সত্যি বেফাঁস কথা বলে মহাসমস্যার ফাঁদে পড়েন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, চার বছর আগে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ভাষা আন্দোলন তাকে কী সংকটেই না ফেলে দিয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে পরিস্থিতির দায় থেকে মুক্তি, তবে পূর্ণ মুক্তি ঘটেছিল তাদের 'কায়েদে আজম'-এর কল্যাণে। তিনি আট দফা চুক্তি খারিজ করে দিয়ে খাজা সাহেবকে বন্ধনমুক্ত করেছিলেন। সে ঋণ ভুলে যাবার নয়।
এবারও তিনি পরিস্থিতি বুঝে পূর্ব পরিত্রাতার দিকেই হাত বাড়িয়ে দেন। ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে তিনি গর্ভনমেন্ট হাউসে ৩ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন মূলত রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে তার বক্তব্য ও অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য। তিনি জানান, পল্টন ময়দানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে যা বলেছেন তা সবই কায়েদে আজমের কথা—তার নিজের কথা নয়। এরপরও তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রাদেশিকতার বিপদ ইত্যাদি নিয়ে তাদের বহুকথিত বক্তব্যই তুলে ধরেন। আসলে রাজনৈতিক জীবনের গোটা সময়টাতে তিনি ছিলেন কায়েদের ভক্ত, কায়েদের অনুসারী।
আর সেজন্য কায়েদও তাকে সোহরাওয়ার্দীর চেয়েও বিশ্বস্ত ভক্ত হিসাবে কাছে টেনেছেন। সেসব পুরনো রাজনৈতিক কাসুন্দি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক তার সব বক্তব্যের দায় কায়েদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের এমন কথাও বলেন যে, তিনি কায়েদের নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার মাত্র গণপরিষদেরই রয়েছে। ব্যস, সব চুকে-বুকে গেল।
এমন ধারণা নিয়ে তিনি পরদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু বুঝতে পারেননি যে, গত কয়েক বছরে জমা ক্ষোভের শুকনো বারুদ স্তুলিঙ্গপাত ঘটিয়ে গেছেন তিনি। কারণ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে জিন্নাহ সাহেব বাঙালি তরুণদের বাংলা বিষয়ক যে আবেগের ওপর পানি ঢেলে দিয়ে গিয়েছিলেন তা গত কয়েক বছরে শুকিয়ে ক্ষুব্ধ বারুদের চরিত্র অর্জন করে। সেটা আরো এ জন্য যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার নানাভাবে বাংলাভাষার ওপর আঘাত করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা।
এ প্রচেষ্টার মূলনায়ক কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গে উর্দু শিক্ষার প্রসার ঘটানোরও চেষ্টা চলেছে।
জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা সত্ত্বেও ছাত্রদের একাংশ হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকেনি। যে-যার মত কাজ করে গেছে। যেমন—১৯৪৯ সালে ১১ মার্চের আন্দোলন দিবস পালনে কেউ এগিয়ে না এলেও ছাত্র ফেডারেশনের কিছু সংখ্যক নেতা-কর্মী ঢাকার রাজপথে নামেন।
অবশ্য রমনা ছাত্র এলাকায়। ছোট্ট মিছিল নিয়ে শ্লোগান—'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। নাদেরা বেগম, নাসির আহমেদ প্রমুখের নেতৃত্বে মিছিলে অংশ নেন মূলত ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী ও জনাকয় সমর্থক। পুলিশ বেধড়ক লাঠি চালিয়ে মিছিল ভেঙ্গে দেয় এবং কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। যেমন—সৈয়দ আফজল হোসেন, মৃণাল বাড়ড়ি, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান (হেনরী), আবদুস সালাম প্রমুখ।
ছাত্রবন্ধু সালামসহ অন্যদের অবশ্য জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছোট ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে তমদ্দুন মজলিসসহ অনেকেরই রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পিছিয়ে পড়ার বিষয়টা তুলে ধরতে। এর কারণ সম্ভবত জিন্না সাহেবের বক্তৃতা ও সরকারি দমননীতি।
পূর্ববঙ্গে অবাঙালি প্রধান শীর্ষ প্রশাসন তখন একদিকে 'বিহারিদের' অযৌক্তিক প্রশ্রয় ও সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মদদ জুগিয়েছে। পঞ্চাশের দাঙ্গার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ কথা লিখতে পারছি।
সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকানপাট বা বিষয়-সম্পত্তি নানা উপলক্ষে বিহারিদের মধ্যে দরাজ হাতে বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রবণতা ষাটের দশকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত চলেছে। চলেছে সরকারি মদদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৫০ সালে ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসাবে উদযাপন উপলক্ষে আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে (যতদূর মনে পড়ে বেল তলায়) আয়োজিত ছাত্র সভায় বিরাজমান বদ্ধাবস্থা কাটাতে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। উপস্থিত ছাত্রদের সমর্থনে আবদুল মতিন এ কমিটির আহবায়ক মনোনীত হন।
তার আগ্রহে ও চেষ্টায় ভাষা বিষয়ক কর্মকাণ্ডে কিছুটা গতি সঞ্চারিত হয়। অবশ্য আবদুল মতিন আমাকে বলেছিলেন, এ কাজটা তাকে প্রায় একাই করতে হয়েছে। কারণ কমিটির সভায় অন্য সদস্যদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এ সময়পর্বটা ছাত্রদের জন্য ছিল সমান্তরাল দুই বিপরীত ধারার। এ সময় ভাষার দাবিতে ছোট-বড় কর্মকাণ্ড যেমন চলেছে তেমনি সরকার পক্ষে দেখা গেছে বিপরীত অর্থাত্ বাংলাভাষা বিরোধী তত্পরতা।
