কানা মামুন সমাচার
-----------------
দৈনিক ভোরের কাগজে কাজ করিবার সময় ২০০২ সালের দিকে যোগ দিলেন ফটো সাংবাদিক মামুন আবেদীন। তাহার সামান্য বায়ুচড়া দোষ আছে; এমনিতে লোক খারাপ নহে। ইতিপূর্বে তিনি দৈনিক আজকের কাগজে আমার সহকর্মি ছিলেন। সেই সুবাদে আমার কাছে নানান আব্দার ছিলো তাহার।
তো ফটো-মামুনকে লইয়া সাংবাদিক মহলে নানা প্রচারণা আছে।
তিনি আবার লক্ষ্মী ট্যারা। মনে করুন, আপনার দিকে তাকাইয়া কথা বলিলো। আপনি ভাবিলেন, সে হয়তো পাশের জনের সহিত ব্লগরব্লগর চালাইতেছে...এইরূপ আর কি! মুখে মুখে তাহার আসল নামটির আগে 'কানা' বিশেষণটি যোগ হইয়া নাম দাঁড়াইলো 'কানা মামুন'।
তাহার সম্পর্কে আরও প্রচলিত রহিয়াছে যে, সে ছবি যাহাই তুলুক না কেনো, তাহার সবই নাকি আউট অব ফোকাস! যদিও বা দু - একটি ছবি ফোকাস হয়, ইহাতে আবার মানুষের মাথা কাটা পড়ে, ধরা পড়ে শুধু ধড়খানি!
শুনেছি চৌধুরি বাড়িতে নাকি বসেছে আসর
--------------------------------------
তো কানা একদিন আমাকে আসিয়া কহিলো, বেগুনবাড়ি বস্তির মাঠে যাত্রার পালা বসিয়াছে। সারা রাত্রি সে ফটোগ্রাফি করিবে।
আমি যদি অনুগ্রহ করিয়া পুলিশ কর্তাদের তাহার নাম বলিয়া দেই; কারণ তাহার দামি ক্যামেরার সিকিউরিটি রক্ষা করিবার বিষয় আছে -- ইত্যাদি।
আমি চোখ মুদিয়া তাহার দিকে ডান হাত বাড়াইয়া দিলাম। অর্থাৎ, আগে মালে আইসো চান্দু! কিঞ্চিৎ অগ্রিম সার্ভিস চার্জ ছাড়ো তো বাপধন! ...
কানা খানিকক্ষণ 'হেঁ হেঁ ' করিয়া কহিলো, আরে রাখেন তো বিপ্লব দা। আপনি রমনা থানার ওসিকে একটু আমার নাম বলিয়া দিন না। পরে না হয়।
...
এই ফাঁকে বলিয়া রাখি, অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করিবার চেষ্টায় তখন পুলিশ মহলে আমার সামান্য পরিচিতি ঘটিয়াছে।
কানাকে বলিলাম. সঙ্গে আমিও যাইবো। গ্রাম্য যাত্রা দেখিবার পরে না হয়, একটা শহুরে যাত্রা দেখিবার অভিজ্ঞতা হইয়া যাক।
সে তো খুশীতে আটখানা। কারণ, আমার সঙ্গে থাকিলে তাহার চা - সিগারেট ইত্যাদি সবই ফ্রি!
রমনা ওসিকে একটা ফোন ঠুকিয়া রাত ১২ টার কিছু আগে গন্তব্যে পৌঁছাইলাম।
বদের মেয়ে হেভি জোস!
---------------------
যাত্রার পালার নাম শুনিলাম, বেদের মেয়ে জোছনা।
পালার স্থলে আসিতেই রমনা থানার সেকেন্ড অফিসার আমাকে সালাম দিয়া কহিল, ওসি স্যার ওয়ারলেস করিয়া আপনার কথা কহিয়াছেন। আমার সহিত আসুন। একেবারে মঞ্চের সামনে বসাইয়া দিবো। আর আমি আশেপাশেই রহিয়াছি।
কোন দরকার পড়িলে শুধু ইশারা করিলেই চলিবে।
পালার স্থলের পেছনের দিক দিয়া মঞ্চের একপাশে একখানা ছোট বেঞ্চিতে বসিলাম। পালার সমগ্র প্যান্ডেল রিকশা ওয়ালা কি বাসের হেলাপার গোত্রীয় লোকজনে ভরিয়া উঠিয়াছে।
যাত্রার এক লোক দর্শকদের মাঝে ঘুরিয়া ঘুরিয়া মশা তাড়াইবার জন্য ধূপধুনো দিতেছে। হঠাৎ আরেকজন মাইক ফুকিলো:
ভাইসব, ভাইসব।
যাত্রা, যাত্রা, যাত্রা। ...ঝুমুর ঝুমুর নাচ আর কুমুর কুমুর নৃত্য। আজ আমাদের এখানে দেখানো হইতেছে--বেদের মেয়ে জোছ-নাআআআ...। দেখিবেন, এক ঝাঁক ডানাকাটা বলাকা! সত্ত্বর টিকিট লইয়া আসন গ্রহণ করুন!
