ঢাকা য়্যুনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে পড়ার সময় এক বিতর্ক সংঘাত সাংগঠনিক সংঘাতের জের ধরে, আমার এক সতীর্থ বিতার্কিক বন্ধু টেম্পেস্ট নাটকের ক্যালিবানের মত দেখতে অনেকটা, আমাকে মফস্বলের ছেলে বলে গাল দিয়েছিল। ধরে নিলাম ক্যালিবানের জন্ম ঢাকায় একটি ছোট্ট সরকারী কোয়ার্টারে যার ভোঁ দৌড় দেবার মাঠ ছিল না, ঘুড়ি ওড়ানোর আকাশ ছিল না, নৌকা হাঁকানোর নদী ছিল না। কেবল এক মেট্রোপলিটন মন ছিল, নিজেকে ঢাকা ড্যান্ডি ভাবার আত্মপ্রসাদ ছিল।
কেন্দ্র এবং প্রান্তের দ্বন্দ্বে সাধারণত কেন্দ্রই জিতে যায়। কিন্তু আমাদের গল্পে কেন্দ্রের ক্যালিবান প্রান্তের ফার্দিনান্দের কাছে হেরে গিয়েছিল।
এর কারণ প্রান্তের ফার্দিনান্দের রঙিন শৈশব ছিল, সবুজে বেড়ে ওঠায় বুকভরা অক্সিজেন কিংবা আত্মবিশ্বাস ছিল আর ছিল আমোঘ এক আয়ূধ-বিতর্ক।
সম্ভবত নয় বছর বয়সে আমি প্রথম বিতর্ক করেছিলাম গ্রাম বনাম শহর। খুব সাদামাটা বিষয়। মফস্বল শহরে কেবল এরকম বিষয়েই বিতর্ক হতো আশির দশকের গোড়ার দিকে। এখন সময় বদলেছে - বিশ্বায়নের অভিঘাতে কিংবা আন্তর্জালের বদৌলতে (ডিজিটাল ডিভাইড সত্ত্বেও) অনেক কঠিন বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে সক্ষম মফস্বলের কোন কিশোর।
হালের এফ এম চ্যানেলের জগাখিচুড়ি ভাষারীতি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সেখানে এখনো পৌঁছেনি বলে আশা করা যায় তারা বাংলা ভাষার উচ্চারণে এখনো প্রমিত রীতিই মেনে চলে।
বয়স একটু একটু করে বাড়তে শুরু করলে মানুষ চলন্ত আত্মজীবনী হয়ে যায়। কিন্তু আমার এই ব্যক্তিগত কেস স্টাডি উপস্থাপন সম্ভবত ভিন্ন কারণে।
আজ অবধি ব্যক্তিগত জীবনে আমার যত অর্জন তার পেছনে একটা কারণই আমি খুঁজে পাই তা হলো বিতর্ক। বিতর্ককে আমি কেন্দ্র এবং প্রান্তের ধূসর বিভাজন মুছে দেবার ‘ইরেজার’ কিংবা কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি হিসেবে দেখি।
ঢাকা শহরের কেন্দ্র-প্রান্ত দ্বন্দ্ব কিংবা বার্লিন শহরের কেন্দ্র-প্রান্ত দ্বন্দ্ব (বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়া সেখানে মফস্বল হিসেবেই পরিচিত) আমার সামনে কখনো দাঁড়াতে পারেনি ছোটবেলা থেকে আজ অবধি বিতর্ক চর্চার কারণে।
এই কেস স্টাডি থেকে আমি বোঝাতে পারলাম কীনা জানিনা যদি সত্যিই কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে হয় তাহলে বিতর্ককে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ডিসকোর্স হিসেবে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃনমূল পর্যায়ে।
বিতর্ক সংগঠনগুলো যদি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বির্তক করেই খুশী থাকে, বিচারকরা যদি কেবল মেয়েদের কলেজে কিংবা হলের বিতর্ক সভায় গিয়ে পরিপূর্ণ পুলকে আত্মতুষ্ট থাকে, ডিবেট ফর হিপোক্রেসী জাতীয় এনজিও অথবা বিতর্কের দোকান খুলে দাতা সংস্থার সামনে ভিক্ষার থালা বাড়িয়ে দেয়, অবিতার্কিক বিতর্ক ব্যবসায়ীরা যদি প্যাকেজ নাটক বা সংগীতের ব্যান্ড বাজিয়ে দেয়া জাতের তারকাদের নিয়ে পাড়ার মোড়ে ভিডিওর দোকানের মত গজিয়ে ওঠা টিভি চ্যানেলগুলোতে তারকা বিতর্কের ব্যবসা ফেঁদে বসে, তাহলে সবচেয়ে প্রাচীন এই শিল্পটি অন্তত: এদেশে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টায় নিমজ্জমান ভাঁড়ামীতে পরিণত হবে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় বিতর্ক হলে একগুঁয়ে বামপন্থীদের মত তা নাকচ করে দেবার কারণ আমি দেখিনা। কিন্তু তাতে বিতর্কের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হচ্ছে কীনা সেটা বোঝার বয়স নবীন সংগঠকদের কিংবা তাদের প্রবীন থিংকট্যাংক ভাইয়াদের হয়েছে কীনা আমার জানা নেই।
