গতকাল আমরা রাগ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ বর্জনীয় আরেকটি বিয়ষ পরচর্চা নিয়ে কিছু চর্চা করা যাক।
কি বলেন, পরচর্চা বর্জন করবো? পরচর্চা বর্জন করলে আমাদের সময় কাটানোর আর কিই বা থাকবে? --এটা অনেকের মনোভাব। আসলে পরচর্চা বা গীবত আমাদের জীবনের এত বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে যে এটাকে একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে আমরা গণ্য করি । আসলে পরচর্চা বা গীবত কি জিনিস? অপরের অনুপস্থিতিতে তার দোষ ত্রুটি বর্ননা করা বা আলোবচনা করাই গীবত।
আরেকটু খোলাসা করে বললে বলা যায় যে যে কথা শুনলে একজন মানুষ কষ্ট পেতে পারতেন তা তার অনুপস্থিতিতে বলাটাই গীবত । অর্থ্যাৎএকটা আলোচনা গীবত , পরচর্চা বা পরনিন্দা হবার জন্য যে বৈশিষ্ট থাকবে তা হল:
অপরের দোষ ত্রুটি বা নিন্দাবাদ করা।
অপরের অনুপস্থিতিতে বা গোপনে সেটা করা।
সামনাসামনি কাউকে তার দোষ ধরিয়ে দেয়ায় বা তার নিন্দাবাদ অন্য ব্যাপার । সেটা গীবত নয়।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা অন্যের কথা বলবো না কি নিজের কথা বলবো? তাহলে সময় কাটবে কিভাবে। আসলে পরচর্চা আমাদের জীবনে কত ক্ষতি করে তা যদি আমরা বুঝতে পারতাম তাহলে আমরা আর পরচর্চা করতাম না। সমস্যা হচ্ছে পরচর্চার ক্ষতির দিকটা আমরা কেউই দেখতে পাই না। একটু ভাবুন পৃথিবীর কতটা জিনিস আমরা দেখতে পাই। বাতাস কি আপনি দেখতে পান? লাভ বা ক্ষতি কি আমরা দেখতে পাই না অনুভব করি।
আমরা অনুভব করি। আর যখন অনুভব করি তখন কিছুই করার থাকে না। গীবত আমরা কেন করি বলতে পারেন? কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ হতে পারে :
১। আমরা আমাদের অহম বা অহংকারকে চরিতার্থ করতে চাই। আমরা কারো গীবত করার মাধ্যমে নিজেকে বড় বলে পরিচিত চাই।
ব্যাপারটা এইরকম - ওমুকের এই এই দোষ আছে, আমি তার চেয়ে উত্তম।
২। গীবত করার মাধ্যমে আমরা কারো ওপর আমাদের রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করি।
৩। অন্যের দোষ ত্রুটি ধরে আমরা একটা বিকৃত আনন্দ পেতে চাই ।
তাই গীবতকে আমরা একটা আনন্দের ব্যাপার হিসাবে গ্রহন করি।
৪। সময় কাটানোর একটা ভুল পন্থা হিসাবে আমরা গীবতকে গ্রহন করি। যখন কিছু করার নেই তো পরনিন্দায় মত্ত হই।
৫।
নিজের কোন দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমরা অন্যের নিন্দা করে পার পেতে চাই।
আসলে জীবনের সময়টাকে যদি আপনি ভাগ করে দেখেন , তাহলে দেখবেন একটা বড় মূল্যবান সময় আমরা গীবত বা পরচর্চা করে কাটাচ্ছি। গীবত করাটা একটা কাপুরুষোচিত কাজ। যদি সাহস থাকে তো সামনাসামনি কারো সমালোচনা করতে পারি। পরচর্চা আসলে আমাদেরকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে।
আসুন কয়েকটি দেখি:
১। পরচর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছি।
২। আমাদের একত্রিত হওয়া বা আড্ডাকে কলুসিত করছি। অধিকাংশ ক্ষতিকারক আড্ডার বিষয় পরচর্চা।
যদি পরচর্চা বন্ধ করা যেত তাহলে আড্ডা আমাদের জীবনের একটা ফলপ্রসু বিষয় হিসাবে উপস্থাপিত হতে পারতো।
৩। গীবত বা পরচর্চা আসলে আমাদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতার সৃষ্টি করে রাখে । আমরা নিজেদের ছোট ভাবি বলেই গীবত করি।
৪।