চারদিক খোলা মঞ্চের এককোনে বসিয়া বাদকদল চিকন সুরে হারমোনিয়াম আর সাঁনাইয়ে সুর তুলিলো:
বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়াছে,
আসি আসি বলে জোছনা ফাঁকি দিয়াছে। ...
মনে বাবলা পাতার কষ লাইগাছে
-----------------------------
এমনি কিছুক্ষণ বাদ্যবাজনা চলিলো।
অধৈর্য দর্শককূল এক সময় অতিষ্ট হইয়া হইহই করিয়া উঠিলো। বড় বড় বাঁশের লাঠি হাতে ভলেন্টিয়ারদের তাহাদের সামলাইতে বেগ পাইতে হয়।
হঠাৎ ঘোষণা হইলো:
এখন আপনাদের বাউল সঙ্গীত শোনাইবেন, মিস চম্পআআআ...
নাদুস-নুদুস মিস চম্পা মঞ্চে আসিয়া সবাইকে সালাম-আদাব দিলেন।
বাউল শিল্পীর সাজ-সজ্জা দেখিয়া আমার হাত হইতে সিগারেট পড়িয়া যাইবার উপক্রম। আমি আক্ষরিক অর্থেই 'হা' হইয়া গেলাম!
তাহার টকটকে লাল রঙা ঝলমলে শাড়িটি টিনের তৈয়ারি বলিয়া ভ্রম হয়।
উগ্র সাজ-সজ্জায় লালের ব্যবহার অত্যাধিক। আর শাড়ির আঁচল কিছুতেই যথাস্থনে থাকিতে চায় না। বার বার খসিয়া পড়ে। তিনি আবার সলজ্জ হাসি দিয়া চোখ টিপিয়া শাড়িটিকে সামলাইতে ব্যস্ত হন।
দর্শককূল তুমুল করতালি আর সিটি বাজাইয়া তাহাকে স্বাগত জানাইলো।
তাহাদের আনন্দ আর ধরে না।
এদিকে কানা মামুন দেখি ঠিকই ক্যামেরা-ফ্লাশ লাইট গুছাইয়া ফটাফট ছবি তুলিতেছে।
মিস চম্পা নাচিয়া-কুঁদিয়া গান ধরিলেন:
আমার মাটির দেহে লাউ ধইরাছে,
ও লাউ দেখতে বড় সোহাগি,
লাউয়ের পিছে লাগছে বৈরাগী। ...
বলা বাহুল্য, গানের ভিতরে ঘুরিয়া ফিরিয়া 'মাটির দেহে লাউ ধইরাছে' -- বাক্যটি আসিবা মাত্র তাহার আঁচল খসিয়া পড়ে। লো-কাট ব্লাউজ ঝলসিয়া উঠে বার বার।
সেই সাথে উল্লাসে - চিৎকারে ফাঁটিয়া পড়ে দর্শকমহল।
উৎসাহী কয়েকজনকে আবার দেখা গেলো, ভলেন্টিয়ারদের লাঠির বাড়ি খাইবার ঝুঁকি লইয়াই হাত বাড়াইয়া পঞ্চশ কি একশ টাকার নোট মিস চম্পার ব্লাউজের ফাঁকে গুজিয়া দিতে।
হায় চোলি!
----------
মিস চম্পা প্রস্থান করিবার পর বাদক দল বাজনা ধরিলো:
কুককুরু কুককুরু কুককুরু,
চোলি কা পিছে ক্যায়া হে,
চোলি কা পিছে?...
কিছুক্ষণ বাদ্য বাজনার পর মাইকে ঘোষণা হইলো: এই বার মঞ্চ কাঁপাইবেন, মিস ঝুম্পাআআআ...