তাই দেখা যায়, সংবিধান প্রণয়ন উপলক্ষে গঠিত মূলনীতি কমিটি রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক সুপারিশে মন্তব্য করে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু (১৯৫০, সেপ্টেম্বর)। বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর ছাত্র সমাজ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আবারও শুরু হয় সভা, সমাবেশ, মিছিল, শ্লোগান।
বলতে হয়, মূলনীতি কমিটির সুপারিশ স্তব্ধ ভাষা আন্দোলনের চেতনায় নতুন করে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ছাত্র তত্পরতার পক্ষে নতুন একটি উপলক্ষ দেখা দেয়।
বিষয়টা সংবিধান সংক্রান্ত বলে রাজনৈতিক নেতাদেরও সাগ্রহে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। স্বভাবতই ভাষা ও সাংবিধানিক মূলনীতি এই বিষয় দুটি একত্র হয়ে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঢাকায় যেমন তা জমজমাট তেমনি সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশের প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়।
১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসটা শহর ঢাকায় বেশ উত্তজনার মধ্য দিয়ে পার হয়। রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টাকে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ এবং সভা-সমাবেশে ধরে রাখার চেষ্টা করেন।
কিন্তু ছাত্রদের চেষ্টা ছিল বিষয়টাকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে পরিণত করা এবং আন্দোলন রাজপথে নিয়ে আসা। এ উদ্দেশ্য অনেকটা সফল হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতা অনেককে রাজপথে নামতে ও মিছিলে শামিল হতে হয়েছে। পরিস্থিতি গোটা প্রদেশব্যাপী এতটা উত্তেজক হয়ে উঠেছিল যে, পাক সরকার বোধহয় কিছুটা ভয় পেয়েই মূলনীতি কমিটির সুপারিশ নিয়ে আলোচনা স্থগিত করে। কিন্তু তাই বলে মুসলিম লীগ নেতাদের বাংলাভাষা বিরোধিতায় ভাটা পড়েনি।
যেমন, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান করাচিতে বলেন যে, 'একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা'। অন্যদিকে উর্দুর কট্টর সমর্থক বাঙালি আমলা মীজানুর রহমান 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার নাম' প্রবন্ধে দাবি করেন যে, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। তেমনি ওই কাতারে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি গোলাম মোস্তফা। তারা উর্দুবাচনে কতটা পটু ছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবু তারা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক এই উভয় কারণে মাতৃভাষা বাংলাকে ছেড়ে উর্দুকে ঘরে টেনে এনেছিলেন।
পাক সরকার তাদের নিত্যনতুন বাংলা বিরোধিতার মাধ্যমে ভাষা-আন্দোলনের নিস্তরঙ্গ ধারায় ক্রমেই জোয়ার সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। এ সত্যটা স্বীকার করা দরকার। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের 'প্রস্তুতিপর্ব' বা 'সলতে পাকানো' বলে যদি কিছু থাকে তাহলে এর পরিণত প্রকাশ ঘটেছে গোটা ১৯৫১ সাল ধরে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অস্থিরতাও সে সময় যথেষ্ট প্রবল। একাধিক দাবি নিয়ে শিক্ষায়তনে ধর্মঘট, মেডিক্যাল স্কুল ছাত্রদের দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ছাত্রদের শাস্তি-বহিষ্কার।
এমনকি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দুই ছাত্রেরও বহিষ্কার। সব মিলিয়ে এক অস্থির বিপ্লবধর্মী পরিস্থিতি। এর মধ্যে ছাত্ররা মাঝেমধ্যে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করেছে। শ্লোগান: 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না' ইত্যাদি। একদিকে সরকার ও বেসরকারি উর্দুপন্থিদের জোরালো প্রচার, অন্যদিকে বাংলাপন্থিদের ক্রমবর্ধমান তত্পরতা।
প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে গণপরিষদ সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানি সাংবাদিক মহলে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে স্মারকলিপি প্রদান স্মরণযোগ্য।
পরিস্থিতি এভাবেই বাংলা ভাষার পক্ষে পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এবং তা এমনই পর্যায়ে যে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো ধীরস্থির পণ্ডিত ব্যক্তি কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত শিক্ষক সম্মেলনে (১৯৫১) সভাপতির ভাষণে বলেন, 'বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব'। প্রতিবাদী চেতনার পরিণত এ পরিস্থিতিকে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেন প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায়। ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে ডাকা তার সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য ধারেভারে কোনোদিকেই কাটেনি—ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
উপস্থিত সাংবাদিকগণ তা কীভাবে নিয়েছিলেন সেটা তারাই জানেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।