নিজের মহৎ গুণগুলি প্রকাশিত হতে বাধাগ্রস্থ হয় । কারন অপরের নিন্দা করলে স্বাভাবিক ভাবেই আমি নিজেকে ভালো মানুষ হিসাবে দাবী করতে পারবো না।
৫। অপরের কাছে অন্যের গীবত শুনে আমরা হিংসা ঈর্ষা বিদ্বেষ ইত্যাদী নানান ক্ষতিকারক দোষ দ্বারা আমাদের চরিত্রকে কলুসিত করার ঝুকি নেই। তেমনি আমি অপরের দোষ বললে অন্য মানুষও তাদের প্রতি নেগেটিভ ধারনা পোষন করতে থাকেন।
৬। আমরা বিভিন্ন আড্ডা বা আলোচনায় গীবত বা পরচর্চা করার মাধ্যমে আসলে আমাদেরকেও অন্যের গীবতের মাধ্যম হিসাবে চিহ্নিত করে তুলছি। আমার আজকের বন্ধু অন্য একটি আড্ডায় আমার সম্বন্ধেও অনায়াসে গীবতে লিপ্ত হবেন এটা নিশ্চিত।
আসলে আমরা অনেক ধরনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে পারবো। মূল কথা হচ্ছে যে আমরা অপরের নিন্দা করার মাধ্যমে আমাকে নিজেকেই একজন খারাপ মানুষে পরিণত করার ঝুকি নিচ্ছি।
নিন্দা করার বা কারো দোষত্রুটি ধরিয়ে দিতে হয় তার সামনেই। আমি তাহলে আমার সৎ উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করতে পারবো। সেটা তার উপকারই বরং করতে পারে। তাহলে এই যে গীবত বা পরচর্চা - এ থেকে আমরা কিভাবে বেচে থাকতে পারি? আত্মসচেনতা বা আমাদের ইচ্ছা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন। আর কি কি উপায় অবলম্বন করা যায় আমরা দেখি:
১।
আপনি কোন কোন সময়ে গীবতে লিপ্ত হন তার একটা তালিকা তৈরী করুন। যেমন স্কুল কলেজের অবসরে, খাবার টেবিলে ইত্যাদী।
২। যার সম্বন্ধে খারাপ বলতে চান বা নিন্দাবাদ করতে চান তা তার সামনে করার অভ্যাস করতে পারেন।
৩।
একজন লোককে ঠিক করুন যার নিন্দা আপনি পেছনে হরহামেশা করেন। এবারে সময় সুযোগ বুঝে তার সামনেই তার দোষ বলতে চেষ্টা করুন। দেখবেন আপনার গীবত করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
৪। নিজের দোষত্রুটির একটা লিস্ট তৈরী করুন।
এবারে সেই দোষগুলোর একটা একটা ধরুন। এবং নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (যেমন:১দিন বা ১সপ্তাহ) অপরের সেই দোষগুলো বলা থেকে বিরত থাকুন।
৫। মানুষের ভালো দিকগুলো আলোচনার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যখনই কারো সম্বন্ধে খারাপ কিছু বলতে ইচ্ছে হবে, তখন তার যে কোন একটা গুন নিয়ে কথা বলুন।
এভাবে আমরা আমাদের পরচর্চা পরনিন্দা করার অভ্যাস ত্যাগের চেষ্টা করতে পারি। আবারো প্রশ্ন - গীবত খারাপ বা নিষিদ্ধ কেন? আসলে আপনার দোষ যদি কেউ বর্ণনা করে তাহলে আপনার কি খারাপ লাগবে না? অবশ্যইএমনকি আপনার ক্ষতিও হতে পারে । ঠিক এই কারনেই অপরের দোষও তার অনুপস্থিতিতে আপনি বলতে পারেন না।
পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেছেন:
---তোমরা গীবত বা পরনিন্দা করো না। গীবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার সমান অপরাধ।
-সূরা হুজরাত:১২
তিনি আরো বলেন-
--যখন কাউকে গীবত করতে শুনবে ,তাকে বাধা দেবে বা তাতে অংশগ্রহন থেকে বিরত থাকবে। -সূরা কাসাস:৫৫
এই রমজান মাসে আমরা গীবত থেকে মুক্ত হবার জন্য চেষ্টা করতে পারি । আসলে রাগ গীবত এগুলো এবং রোজা একসাথে হতে পারে না। আমরা এসব ক্ষেত্রে সংযমের প্রচেষ্টা অবশ্যই চালিয়ে যাব। আর তাহলেই আমরা নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা হিসাবে গড়ে তুলতে পারবো।
সবাইকে ধন্যবাদ। আগামীকাল আবার দেখা হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।