দৌড় দিয়া মঞ্চে উঠিলেন মিস ঝুম্পা। তিনিও মিস চম্পার অনুরূপ। তবে সাজসজ্জায় আরেক কাঠি সরেস।
তাহার পরনে লাল ঝলমলে চোলি - ঘাগড়া তো আছেই। তবে ব্লাউজ আর ঘাগড়ার দূরত্ব বড়ই বেশি। ইহাছাড়া ব্লাউজটিও অনেক ক্ষীণ। আবার মেদবহুল পেট আর বুকের খোলা অংশে অদ্ভুদ কি এক কায়দায় সোনালী চুমকি লাগানো হইয়াছে। উজ্জল বৈদ্যুতিক আলোয় নর্তন-কুর্দনের ফাঁকে ওইসব চুমকি ঝলসাইয়া উঠে।
নমাজ আমার হইলো না আদায়
----------------------------
বুঝিলাম, মূল যাত্রা শুরু হইতে দেরী আছে। ইহারা সবই বোনাস।
তো মিস ঝুম্পা হাত-পা ঝাঁকাইয়া, কোমড় দুলাইয়া 'হায় চোলি' নাচটির অনুকরণে কোনো একটি নাচ করিবার কসরত করিতে লাগিলেন।
তিনি আবার মাঝে মাঝে হলিউডের সিনেমার নাইট ক্লাবের দৃশ্যের ন্যায় মঞ্চের খুঁটি ধরিয়া ইঙ্গিতপূর্ণ কায়দায় শরীরে ঢেউ খেলান।
এই মহতি চুম্বক দৃশ্য হইতে অন্যদিকের দর্শকরা বঞ্চিত হইলে সেই দিক হইতে আবার হইহই রব উঠে।
চম্পা রানী তাহাদের মন জোগাইতে ছুটিয়া যান সেই দিকে। আবারো হাঁটুর উপরে ঘাগড়া তুলিয়া সেইদিকের খুঁটিটি উপড়ানোর বৃথা চেষ্টা চলে। ...
এদিকে কানা মামুন ছবি তুলিবার ফাঁকে ফাঁকে আমার কানের কাছে আসিয়া চিৎকার দিয়া কহিলো, দাদা, কুড়িটা টাকা দিন তো। বাংলা খাইবো!
তাহার ইশারায় দেখিলাম, পুলিশের উপস্থিতিতেই মঞ্চের এক কোনে বিশাল এক প্লাস্টিকের ড্রামে করিয়া বাংলা মদ বিক্রি হইতেছে। সেখান হইতে ছোট প্লাস্টিকের বোতলে মদ ভরিয়া বিক্রি করা হইতেছে, প্রতি বোতল মাত্র কুড়ি টাকা।
এতোক্ষণে বুঝিলাম, বিভৎস ঘাম, সিগারেট, গাঁজার গন্ধ ছাড়াও কটু গন্ধটি কিসের।
চোখ ধাঁধানো আলো, মিস ঝুম্পার কসরত, তুমুল বাদ্য, হট্টোগোল আর নেশার কটু গন্ধে একেবারে নরক গুলজার!
আমি মামুনকে বুঝাইলাম, এই সব চোলাই মদে বেশীরভাগ সময়ই ঝাঁজ বাড়াইবার জন্য গাড়ির ব্যাটারির অ্যাসিড মেশানো হয়। ইহা স্বাস্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমনকি অনেক সময় মানুষের মৃত্যূ পর্যন্ত ঘটে। সে ব্যাটা কি বুঝিলো কে জানে?
হঠাৎ মঞ্চের একদিকে দর্শকদের মধ্যে মারামারি লাগিয়া গেলো।
ভলেন্টিয়াররা বাঁশ দিয়া পিটিইয়া পরিস্থিতি সামলাইতে পারিলেন না। চারিদিকে শুরু হইলো হুড়োহুড়ি। পুলিশ মুহুর্মুহু বাঁশি ফুঁকিতে লাগিলো। বুঝিলাম, এই বার তাহারা লাঠিচার্জ শুরু করিবে।
কানাকে বলিলাম, ক্যামেরা ছিনতাই হইবার আগেই চম্পট দেওয়া ভালো।
পুলিশের সেই সেকেন্ড অফিসার আসিয়া আমাদের কর্ডন করিয়া বড় রাস্তায় তুলিয়া দিলেন। আমাদের আর সেই বেলা যাত্রা দেখা হয় নাই। ...
ছবি: যাত্রার মেকআপ, সাহাদাত পারভেজ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।