আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরিচয়ের রাষ্ট্রীয়করণ, রাজনীতির দেউলিয়াপনা



পরিচয়ের রাষ্ট্রীয়করণ, রাজনীতির দেউলিয়াপনা ফকির ইলিয়াস ===================================== কয়েক বছর আগে মিশিগান সীমান্তপথ দিয়ে আমরা কয়েকজন কানাডা গিয়েছিলাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল নায়াগ্রা জলপ্রপাতে কয়েকদিন কাটিয়ে আসা। যুক্তরাষ্ট্রের চেকপোস্ট পেরিয়ে কানাডার চেকপোস্ট যাওয়ার পর শুধুমাত্র গাড়ির নম্বর প্লেট এবং চালকের লাইসেন্স দেখার পর আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেনি কর্মকর্তারা। সন্দেহ হলে গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্কটি খুলে দেখতো তারা। কখনো কিছুই দেখতো না।

এ ব্যবস্থায় এখন আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কানাডা এবং ম্যাক্সিকো দুই প্রতিবেশী দেশে যেতে আগে মার্কিনিদের কোনো ভিসা, আইডি কিছুই লাগতো না। সে ব্যবস্থা এখন আর নেই। গ্রিনকার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্টেট আইডি-এর যে কোনো একটির ফটো আইডি এখন সঙ্গে বহন করার বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। ভিসার প্রয়োজন নেই যদিও, তবু নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার অধ্যাদেশের ফলে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টির যেমন কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তেমনি আইডি বানাবার জন্য নির্দিষ্ট অংকের ফিও পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।

ইউরোপ আমেরিকাতে তো বটেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করার প্রথা চালু আছে দীর্ঘদিন থেকে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের পাশাপাশি নন ড্রাইভিং আইডি ব্যবস্থা করে থাকে সেসব দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে এভাবে দীক্ষিত করা হয়, বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট যেমন জরুরি, দেশের বিভিন্ন সামাজিক, প্রশাসনিক, নিরাপত্তার প্রয়োজনে জাতীয় পরিচয়পত্রটিও তেমনি জরুরি। বাংলাদেশে ভোটার আইডি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই নানা বিতর্ক চলছে। ইতিমধ্যে জেনেছি ভোটার আইডির কাজটি সম্পন্ন করে এনেছে নির্বাচন কমিশন।

সে আইডিটি কেমন হবে, জাতীয় প্রয়োজনে তা কতোটা কাজে লাগবে,- এর কোনো স্বচ্ছ ধারণা এখনো পায়নি দেশের মানুষ। এবং তা দেওয়াও হচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকে। জাতীয় পরিচয়পত্রের কথা বলা হলেই এর সুবিধা-অসুবিধার কথাগুলো আসে প্রথমে। এটা থেকে রাষ্ট্রের বাসিন্দারা কতোটা সুবিধা পাবে , তাও বুঝাবার বিষয়টি সামনে চলে আসে। উন্নত বিশ্বের ‘সোশ্যাল সিক্যুরিটি’ বা ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ নামক একটি প্রথা চালু আছে।

এর আওতায় সরকার প্রতিটি নাগরিককে একটি সোশ্যাল সিক্যুরিটি কার্ড দিয়ে থাকে একটি নম্বরসহ জন্মের পরপরই। যারা মাইগ্রেশন নিয়ে বাইরে থেকে আসেন, তাদেরও প্রথম কাজটি হয় এই কার্ডটির জন্য আবেদন করে তা সংগ্রহ করা। সোস্যাল সিক্যুরিটি নম্বরটির প্রথমেই প্রয়োজন পড়ে কোনো চাকরির জন্য দরখাস্ত করার বেলায়। চাকরিজীবী যে বেতন পান তা থেকে রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স বা পার্সোনাল ইনকাম ট্যাক্স কেটে নেওয়া হয় এই নম্বরের মাধ্যমে-এরই অনুকূলে। প্রতিটি ব্যক্তি নির্দিষ্ট বয়স হলে বিভিন্ন অংকের আর্থিক সুবিধা পান এই সিক্যুরিটি এডমিনিস্ট্রেশনের আওতায়।

অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিক অবসরপ্রাপ্ত হলে তিনি একটি রাষ্ট্রীয় ভাতা পাবেন, তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয় এই সোশ্যাল সিক্যুরিটি বিধানটি। চৌদ্দ কোটি মানুষের বাংলাদেশে হঠাৎ করে এমন নিরাপত্তা বিধান চালু করা কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। কিš' জাতীয় পরিচয়পত্র বানানো এবং তা বিতরণ করা মোটেই কঠিন নয়। বিশ্বে এখন চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়জয়কার। মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও আধিপত্য বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে অবাক হয়ে দেখার মতো।

কোনো দিনমজুর যে একসের চাল কিনতে হিমশিম খায়, তার হাতেও মোবাইল ফোন। এই ফোনের খরচ আসে কোত্থেকে ? এই প্রশ্ন করা মোটেও অনৈতিক নয় বলে মনে করি। মানুষের আয়ের সঙ্গে বিলাস, খরচের সঙ্গতি রাখা প্রয়োজন। তা না হলে মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেউলিয়া হতে বাধ্য। বাংলাদেশে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজনীয়তা খুবই জরুরি।

এবং তা হওয়া উচিত ছবি সংবলিত। ডিজিটাল পদ্ধতিতে অত্যাধুনিক প্রক্রিয়ায়। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি জন্ম নিবন্ধন এবং জন্মসনদ প্রদানে সরকার বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। একটি জন্মসনদ বা বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়াটা একটি শিশুর নাগরিক অধিকার। এ ব্যবস্থাটি একটি সভ্য, সুসংগঠিত এবং পরিশুদ্ধ প্রজন্ম, জাতি গঠনে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়।

একজন মানুষ বড়ো হয়ে জানতে পারে তার জন্মতথ্য। ঠিক সেভাবে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র একটি সুশৃঙ্খলিত সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আমার মনে হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রথা চালুর মাধ্যমে অপরাধকর্ম কমিয়ে আনা এবং অপরাধীকে শনাক্ত করার কাজটিও সহজভাবে করতে পারবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ক্রমশ এর বাধ্যবাধকতা বাড়িয়ে দিতে পারলে মানুষ তা একদিন বহন করায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য হবে। কম্পিউটার পদ্ধতিতে আধুনিক একটি রাষ্ট্রীয় আইডি বানানো সরকারের খুব বেশি অর্থ খরচ হওয়ারও কথা নয়।

নাগরিকগণ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে তা নিতে পারেন কিংবা পারবেন। আসছে ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল ক্রমশই কমে আসছে বলা যায়। আমরা দেখছি বেশ কিছু নতুন গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করছে এই সরকার। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার শুনানির মাধ্যমে দ্রুত জামিন পেয়েছেন আদালতে। ওয়ান-ইলেভেনের পর এমন নজির আমরা এই প্রথম দেখলাম।

মেয়র খোকা তার সম্পদের সঠিক হিসাব দেননি। এই তার অপরাধ ছিল। এরকম অপরাধী আরো অনেকের ভাগ্যে ঘটেছে ভিন্ন ব্যবস্থা। জামাতের আলী আহসান মুজাহিদসহ আরো বেশ কিছু সিনিয়র রাজনীতিক এখনো রয়ে গেছেন বাইরে। তাদের ভবিষ্যৎ এখন ঝুলন্ত বলা যায়।

কী হবে কেউ জানে না। র্ব্তমান সরকার তাদের কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তবে জনগণ যা প্রত্যাশা করছেন, তা হচ্ছে রাষ্ট্র ও মানুষের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করে যেতে হবে। এই দেশে রাজনীতিকে যারা দেউলিয়া করেছেন, তাদের কারো মেরুদণ্ডই আজ সোজা নয়। এর দায় সিংহভাগ রাজনীতিকদের।

তাই তা কাটিয়ে উঠতে একটি সৃষ্টিশীল মানব সমাজ দরকার। প্রয়োজন, নতুন ভাবনার সংযোজন। জাতীয় পরিচয়পত্র প্রথা চালু, সংবাদ মাধ্যমে সৃজনশীল স্বাধীনতা দিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, আইডি ফিল্ডে নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা ও চাকরির ভিত মজবুত করার মধ্য দিয়ে সরকার তাদের শেষ দিনগুলো স্মরণীয় করে যেতে পারেন। সবই নির্ভর করছে তাদের সদিচ্ছার ওপর। ৯ জুলাই ২০০৮ ---------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ।

১২ জুলাই ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।