এতক্ষণতো বিতর্ক জগতের অসংখ্য সংকটের কথা বললাম একনিঃশ্বাসে গতানুগতিক বুদ্ধিজীবীদের ভ্রুকুঁচকানো ভঙ্গীতে। এ প্রজন্মের একজন বিতার্কিক প্রশ্ন করতে পারে কিছুইতো করতে দেবেন না ভাইজান তাহলে করবোটা কী।
ঢাকার বিতর্ক সংগঠনগুলো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই কারণ তারাতো কেন্দ্রের সমস্ত সুযোগ সুবিধা বিতর্কের ডাকসাইটে সংগঠক হবে, একই দিনে আন্তঃ লীগ, আন্তঃ ক্লাব, আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক করতে করতে সন্ধ্যে নাগাদ প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে টিভি রেকর্ডিং এ পৌঁছবে। তাদের বিতর্কের দোকানদার মামা জাতীয় বিতর্ক মুঘলেরা (বয়স বেশী হলেও বিতর্ক জগতে মামা বলার সুযোগ নেই ‘ভাইয়া’ বলেই ডাকতে হবে) ধমক এবং আদরের সুরে রোলিং রোলিং বলে স্টুডিও লাইট জ্বেলে দেবে।
এখন বাকি রইলো প্রান্তের বির্তার্কিকেবা যারা কালেভদ্রে স্টারদের দেখা পায়, আজকাল শুনেছি তারা বিতর্কের ‘শ্রেষ্ঠ কবি’, ‘প্রধান কবি’, ‘গ্রুপ থিয়েটার নেতা’ কিংবা ‘সাংবাদিক নেতাদের’ ভঙ্গীতে ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে চেপে ধেয়ে আসা গডফাদারদের পৌরোহিত্যে বিতর্কের ‘কর্মশালা’ করার সত্যিই বিরাট সুযোগ পেয়ে থাকে।
আমাদের ভাগ্যে এরকম বিকট কর্মশালার সুযোগ ঘটেনি কারণ তখনো বিতর্কের গডফাদারেরা ডিমফুটে বেরিয়ে ডাইনোসর হয়নি। নাতিদীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে ঢাকায় ফিরে বিতর্কের এই জুরাসিক পার্ক দেখে ঘাবড়ে গেলাম।
তবুও কিছু সমসাময়িক বিতর্কের বন্ধু যারা নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত, বিতর্ক বিক্রি না করেও যাদের পেশাগত সাফল্য অর্জনের সামর্থ্য আছে, যারা কেবল বিতর্ককে ভালবেসে ব্যবসার অজুহাত দাঁড় না করিয়ে বিতর্ককে সময় দেয়, বিতর্কের মূল্যায়ন পর্বে ভালো ক্রিকেট কিংবা ফুটবল কোচের মত টিপস দেয় তাদের দেখে ভরসা পাই বিতর্কের পুরোটাই এখনো নষ্টদের অধিকারে চলে যায়নি।
এই লেখাটা একবসায় লিখে ফেলার অনুপ্রেরণা পেলাম ফরিদপুর ডিবেট ফোরামের প্লাবন গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা হয়ে।
প্লাবন আমার সঙ্গে খুব বেশী বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছিল।
হয়তো আমাদের সমাজের আধাসফল, ছদ্মসফল, অর্থ সফল, খ্যাতিসফল; বিতর্ক সফল লোকদের কাছে লেখা চাইতে গেলে এমন বিনয়ের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে কথা বলতে হয়।
প্লাবন; কখনো কাউকে ভয় পাবার কিছু নেই। বিতর্ক মানুষকে সাহসী হতে শেখায়। পৃথিবীতে কেন্দ্র-প্রান্ত বলে কিছু নেই। তুমিতো তাও ফরিদপুর ডিবেট ফোরামের নেতা, ওই ফোরামে শেষ বেঞ্চিতে বসে থাকা সবচেয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ বিতার্কিকটি হয়তো একদিন বারাক ওবামার মত শক্তি ধারণ করবে।
বিতর্ক সত্যিই বদলে দিতে পারে মানুষকে। ফরিদপুর ডিবেট ফোরাম শুধু স্কুল কলেজে বিতর্ক না করে যদি কৃষকের উঠোনে, চায়ের স্টলে, অবরোধ বাসিনী গ্রামীণ নারীদের কাঁথা সেলাই এর আড্ডায়, গ্রামের নদীর ঘাটে হ্যাজাক জ্বালানো হাটুরে গল্পে বিতর্কের শক্তিকে ছড়িয়ে দিতে পারে তাহলে একদিন বিতর্ক আন্দোলনের একটা সত্যিকার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই সব বিতর্কে স্পনসর লাগবে না, কর্মশালা প্রয়োজন হবে না, ক্রেস্ট-সার্টিফিকেট, আমাদের মত সবজান্তা বিচারক দরকার নেই, ভয়ে ভয়ে কারো কাছে লেখা চাওয়ারও জরুরী নয়-শুধু তোমরা চাইলে প্রান্তের মলিন মানুষেরা কেন্দ্রের অতিকার দৈত্যদের চ্যালেঞ্জ করার শক্তি খুঁজে পাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।