আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেকনোলজি কর্পোরেট শোষণের হাতিয়ার

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি

চাকা আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে এক হ্যাঁচকা টানে উন্নতির হাইওয়েতে এনে বসিয়েছে এ নিয়ে এখন আর বিতর্ক নেই। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার সবাই মানব কল্যাণে এটা শাসকদের বোলচাল। আবিষ্কার হয়তো কল্যাণকর, কিন্তু তা কতোটা মানবসভ্যতার জন্য, সেটা নির্ভর করে আবিষ্কারের সুফল-কুফল বণ্টন করার দায়িত্ব কাদের হাতে তাদের শ্রেণী চরিত্রের ওপর। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী মুলত সামন্তবাদী ধ্যানধারণার ধারক বলে তাদের হাতে যে বিজ্ঞান বা টেকনোলজিই পড়ুক না কেন তার প্রয়োগ নিত্যই শোষণমূলক। কল্যাণমূলক কদাপি।

আমরা এখন আর বিজ্ঞান বিজ্ঞান করি না। এই জমানার প্রিয় শব্দ টেকনোলজি। আরো খোলাসা বললে ' আইটি'। অর্থাৎ ইনফরমেশন এন্ড টেকনোলজি। আমাদের টেকনোলজি ঢেঁকিতে ধান ভানা বন্ধ করে দিয়েছে।

বৈঠা-লগি প্রায় তুলে দিয়েছে। এখন আর ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে কলুবাড়ির গরুটা ঘানি টানে না। এখন আর নবধূ নাইওর যাওয়ার সময় নৌকার ছইয়ের ফাঁক দিয়ে বিদায় জানায় না। বাস বা রিকশা-ভ্যান এখন বাহন। এখন আর অতিপরিচিত ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে জল খাবারের আশায় দাওয়ায় বসে থাকে না।

মাইলের পর মাইল হাঁটা ক্লান্ত পথিক বটবৃক্ষতলে বিশ্রামের জন্য বসে না। ধুলো উড়িয়ে বাসগুলো বটতলা অতিক্রম করে। এ সকল ক্ষেত্রে বাঙালির টেকনোলজি তার সহজিয়া নষ্টালজিয়া কেড়ে নিয়েছে। বদলে দিয়েছে খানিকটা আধুনিকতা। খানিকটা টেকনোলজি।

খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য। ব্যাস। কিন্তু তার জীবনে এই টেকনোলজি বা তথ্যপ্রবাহ শোষণের যে মাত্রা বহাল করেছে তা যদি সে ঘুণাক্ষরেও টের পেতো তাহলে জীবন দিয়ে হলেও এই টেকনোলজি প্রতিহত করতে চাইতো। ঢাকার মতো তথাকথিত মেট্রোপলিটন শহরের মধ্যবিত্তদের বেজায় ক্ষোভ। কেন তারা সস্তায় পণ্যসামগ্রী পাচ্ছে না? খবর পড়ছে, খবর দেখছে, খবর গিলছে, যে অমুক মোকামে টম্যাটো দু টাকা কেজি বিকোচ্ছে না।

রাশি রাশি পথের ধারে পড়ে আছে। ক্ষোভে-দুঃখে উৎপাদক ঝাঁকা সমেত ফেলে দিচ্ছে! অথচ ঢাকায় তা অগ্নিমূল্যে কিনতে হচ্ছে! মধ্যবিত্তরা কোনোভাবে এই হিসাব মেলাতে পারছে না। ভাড়াটে গবেষকরা গালভরা বুলি আউড়েছিল অমুক ব্রিজটা হলে খুব কম দামে খুব দ্রুত পণ্য প্রবাহ বাড়বে এবং ভোক্তারা সস্তায় পণ্য পাবে। গবেষকরা ভাড়া নিয়েই সন্তুষ্ট। তারা খোঁজখবর করে না যে টেকনোলজি বা আধুনিকতার নিয়ন্ত্রক শ্রেণী কে? একপক্ষ বলছে মোবাইল টেকনোলজি চালু হওয়ার পর আগের মতো ক্ষুদে উৎপাদকরা বঞ্চিত হচ্ছে না।

কারণ সে জেনে যাচ্ছে একটা মিষ্টি কুমড়ো ঢাকায় ৫০ টাকায় বিকোচ্ছে। সুতরাং কিছুতেই সে ৩০/৪০ টাকার কমে বেঁচবে না। বস্তুত ঘটছে ঠিক এর উল্টোটা। মোবাইল টেকনোলজির কারণে ফড়ে জানতে পারছে কতোতে কিনলে কতো থাকে। আর সে হিসাবে সে কেনাটা নিয়ন্ত্রণ করছে।

কারণ সে জানে পথে অন্তত কুড়িখানেক ঘাটে তাকে বখরা দিতে হবে। যে বখরার একটা অবশিষ্টাংশ শেষাবধি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত পৌঁছাবে। সুতরাং যে যে দামেই কিনুক বখরা তাকে গুণতেই হবে। তাই বখরা যোগ বিক্রয় সমান সমান-লাভ এই হিসাব কষে সে কিনতে পাচ্ছে পানির দামে। শেষাবধি উৎপাদক গরিব কৃষক প্রাতরিত হচ্ছে।

যেমনটি হতো সে এই টেকনোলজির প্রয়োগের আগে। বরং আগের চেয়ে প্রতারণাটা বেড়েছে। কারণ টেকনোলজি আমদানি করেছে অসম প্রতিযোগিতা। গরিব কৃষকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। এতো গেলো উৎপাদিত পণ্যের বিপণন বিষয়।

