য পালনীয় ব্যাপার।
আর প্রথমেই বলেছিলাম তওবা মানে ফিরে আসা। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে তওবার মাধ্যমে আমরা নিজেদের কাছে নিজেরাই ফিরে আসি । আমরা ফিরে আসতে পারি আমাদের মূল সত্ত্বার কাছে। আমাদের মূল শক্তির কাছে।
পবিত্র কোরানে আল্লাহতাআলা বলেছেন :
--যারা মন্দ কর্ম করে, এবং পরে অনুতপ্ত হয়, আর বিশ্বাস করে তবে ইহার পরে নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা পরম ক্ষমাশীল , করুনাময় । -- সূরা আল আরাফ:১৫৩
আসলে যতবারই ভুল করেন না কেন, যত বড় ভুলই করেন না কেন , প্রতিবার তওবা করুন। প্রতিবার ভুল স্বীকার করুন , প্রতিবার ফিরে আসুন আপন স্বকীয়তায়। দেখবেন আপনার জীবন একটা আনন্দময় অভিযাত্রায় পরিণত হয়েছে। আর এজন্যে প্রয়োজন শুধুমাত্র আপনার ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা।
আসুন রমজান মাসে আমরা আমাদের অতীতের সকল ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকি এবং আমাদের ভবিষ্যতকে আলোকময় করে তুলি । ক্ষমা চাওয়া কিন্তু রমজান মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয় , তবে এই মাস উপলক্ষে আমরা শুরু করতে পারি ।
ধন্যবাদ । আগামীকাল আবার দেখা হবে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।