আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ূন আহমেদের মন্তব্যে নিন্দার ঝড়, হৈ চৈ



সূত্র: হুবহু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে নেয়া ঢাকা, জুলাই ২০ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- লেখকের স্বাধীনতা, ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা এবং রাজনীতি নিয়ে দেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বিতর্কিত মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও রাজনীতিকরা। শুক্রবার সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারে বলা নানা মন্তব্যের দৃশ্যত বিব্রত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হুমায়ূন কী ভেবে, কোন চিন্তা থেকে এসব কথা বলেছেন তা আমি জানি না। " সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ দাবি করেন, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন। 'তাহলে হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন?' পত্রিকাটির এ প্রশ্নের জবাবে প্রয়াত সাহিত্যিকের একসময়ের বন্ধু ও সহকর্মী হুমায়ূন বলেন, "কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।

" দৃশ্যত হুমায়ূন এ মন্তব্য করেছেন হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসটি নিয়ে। লেখক এতে একটি ধর্মশ্রয়ী রাজনৈতিক দল ও একাত্তরে তাদের ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের এমন বক্তব্যে বিস্মিত আজিজুল হক। তার ভাষায়, "এ ধরনের মন্তব্য উনি (হুমায়ূন) করেছেন; তা বিশ্বাস করা কঠিন। বর্তমান বাস্তবতায় এ ধরনের মতামত ১৫ কোটি মানুষের দিকে তীর ছুড়ে দেয়ার মতো।

" শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলচ্চিত্র নির্মাণেও সমান সফল হুমায়ূনের বক্তব্য সম্পর্কে প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, "এসব বক্তব্য এতোই তুচ্ছ ও হাস্যকর যে এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। মন্তব্য করে এসব লোককে গুরুত্বও দিতে চাই না। " ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, "সহকর্মী হিসেবে বলতে পারি, হুমায়ুন আজাদ কখনোই স্বার্থ বা টাকা পয়সার মোহে কিছু করেননি। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা যেসব কুৎসিত কাজ করেছে, সেটাই তুলে ধরেছেন হুমায়ুন আজাদ। এখন যদি তার মৃত্যুকে এভাবে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক।

" 'শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। উনার অপরাধ কী ছিল'- সমকালের এ প্রশ্নের জবাবে হুমায়ূন বলেন, "উনাকে কেউ তো খুন করেনি। উনিতো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। ওনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহী কথাটা ভুল ইনফরমেশন।

তার বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা হয়নি। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটিই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, পুরোটাই ছিল একটা সাজানো খেলা। ..." "বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা- বড় কোনো সমস্যা এখনো হয়নি। জনগণ যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদীদের নির্বাচন করে, তাহলে গণতান্ত্রিকভাবে কি তাদের বাদ দেওয়া যায়? হোক না তারা মৌলবাদী। " হুমায়ূনের এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ছিল না- এটা হুমায়ূন বলেছেন অজ্ঞতা থেকে। জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ছিল, আমিও একজন আসামি ছিলাম। " "জাহানারা ইমামের বিষয়টি সাজানো খেলা- এই মন্তব্যও অত্যন্ত আপত্তিকর। ওই আন্দোলনের জন্য ওনাকে পুলিশ রাস্তায় পিটিয়েছে, হাসপাতালে যেতে হয়েছে। " বাংলাদেশে লেখকদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে শাহরিয়ার কবীর বলেন, "তিনি (হুমায়ূন) নিজে স্বাধীন হতে পারেন।

কারণ তিনি সবসময়ই এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে কথা বলেন। " হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হুমায়ূন আহমেদের কথা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছে কি না- সন্দেহ হচ্ছে। " লেখক ও শিক্ষক আজফার হোসেন বলেন, "লেখকের স্বাধীনতা সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ ভুল বলেছেন। তিনি ইতিহাসের দিকে তাকাননি এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও জানেন না।

কত লেখককে যে কত সময় হত্যাসহ নানারকম হুমকি দেওয়া হয়েছে তা তিনি জানেনই না। কারণ তিনি একটা বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাস করেন এবং এস্টাবলিশমেন্টের একজন ভাড়া-খাটা লেখকের মতোই কথা বলেছেন। এতে আমি আশ্চর্য হইনি। " 'দুর্মূল্যের বাজারে বাংলাদেশের মানুষ এখন কেমন আছে'- এ প্রশ্নের জবাবে সুইডেনে বসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন বলেন, "সবাই খুব ভালো আছে। বিশ্বের সব জায়গাতেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি।

এখনো বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের যে কোন জায়গার চেয়ে কম। " 'বাংলাদেশের বর্তমান সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন'- জানতে চাইলে সমকালকে তিনি বলেন, "আমি তাদের খুব ভালো দৃষ্টিতে দেখি। তারা খুব ভালো কাজ করছে। " বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার যথাসম্ভব সংবিধান মেনে চলছে এ অভিমত জানিয়ে রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে বাদ দেওয়ার বহুল আলোচিত প্রসঙ্গে এই লেখক বলেন, "এ সরকারের আগে দেশের যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে দেশের সাধারণ মানুষই বলতো, দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে দেশ পরিচালনার কথা। এটা এ সরকারের কোনো কথা নয়।

