আমি পার্থিব বাস্তবতায় অস্থির, অপার্থিব স্বপ্নপায়ী কেউ একজন . . .
মেঘঢাকা আকাশটার তুমুল ধমকগুলো তোয়াক্কা করে না এ অঞ্চলের মানুষগুলো। যেখানে আশে-পাশের শহরগুলো বড়-সড় তান্ডবের ভয়ে এরমধ্যই প্রার্থনা যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে সেখানে এই শহরের মানুষেরা বাতাসের ঠান্ডা স্পর্শের আদরটা নিতে ব্যাতিব্যস্ত!
রাস্তা দিয়ে মাথা ঢেকে, নিজেকে বেশ লুকিয়ে এক মধ্যবয়স্ক লোক তার বাইশ-তেইশ এর মেয়েটাকে নিয়ে বেশ তাড়াহুড়োয় পা ফেলছে। মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎটার ভীষন আক্রোশে আকাশটাকে ছিড়ে টুকরো করে ফেলায় ঝলকানিতে হঠাৎ হঠাৎ লোকটার কাঁচা-পাকা চুল আর সতর্ক চোখটা দেখা যাচ্ছিল.. আর তার হালকা অথচ ঠান্ডা গলায় বলে যাওয়া কথাগুলোও বেশ খেয়াল করলে বোঝা যাচ্ছিল,,,"শোন্ বন্যা! একটা কথা খেয়াল রাখবি, এমন সেবা করবি যাতে মা খুশি থাকেন। মা আমাদের আঁধার আলিঙ্গন করেন। তাঁকে যে যাই বলুক, তাঁর জন্যই তোর মুক্তি মিললো এটা মনে রাখিস।
আজ ঝড়ের রাতটায় আমরা কেন এত নিশ্চিন্ত তা বুঝিস? মা-র জন্যই। " মেয়েটা বাবার কথায় বারবার শ্রদ্ধা আর আনুগত্যে মাথা ঝাকায়, আলোর হালকা ঝলক আর বাজের ধমকে মেয়েটার কৃতজ্ঞতায় উথলে ওঠা কান্নাটা ঢেকে যায়।
--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
ঠিক এই সময় নির্ঝর মা'র কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখছিল আর শুভ্রতা আর বিশুদ্ধতার গল্প শুনছিল। নির্ঝরের তেরো হলো এ বছরের এমন এক এই ঝড়ের রাতেই। মায়াবীর বন্ধ চোখটার ওপর হাত রাখে নির্ঝর, "মা, আজকের ঝড়টা কেনো রেগে আছে?" মায়াবী হালকা হেসে বলে, "মানুষের অপকর্ম আর কলুষতার প্রতিবাদ করে প্রকৃতি।
সেজন্য ঝড়ের রাগ। তুই বুঝতে শিখলে দেখতি, কেমন ধমক দিয়ে যাচ্ছে ঝড় হুমহাম করে। " নির্ঝড় বলে, "মা, তুমি এখন কি করছো ?" মায়াবী আঙ্গুল তুলে ফিসফিসিয়ে বলে, "শশশশ!...কথা বলি ঝড়ের সাথে। শান্ত না হলে হয়তো পাপটাকে আলিঙ্গন করতে হবে আমাকেই। " নির্ঝর কুন্ডলী পাকিয়ে মার ভেতর ঢুকে যায়, মায়াবী চোখ বন্ধ করেই নির্ঝরকে জড়িয়ে রাখে হাত দিয়ে।
মেয়েটাকেই তার পর চক্র রক্ষা করতে হবে। রাতের সাথে সাথে শরীরের থরথর বাড়ে মায়াবীর। আকাশের সবটুকু কালোরাগ আর পৃথিবীর কলুষতাকে একটা সময় মায়াবী আলিঙ্গন করে তার ভেতরের অপরিসীম শুভ্রতা দিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই আকাশের ধমক কমে যায়, বাতাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। মায়াবীর ঘরের সামনে ভোর না হতেই মধ্য ফুল আর আশির্বাদের স্তুপ জমে যায়।
