আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাবি'র ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, ধর্ষক-নিপীড়কের ফলিত কাব্য এবং অধিপতি গোষ্ঠীর যুথবদ্ধ ভূমিকার কলংকিত ধারাবাহিকতা

munirshamim@gmail.com

ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন অভিযুক্ত শিক্ষক ছানোয়ার হোসেনকে সিন্ডিকেট কর্তৃক দায়মুক্তি ঘোষনার আপাতত দৃশ্যে নিয়ে যারা ধরে নিয়েছেন জাবি'র ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে এবং এ ভাবনায় খুশিতে আটখানা হয়ে যারা 'বগল বাজানো'র কাজে লিপ্ত হয়েছেন তাদের দাবি ও বিশ্বাসটাকে শুরুতে বাতিল করেই আলোচনাটা শুরু করতে চাই। কারণ আমি কিছুতেই মনে করি না এটি এ আন্দোলনের ব্যর্থতা বা পরাজয়। বরং আর সমস্ত ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিক উৎক্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ের মতো এটিও এ আন্দোলনের একটি ধাপ। যে ধাপটি এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা সংযোজনে ক্রিয়াশীল। সিন্ডিকেট এর সিদ্ধান্ত প্রকাশ পরবর্তী সময়ের ধারাবাহিক ঘটনা-প্রবাহ থেকে আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে এ রকম আশাবাদী হতে চাই।

এটা ঠিক যে, পিতা-অভিভাবক-শুভাকাঙ্খী এবং বন্ধুর সমতূল্য শিক্ষকের হাতে নিপীড়িত হয়ে যে শিক্ষার্থী/শিক্ষার্থীবৃন্দ এর প্রতিকার চেয়েছেন, ন্যায় বিচার প্রত্যশা করেছেন এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ভয় ও নিপীড়নমুক্ত ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায় তথাকথিত সামাজিক প্রথা ও বিশ্বাসের বাইরে এসে 'আমি নিপীড়িত হয়েছি' বলে সক্রিয় আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, তার যে আবেগ, তার যে মনবেদনা, তার হৃদয়ের প্রতিনিয়ত অদৃশ্য রক্তক্ষরণ এর কষ্টকে বিবেচনায় আনলে এ আন্দোলন আপাতত সফল এ রকম বলার সুযোগ একেবারে নেই। কারণ সিন্ডিকেট এর সিদ্ধান্ত তাদের অনেক বেশি দগ্ধ করেছে, আতংকিত করেছে। ন্যায় বিচার প্রাপ্তির প্রত্যাশাটা কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি প্রত্যাশিত বিচার পাওয়া গেলেও যে শিক্ষার্থী 'পিতা-অভিভাবক-শুভাকাঙ্খী এবং বন্ধুতূল্য' শিক্ষক দ্বারা নিপীড়ন-হয়রানির শিকার হয়েছেন তার মনজাগতিক ক্ষতটা এ জীবদ্দশায়তো শুকোবার নয়। কোন দিন না।

এ সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়েই জাবি'র ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলনের সফলতানিয়ে আলোকপাত করতে চাই। এ আলোকপাতের উদ্দেশ্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ আন্দোলনের ধাপে ধাপে সক্রিয় থাকা জাবির বীর শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। নিজে ব্যক্তিগতভাবে জাবি'র শিক্ষার্থী না হওয়ার পরও ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলন সৃষ্টি ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যে উদাহরণ তুলে ধরেছে এ বীর ক্যাম্পাস তাতে এ ক্যাম্পাস এর সাথে নিজের যুক্ততার কথা ভাবতেই গৌরববোধ করি বেশি। পুলিশ বাহিনী কর্তৃক ইয়াসমীন ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা পরবর্তী দিনাজপুর সহ সারা দেশে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, সে একটি উদাহরণ বাদদিলে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী কার্যক্রমের মূলস্রোত ধারা জাহাঙ্গীর নগর ক্যাম্পাস থেকেই পরিচালিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে, চলার ধাপে ধাপে নারীর নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা এবং আশংকার ইতিহাস সমজ-সভ্যতার মতো পূরণো হলেও মুলধারার ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এ ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠেনি।

ওঠতে পারেনি। এ উঠতে না পারার অন্যতম কারণ-ধর্ষণ নিপীড়নের ঘটনাকে সব সময় 'পাবলিক' নয়, 'প্রাইভেট' বিষয় হিসেবে পাঠ করা হয়েছে। এ প্রাইভেট বিষয়টি নারীর তথা কথিত সম্মান (প্রকৃত পক্ষে অসম্মান বটে), পরিবার ও কমিউনিটির মর্যাদার অংশ হিসেবে দেখার প্রবণতায় কেউ এগিয়ে আসেনি। এ রকম বন্দীত্বের দশা থেকে মূলধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন হিসেবে যুক্ত করার কৃতত্ত্বটা আমি সবিনিময়ে গত একদশকে নিয়োজিত জাবির এ সকল শিক্ষার্থী এবং সীমিতভাবে শিক্ষকদের দিতে চাই। সুতরাং তাদের প্রতি আমার আবারও বিনীত শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা..................................।

