munirshamim@gmail.com
প্রথম কিস্তির পর..........
ধর্ষক-নিপীড়কের ফলিত কাব্য
নারীর অবস্থা, অবস্থান এবং তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মর্যদাকে খাটো করার এ 'ধর্ষকামী অভিধান' শুধু মাত্র ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও হরহামেশা ব্যবহার করা হয়। প্রতিদ্বন্ধী দল/গ্রুপকে হেয় করার মোক্ষম অস্ত্রটি থেকে শ্রেণী ও ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থানকারী নারীরাও বাদ যান না। শুধু লিঙ্গভিত্তিক মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান প্রান্তে বলে। ফলে নিপীড়ক পুরুষ বা তার সহযোগীরা নিম্ববিত্ত, মধ্যব্ত্তি বা উচ্চব্ত্তি মানে যে বিত্তে অবস্থান করেন না কেন 'নিপীড়নের শব্দগুচ্ছ' তারা অবলীলায় ব্যবহার করেন নারীর বিরুদ্ধে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
চট্রগ্রামে শিবির-ছাত্র দল সংঘষের ঘটনা ঘটে। সে সময় বেগম খালেদা জিয়া প্রধান মন্ত্রী। শিবির প্রতিবাদ মিছিল বের করে এবং মিছিল থেকে যে শ্লোগানগুলো উচ্চারিত হচ্ছিল তার মধ্যে একটি ছিল-ক্যান্টেনম্যান্টের পামেলা, আর করিস না ঝামেলা'। এই যে প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য একজন নারী রাজনীতিবিদকে 'পামেলা'র সাথে তুলনা করা তার ভেতরের অন্তর্নিহিত সূরটি আবশ্যম্ভাবীভাবে যৌনতা কেন্দ্রীক। এবং সে অভিধান/অস্ত্র দিয়েই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা।
এ চেষ্টায় ধর্ষকামিতার মনজাগতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোটাকে অস্বীকার করা যায় না। একই সাথে শেখ হাসিনা সহ অন্যান্য নারী নেত্রীদের ব্যাপারেও এ শব্দগুলোর ব্যবহার হতে দেখি। এমনকি জনপ্রিয় অভিনেত্রী সূবর্ণা মোস্তফার বিয়ের সংবাদ পরিবেশনেও একাধিক ব্লগে এ ধর্ষকামী কাব্যসমগ্র পরিবেশনের প্রবণতা স্পষ্ট ছিল। ঢাবির শামসুন নাহার হলে পুলিশী নিপীড়নের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, তাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তখন তৎকালীন ভিসি আ, চৌও একই ভাষায় কথা বলেছেন। অভিভাবক হয়ে আপন ছাত্রীদের 'গার্মেন্সের মেয়ে' (শুধু রেফারেন্স এর জন্য ব্যবহার করেছি, গার্মেন্সের সংগ্রামী কর্মীদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা রেখে) বলে গালি দিয়ে অভিভাবক হিসেবে নিজের পদ, ঢাবির সুনাম এবং গার্মেন্স শিল্পে কর্মরত সংগ্রামী নারীদেরও অপমানিত করার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছিলেন।
ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্তদের জন্য নিপীড়ন কারীদের এ ভাষার রাজনীতিটাও বোঝা এবং বিবেচনায় রাখা জরুরি।
অধিপতি গোষ্ঠীর যুথবদ্ধ ভূমিকার ধারাবাহিকতা.....
আমি অধিপতি শ্রেণীর পরিবর্তে 'অধিপতি গোষ্ঠী' ব্যবহার করেছি। খুউব সচেতন ভাবে। কারণ ধর্ষক-নিপীড়ক এবং তাদের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী যে অধিপতি গোষ্ঠীটির কথা বলছি অর্থনৈতিক বিচারে একই শ্রেণীতে অবস্থান করে না। ভিন্ন শ্রেণী থেকে তাদের অংশগ্রহণ।
তবুও লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্যে রয়েছে কলংকিত যুথবদ্ধতা। জাবি সহ সারা দেশে দানাবেঁধে ওঠা বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলন থমকে যাওয়া অথবা প্রত্যাশিত ফলাফল বয়ে আনতে না পারার পেছনে অধিপতি গোষ্ঠীর এ কলংকিত যুথবদ্ধতা ক্রিয়াশীল থেকেছে এবং এখনও আছে। কীভাবে?