গরিব কৃষক এখন যে পণ্য উৎপাদন করবে তার মধ্যে টেকনোলজি প্রবেশ করিয়ে পুরো ব্যাপারটা থেকে গরিব কৃষককে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাইব্রিড বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ইত্যাদির জোগান তাকে দিতেই হবে। তা নাহলে তার পণ্য বিকোবে না। আর এতোসব জোগান দিতে তাকে দ্বারস্থ হতে হবে টেকনোলজির মালিক তস্করদের। সেখানে একটা ঘষা পয়সাও সে ছাড় পাবে না।

ইচ্ছা করলেই এখন আর সে ঘরের কোণে লাউ বীজ পুঁতে লাউ ফলাতে পারবে না। কারণ তার ট্রাডিশনাল বীজের ফসল ফলতে যে সময় লাগবে তার আগেই হাইব্রিড ফসল বাজারে উঠে যাবে। সেই বাজার সে ধরতে না পারলে তার নামি ফসল নামি-ই হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাকে কোনো না কোনোভাবে কর্পোরেট বিজনেসের পার্ট হতেই হবে। আর তার ফলাফল কী সে তো ভালোভাবেই জানে।

একটা সময় যাতায়াতের অসুবিধা নিয়ে বিস্তর কাব্য উপন্যাস লেখা হতো। মানুষের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা, দুঃখকষ্ট নিয়ে ফেনিয়ে বলা হতো। যাতায়াত সহজলভ্য করেছে টেকনোলজি। এখন গরিব কৃষক বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়েই যানবাহন পাচ্ছে। ধান্ধাবাজ গবেষকরা যেটাকে ‘সুবিধা’ বলছেন সেটা মূলত হয়ে উঠেছে শোষণের নব্য হাতিয়ার।

দরজা থেকে দরজা এই যে যাতায়াতের সুযোগ সেটা করা হয়েছে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নয়। করা হয়েছে সাধারণকে শোষণ যন্ত্রের আওতায় আনার জন্য। সাধারণের হেঁসেল অবধি পৌঁছে যাওয়ার জন্য। আগে গরিবরা তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতো। টেকনোলজি আর কর্পোরেট বেশ্যাগুলো এখন তাকে ফৌজদারী কার্যবিধি আর সাংবিধানিক অধিকার শেখাচ্ছে।

ফলে খুব সহজেই বাঁশপাতা নিয়ে বিবাদে রাষ্ট্রের লাঠিয়াল পুলিশ গরিব গুরবোদের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলাফল কাড়ি কাড়ি টাকার শ্রাদ্ধ। আগে ওই গরিব চাষার জীবনে ভাত তেল নুন ছাড়া অন্য কিছুর খুব একটা আবশ্যকতা ছিল না। এখন কর্পোরেট বেশ্যাগুলো ছেনালি করে তাকে প্রলুব্ধ করে তার ভোগেচ্ছা বাড়িয়ে তার দুয়ারের সামনে হাজির হচ্ছে মিনিপ্যাক কমোডিটিজ নিয়ে। মাচার তলেকার কুমড়োটা বেঁচে তার বউ চামড়া মসৃণ করার ক্রিম কিনছে।

টেকনোলজির হাজার রকম শোষণকে যথাযথ আর জায়েজ করার জন্য দিনরাত ঠাণ্ডা ঘরে বসে ভাড়াটে সংস্কৃতিকজীবীরা ‘পরিশ্রম’ করে যাচ্ছেন। এদের হাজারো রকমের ভোগেচ্ছা পয়দা এবং সেই ভোগেচ্ছা বাস্তবায়নের পরিণতির ভেতর যে লাভ তারা বের করছে তাতো করছেই, যখন প্রয়োজন হচ্ছে যে গরিব কৃষক বা গরিব চাষাকে সব কিছুতে প্রতিযোগিতা করতে দেওয়া হবে না, তখন তার জন্য তারা সরকারের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিতে টেকনোলজি ঢুকিয়ে তা চাষাদের জন্য অনতিক্রম্য করে তুলছে। টিআইএল, বিআইএন, ইউটিআইএন, বিওএন নম্বার সিস্টেম করে সবকিছু থেকে অশিক্ষিত চাষাকে হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন ইচ্ছা করলেই কোনো চাষা টাকা জমিয়ে শেয়ার ব্যবসা করতে পারবে না। গ্রামের গরিব কৃষক টাকা জমিয়ে এফডিআর করতে পারবে না।

অর্থাৎ টেকনোলজি আর আইটি প্রয়োগ করে গরিব চাষাকে একে একে সকল সেক্টর থেকে হটিয়ে শুধুমাত্র ডেইলি লেবার পদটাতে কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাষারা এখন যাই করুক তা শেষ পর্যন্ত দৈনিক দেহশ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। তার শ্রমের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, মুক্ত শ্বাস নেওয়ার অধিকার, এমনকি তার হাঁটা চলার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে ওই আইটি। তার বদলে চাষাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেলফোন। সে ফোনকার্ড কিনে কুঁই কুঁই করে দুঃখের বয়ান করছে।

আর ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ঋণের এককানা কাগজ যার নাম মাইক্রোক্রেডিট। চাষা যা উৎপাদন করছে তা চাষার একহাত থেকে অন্য হাতে যাচ্ছে। মুখে উঠছে না। আবার তার মুত্যৃও হচ্ছে না। ভারী ধনন্তরী এক খেলা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.