জাবি'র সিন্ডিকেট এর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে, আন্দোলনকারীদের প্রতি একাত্মতাও সহমর্মিতা প্রকাশ করে এবং আন্দোলনে সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে কযেকটি পোস্ট এ ব্লগেও ছাড়া হয়েছে। এই যে ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান 'মোবিলাইজেশন' তা শুধু সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে জাবির শিক্ষার্থীরা এক দশক আগে ঐতিহাসিকভাবে একটি প্রান্তিক (এ প্রান্তিকতা নিঃসনন্দেহে দুঃখজনক এবং ভৎসনাযোগ্য) বিষয় কে মূলস্রোতধারায় নিয়ে আসার সাহসী উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। ব্লগারদের মধ্যে যারা পোস্ট দিয়েছেন, পক্ষে মন্তব্য করেছেন তাদের একটি বড় অংশের পুরুষ হওয়াকেও আমাদের সাংস্কৃতিক কাঠামোর দিক থেকে আমি একটি গুণগত পরিবর্তন বলতে চাই। যদিও এ আন্দোলন নারী বা পুরুষের বিষয় নয়, হওয়া উচিতও নয়। বরং এ আন্দোলন হচ্ছে ধর্ষক-নিপীড়কের বিরুদ্ধে।

সুতরাং শুভ বুদ্ধির সকল মানুষেরই এ আন্দোলনের কাতারে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শামিল হওয়ার কথা। কিন্তু শামিল হয় নি। এ না হওয়ার কারণটা যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করবো শেষ অংশে। তবে ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরুধী আন্দোলন যে আরও একটি নতুন পর্যায় ও নতুন মাত্রার দিকে এগুচ্ছে এ ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করার কোন অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। ধর্ষক-নিপীড়কের ফলিত কাব্য একটা কৈফিয়ত দিয়ে শুরু করি।

এ আলোচনাটাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কিছু অপ্রত্যাশিত শব্দ ও বাক্য উদৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে হতে পারে। শুধু আলোচনার মূল চেতনাটাকে ধরিয়ে দেবার জন্য। আমি আশা করি পাঠক-শুভাকাঙ্খী ভুল না বুঝে বিষয়টিকে সে রকম অবস্থান থেকে দেখবেন। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, বিগত দিনগুলোতে যখনই ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, অথবা কেউ তার প্রতিকার চেয়েছে তখনই ধর্ষক-নিপীড়ক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে একই ধরনের প্রাথমিক হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়েছে। আর সেটি হচ্ছে অভিযোগকারী/দের 'চরিত্রহনন'।

এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যগুলো প্রায় এক। মনে হবে একই কবির রচিত 'ধর্ষণ কাব্য'। যেমন, জাবি'র সিন্ডিকেট এর সিদ্ধান্ত প্রকাশের পরপরই একটি পোস্ট এ ব্লগে ছাপা হয়। আলোচ্য ব্লগার (আমি ইচ্ছে করেই নামটি ব্যবহার করলাম না) আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে যে সব গুণবাচক (নেতিবাচক অর্থে) শব্দ ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে অন্যতম 'স্ব-ঘোষিত লিভ টুগোদার-ও গ্রুপ সেক্সে বিশ্বাসী, সেশন জটের অনুঘটক, অনশনের রাতগুলোতে শহীদ মিনার অপবিত্রকারী, গাজা সেবক, ওড়না ব্যবহার করে না ( এ বর্ণনাটি আরও কুরুচিকর ছিল, ঈষৎ সম্পাদিত), ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিই যৌনতা কেন্দ্রীক সামাজিক স্খলনের সাথে সম্পর্কিত।

এ ধরনের আন্দোলন-লড়াইয়ে ধর্ষণ-নিপীড়নের এ ফলিত কাব্যটা ব্যবহার করা হয় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার তাগিদে। আন্দোলনকারীদের মনে একটি মনস্তাত্ত্বি প্রেসার সৃষ্টির বাসনায়। আমি নিশ্চিত এ শব্দগুলো ব্যবহারের সময় সংশ্লিষ্ট ধর্ষক-নিপীড়ক গোষ্ঠী এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে। যা তাদের মনজাগতিক ধর্ষকামিতাকে ফুটিয়ে তোলে।

কিন্তু সাধারণ জনগণ যেহেতু যৌনতাকেন্দ্রীক দৃশ্যমান শব্দগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়ে সেহেতু ধর্ষক-নিপীড়কদের এ ধর্ষকামিতার রাজনীতিটা পাঠ করতে ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ধর্ষক-নিপীড়ক মূলত এ সুযোগটা কাজে লাগাতে চায়। এবং লাগায়ও। দিনাজপুরের ইয়াসমীনের ঘটনার পর পুলিশও এ ধরনের ধর্ষণ-কাব্য ব্যবহার করেছে।

পুলিশের 'পতিত' হওয়ার বিষয়টিকে ঢাকতে ইয়াসমীনকে 'পতিতা' (আমি দুঃখিত এ শব্দটি ব্যবহারের জন্য) বানাবার চেষ্টা করেছে। এ প্রবণতা আমরা সীমা চৌধুরীর সময় দেখেছি। এখন জাবিতেও দেখছি। গতকাল রাজপথ_থেকে_বলছি নামের ব্লগার নুশেরা, খোমেনী ইহসান ও মাহবুব মোর্শেদ এর পোস্টে যে মন্তব্যগুলো করেছে (এতটা অশ্লীল যে একাডেমিক আলোচনার স্বার্থেও ব্যবহার করতে রুচিতে বাধলো) সেটি শারীরিক নিড়ীড়ন থেকে কোন অংশে কম নয়। প্রমাণ হিসেবে তিনি নিপীড়নের ছবিও দেখারও দাবি করেছেন।

ধর্ষকামী মনজাগতিক কাঠমোর চুড়ান্ত পর্যায় ছাড়া একে আর কি বলা যায়। (একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বাকী অংশটা একটু পরে লিখছি....)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.