জাবির ঘটনায় (বর্তমান ও অতীত) ব্যাপক অর্থে শিক্ষক সমাজের অংশগ্রহণ আমরা দেখি না। না জাবিতে না অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচসেকল আন্দোলন-সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অংশগ্রহণের সোনারি গৌরব রয়েছে।
তারপরও কেন তারা নিরতার সংস্কৃতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত। জাবিতে এবারে যখন আন্দোলন একটু একটু করে জেগে উঠছিল তখন পেশাগত কারণে আমার জাবির দু'জন শিক্ষকের সাথে কথা হয়েছিল। আমি দু'জনকেই একই প্রশ্ন এবং পরিস্থিতি জানতে চেয়েছি। দু'জনের মধ্যে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। একজন বলেছেন, ভদ্রলোক সংসার জীবনে বেশ সূখী।
সুতরাং এটি হতে পারে না। আমি বললাম, বাঙালী পুরুষের একাধিক সম্পর্কে 'উপগত'/পতিত হওয়ার পরও ব্যক্তিজীবনে 'সতী-সাধবী-সূখী স্ত্রী' থাকার উদাহরণতো কম নয়। তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। এইযে উড়িয়ে দেয়া অথবা নিরবতার সংস্কৃতিতে নিমজ্জন তার শেকড়টা গোষ্ঠী চেতনা থেকে উৎসারিত। সুতরাং ব্যক্তি জীবনে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের 'কন্যা-জায়া-জননী'র প্রতি যত্নশীল হলেও ঘরের বাইরের নিপড়ীত নারীরা তাদের গোষ্ঠীবদ্ধ নয়।
(আমি নিশ্চিত এ কন্যা-জায়া-জননীজনিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেঞ্চুরিয়ান মানিকও তার পরিবারের কারও মর্যাদাহানী হলে রুখে দাঁড়াবে, আবার রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে ধর্ষকামিতার চর্চা অব্যাহত রাখবে) আর গোষ্ঠীবদ্ধ নয় বলেই তারা নিজেদের গোষ্ঠীর 'জাত্যাভিমান' ও স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনযোগী। সে মনযোগিতার কারণে মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, পেশাজীবি সংগঠন আন্দোলনে নামে না। এ কারণে আমরা ছাত্রলীগকে চুপ থাকতে দেখি। ছাত্র দলকে চুপ থাকতে দেখি। এমন কি প্রধান দু'নেত্রীকেও।
কারণ তারা এ ঘটনাগুলো পাঠ করেন নারী হিসেবে নয়, নিজস্ব গোষ্ঠীগত অবস্থান থেকে। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং গোষ্ঠী স্বার্থটাই প্রধান বিবেচ্য। এবং দু:খজনক হলেও সত্য যে, রাজনৈতিক গোষ্ঠীগত চেতনাবোধের কারণে বেশির ভাগ সময় নারী শিক্ষার্থীরা/নারী রাজনৈতিক কর্মীরা এ নীপিড়নগুলোকে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সন্ত্রাস হিসেবে পাঠ করতে ব্যর্থ হয়। বদলে দেখে ছাত্রলীগ-ছাত্র দল কোন্দল হিসেবে (উদাহরণ, ঢাবিতে ছাত্রীদের ওড়না কেড়ে নেয়ার ঘটনা অথবা ইয়াসমীনের সময়কার আন্দোলনের ফসল আ'লীগ এর ঘরে তোলার চেষ্টা এবং সীমা চৌধুরীর সময় চুপ থাকা)। এ গোষ্ঠীবদ্ধ কলংকিত যুথবদ্ধতার ধারাবাহিকতার কারণেই ছানোয়ার হোসেনকে কখনও শিক্ষক, কখনো রাজনৈতিক কর্মী/নেতা বা মাকিকগঞ্জের ছেলে হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় নিপীড়কের চেহারা......সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক ও গোষ্ঠীগত এ যুথবদ্ধতার কলংকিত ধারাবাহিকতাকে ভেঙ্গে, 'নিপীড়ক আর নিপীড়িত' এ সরল মেরুকরণটা প্রতিষ্ঠিত করে একটি বৃহত্তর যথবদ্ধতার সোনালি ও বেগবান উদাহরণ তৈরি করা খুব জরুরি। একটি সুন্দর আগামীর জন্য। কারণ এ ক্যাম্পাস, এ দেশ নিপীড়কের নয়। এটি আমাদের....সকলের (এ 'সকলে'র মধ্যে নিপীড়ক-ধর্ষক ও তাদের সহযোগীদের কোন জায়গা নেই)।
(দু:খিত, পোস্টটি বেশ বড় হয়ে গেল বলে।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।