এটা বাংলাদেশের মানুষেরই কথা। " তবে এ ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একমত নন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, "জরুরি অবস্থা থেকে জনগণ সুফল পাচ্ছে না। জরুরি অবস্থা জারি রাখার মত কোনো অবস্থা দেখছি না। জরুরি অবস্থা এখনি প্রত্যাহার করা উচিত।

" আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং আলোচিত লেখকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হুমায়ূন আহমেদ একজন লেখক। সর্বোপরি উনি একজন আবেগপ্রবণ মানুষ। রাজনীতির অনেক জিনিসই ওনার কাছে স্পষ্ট নয়। উনি একজন সৃজনশীল লেখক। রাজনীতির অনেক বিষয়ই ওনার জন্য অনুধাবন করা কঠিন।

এ জন্য বিভ্রান্ত হয়েই উনি রাজনীতি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। " "মাইনাস-টু ফর্মুলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নয়। এটা জনগণের ফর্মুলা"- হুমায়ূনের এ মন্তব্যের জবাবে জনপ্রিয় এই অভিনেতা বলেন, "দু'নেত্রীর বিষয়ে দেশের মানুষ যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। কাউকে গায়ের জোরে মাইনাস করা যায় না। দু'নেত্রীকে জনগণ চায় কি, চায় না তা তো আমরা দেখতেই পারছি।

তাদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো কিছুই সম্ভব নয়। " মাইনাস টু ফর্মুলা সম্পর্কে প্রসঙ্গে শিক্ষক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, "মাইনাস টু ফর্মুলা যদি জনগণের হতো, তাহলে শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য আন্দোলন হতো না। মাইনাস করার ষড়যন্ত্র একটা মহল থেকে করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ সেই মহলেরই লোক বলে মনে হচ্ছে। " ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আরো দুই বছর জরুরি অবস্থা থাকার কথা বলেছেন হুমায়ূন, এতে করে মানুষের মৌলিক অধিকার আরও দুই বছর থাকবে না।

মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে না। একজন সৃষ্টিশীল লেখক কিভাবে এই দাবি করলেন তা ভেবে আমি আশ্চর্য হয়েছি। " ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক উল্ল¬াহ খান বলেন, "কুৎসিত জীবনের বাস্তবতা লিখতে হলে তা কুৎসিতই হবে। না লিখলে লেখক প্রতারণা করবে। মুক্ত চেতনার জন্যই হুমায়ুন আজাদ আক্রমণের শিকার হয়েছে।

" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, "এটা হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব বক্তব্য, এটা দেওয়ার অধিকার তার আছে। তবে বক্তব্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমি জোরালো দ্বিমত পোষণ করছি। বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন এটা বিশ্বাস করি না। "হুমায়ুন আজাদের লেখায় শোভন-অশোভন থাকতেই পারে। এটা তার নিজস্ব ব্যাপার।

তার জন্য যদি প্রাণ দিতে হয়, আক্রমণের শিকার হতে হয়, তাতে এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের লেখকদের যতটুকু স্বাধীনতা দরকার ততটুকু নেই। " রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "জরুরি অবস্থায় লেখকদের স্বাধীনতা কমে, এবারও তাই হয়েছে। তবে হূমায়ূন আহমেদের মতো লেখকেরা সব সময়ই স্বাধীন। তার একার জন্য যদি রাষ্ট্র থাকত এবং সেখানে আজীবন জরুরি অবস্থা থাকত তাহলে আমার কোনো আপত্তি থাকত না। " হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পর গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন মোর্চা 'মুক্তচিন্তা রক্ষা ও অগণতান্ত্রিক শক্তি প্রতিরোধ হুমায়ুন আজাদ মঞ্চ' এর অন্যতম সংগঠক আহমেদ মুনীরুদ্দীন তপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হুমায়ূন আহমেদের মতো লোকরাও লেখক-শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়টি বোঝেন না বলেই আমাদের দেশে সা¤প্রদায়িক শক্তি পেশী প্রদর্শনের সুযোগ পায়।

" চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক আতিকুর রহমান কয়েকদিন আগে সৌদি আরবের প্রধান মুফতির দেওয়া বক্তব্য 'লেখকদের ওপর ফতোয়া জারি করা যাবে না' তুলে ধরে বলেন, "হুমায়ূন আহমেদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, আমাদের এই বিজ্ঞানের অধ্যাপকটির চেয়ে সৌদি আরবের প্রধান ইমামও বেশি বিজ্ঞানমনস্ক। " বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হুমায়ুন আহমেদ অতীতের দিকে যতটুকু দৃষ্টি দিয়েছেন, দুঃসহ বর্তমানের প্রতি ততটাই উদাসীন থাকতে চেয়েছেন। একজন সচেতন মানুষের জন্য এটা এক ধরনের দায়িত্বহীনতা। " "স্বাধীনতার ওপর ছবি (সিনেমা) করার দাবিদার হুমায়ূন আহমেদের এ বিষয়ে আরো সচেতন থাকা উচিত ছিল বলে মনে হয়। "


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.