এরই মধ্য বেশ রাতে মায়াবীর দরজার সামনে এসে বন্যা আর তার বাবা দেখে আকাশ চিড়ে আসা একটা বিদ্যুত প্রচন্ড আক্রোশে মায়াবীর নড়বড়ে বাড়িটার উপর এসে আছড়ে পড়েছে... কিন্তু ওটা তো আক্রোশ না! হঠাৎ চক্রের মতো নিবিঢ়ভাবে মায়াবীকে আবেগে জড়িয়ে ধরলো বাজের আঁকা-বাঁকা বাহুগুলো! আর তার পর-পরই আকাশের কঠিন শাষণ থেমে গেলো ভোঁজবাজির মতো! বন্যা কেঁপে উঠেছিল আর তার বাবাও তার হাত ধরে পড়িমড়ি উল্টো রাস্তায় ছুটেছিল বেশ ক্ষিপ্র পায়ে।
--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
নির্ঝরকে জড়িয়ে মায়াবী মাঝে মাঝেই তাদের চক্রের গল্প শোনায়। ... "মা শোন, পৃথিবীতে মানুষ সব কিছুর প্রতিকার বের করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের কালো সময়গুলোর প্রতিকার বের করতে পারে নি। মানুষ রোগের কালোত্ব দূর করতে ডাক্তারের কাছে যায়, অশিক্ষার অন্ধকার দূর করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়, অপবিত্রতা দূর করতে ধর্মশালায় যায় কিন্তু মনের কালোত্ব দূর করার জন্য কোথায় যাবে তা খুঁজে পায় না।
সেই সময়টার প্রতিকারেই আমাদের চক্রের শুরু। আমরা মানুষ বা প্রকৃতির কালোত্ব আলিঙ্গন করি। যতদিন আমরা নিজেরা শুদ্ধ থাকবো ততদিন আমরা এই অন্ধকার আলিঙ্গন করতে পারবো। মানুষের আশির্বাদ আর ভালবাসা থেকে শুদ্ধতা পাওয়া যায়। এই শুদ্ধতাটা ভেতরে নিতে হয়।
মা মন দিয়ে শোন, আমার পর তোর ভেতর ক্ষমতা যাবে চক্রের হিসাবমতে। আমি তোকে ঠিক সেভাবেই তৈরী করেছি। মনটাকে ভোরের আকাশের পরিধির চে'ও বড় আর শুভ্র রাখতে হবে মা। নাহলে কালোকে জড়াতে পারবি না। একটা সময় এই কালো সময়গুলাও তোকে পাগলের মতো ভালবাসবে।
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি!" মা'র সপ্নিল চোখ দেখে ভেতরে কেমন শিহরণ পায় নির্ঝর!!!
--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
এরপরের বেশ কিছু বছর পর মায়াবী মারা যায়। রাজকীয়ভাবেই ওর শেষকৃত্য হয়। ওর কবরের কাছে গেলে প্রায়-ই নির্ঝরকে দেখা যায়। কবরটার পাশে এক অদ্ভুত গাছ দেখা যায়। কুচকুচে কাল ডাল-পালা, গাঢ় নীল পাতা আর ধবধবে সাদা গুড়ো গুড়ো ফুলের গাছটা মায়াবীকে ঢেকে রাখে প্রবল মমতায়।
নির্ঝর জানে কালো হচ্ছে শোক বা অন্ধকারের, নীল ব্যথার আর সাদা পবিত্রতার রং। নির্ঝর তার শরীরটা কুন্ডলী পাকিয়ে গাছের সাথে মিশিয়ে রাখে। ঠিক এভাবেই মায়াবী-ও ওর বাবার কবরের পাশের গাছটায় ডুবে থাকতো!
চক্র কিন্তু নিরন্তর চলতে থাকে এক যুগ থেকে অন্যযুগে তার নিজের কক্ষপথে... কালোত্ব আর শুভ্রতার আলিঙ্গনে ||
...................................................................................................
____________________________________________
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।