একটি নির্মম গণধর্ষণের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এমন অভগা ছিল অনেকেই। আমি তাদের ব্যাথা জানিনা। নিশ্চয়ই আমার মতো নয়। যু্দ্ধকালীন বাস্তবতা মানুষকে অনেক সহনশীল করে।
যুদ্ধের স্মৃতি আমার নেই । তাই যুদ্ধ , রাজাকার, যু্দ্ধাপরাধ এসব নিয়ে আমি আপ্লুত হইনা। আমি বর্তমান নিয়ে থাকি। আমি সহনশীলও নই। একবার একজন বীরপ্রতিক যুদ্ধের কথা বলতে বলতে কেদেঁ ফেলেছিল ।
আমি অবাক হয়েছিলাম। কিছুতেই তার আবেগের জায়গাটা বুঝতে পারিনি। মনযোগী শ্রোতা হিসেবে বন্ধুমহলে আমার সুনাম আছে। সেদিন আমি মনযোগী শ্রোতার ভুমিকাটাই শুধু পালন করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এত আবেগের কিছু নেই।
ঐ রকম একটি বাস্তবতায় যু্দ্ধ করে সবকিছু হারানোটাই স্বাভাবিক। এতে বীরত্বের কিছু নেই। যারা বিরোধীতা করেছিল তারাও স্বাভাবিক আচরনই করেছিল। কারন চিরকালই কেউ কেউ প্রতিবাদ করবে কেউবা চুপটি করে ঘাপটি মেরে থাকবে। পরাজিতদের নিয়ে এত তর্ক-বিতর্কের কিছু নেই।
আজ যখন অফিসে আসছিলাম তখন সিএনজি ড্রাইভার একটি মানবজমিন পত্রিকা কিনলো। আমি তাকে বললাম আপনি পরে পড়েন। এই বলে হাতে নিয়েই দেখলাম। ধর্ষণকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। আমি বিরক্ত হলাম।
কারন জাতিসংঘের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই বললেই চলে। এটিকে আমি নপুংসক সংঘ হিসেবেই জানি। বড়জোর এই সুত্র ধরে আমাদের দেশে যুদ্ধের সময় যারা ধর্ষিতা হয়ে এখনো বেচেঁ আছেন। তারা আরো একবার আন্তর্জাতিক আদালতে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এর বেশি কিছু নয়।
মনে পড়লো সেই মহিয়সী ভাস্করের কথা। যেদিন আমি তাকে প্রথম দেখি। কেন জানি ভয়াবহ নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিল তাকে। তার বাড়ির উঠানে নানারকম ভাস্কর্য আর লতা পাতার গাছ। সে লতা পাতার ছোয়াঁ নিয়ে নিয়ে অন্যমনস্ক হাঁটছিল।
এই মুহুর্তে মনে পড়ে গেল একজন সুন্দর বন্ধুর কথা। আমার সেই বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধর্ষণের সাক্ষি হয়ে অবশেষে পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেই বন্ধুটিকে আদর করে শ্রীলংকান বলতাম। ও ছিলো ভীষন কালো অথচ সুন্দর এক মানুষ। পাচঁ বছর পর তার সাথে সাভার টু ঢাকার একটি বাসে আমার দেখা হয়েছিল ।
সে বলেছিল তার বান্ধবীকে যখন ধর্ষণ করা হলো তখন সে তার পাশেই ছিল। চিৎকারও করতে পারেনি। কারন ধর্ষকরা তাকে আটকে রেখেছিল। এই দৃশ্যের সাক্ষি হওয়ার অপরাধে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়। এখনো তাকে মানসিক ডাক্তারের মেডিসিন চালাতে হচ্ছে....
আমি যদিও এমন ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী নই তবুও কেন জানি সেই ব্যাথা বোধ হচ্ছে।
এরকম ব্যাথা নিয়ে অফিসের লিফট থেকে ৭ তলায় নামতেই দেখা হয়ে গেল এডভোকেট এলিনা খানের সাথে। আলোচিত মানবাধিকার কর্মী । বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পরিচালক। লিগ্যাল সেবা দেয়াই তার সংগঠনের কাজ। তবে সমস্যা এখানেও রয়েছে।
প্রকল্প ভিত্তিক কাজ হওয়ায়। ফান্ড পাওয়ার বিষয়টিই এখানে বেশি গুরুত্বপুর্ন। এসব সংস্থার জেলা পর্যায়ে একটি উইং থাকে। সেখানে বেতন দিয়ে কিছু নামকরা এডভোকেটও রাখা হয়। পেশাগত কারনেই জেনেছি তারা কোনরকম সহযোগীতা করেনা অপারগ ভিকটিমদের।
স্ট্রেনদেনিং গুড গর্ভানেন্স বাই দা এনফোর্সমেন্ট অব হিউম্যান রাইটস নামক এক প্রকল্পের মনিটরিং এন্ড ইনভেস্টিগেশন অফিসার যিনি কিনা টাঙ্গাইল জেলার দায়িত্বে ছিলেন । তিনি আমাকে জানালেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলার মধ্যে যেসব মামলা বাদি চালাতে পারবেন না ওসব বাদিদের আইনী সেবা দিবে এই সংস্থার এডভোকেটরা। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে এক জেলায় কমপক্ষে ৫টি মামলা চালাতে হবে। কিন্তু ঘটনা ভিন্ন প্রতি মাসে পুরো জেলায় ৫টি মামলাও হয়না। এর অর্থ এমন নয় যে, দেশে এখন আর নারী নির্যাতন হচ্ছেনা।
নারী নির্যাতন হয় কিন্তু পুরুষ শাষিত সমাজে পুরুষের সহযোগীতা ছাড়া এসব মামলা দায়ের করতে পারেন না তারা। নির্যাতন হলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবেই তা মিটিয়ে ফেলা হয়। নারীর সামাজিক ইজ্জত বাঁচানোর নামেই। কিন্তু পাচঁটি মামলা না হলে প্রকল্পের ভিত্তি থাকেনা। তাই থানার তদন্তকর্মকর্তার করা পুরনো মামলার তদন্ত কপি এবং মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন এমনকি পুরনো প্রতিবেদনও একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আপডেট দেখিয়ে চালানো হয়।
আসল কথায় আসি সেই এলিনা খানের সাথে আমার দেখা। আমি তখন অফিসে ঢুকবো আর তিনি সেই লিফটে নীচে নামবেন বলে অপেক্ষা করছেন। তা তিনি যত খুশি ততই নীচে নামতে পারেন আমার তাতে আপত্তি নেই। আমি তাকে সেখানেই ধরলাম। আপু আমার কিছু জরুরী আলাপ আছে আপনার সাথে।
এখন্ই বলতে চাই। তাকে জানালাম হাসপতালের ছাদে ঘটে যাওয়া সেই গণ ধর্ষণটির কথা। তাকে এও বললাম যে শাহবাগ থানায় এই মামলাটি করা হয়েছে। মামলা নং ৩৯ তারিখ, ১৬/০৬/২০০৮। লিফট থেমে আছে।
তিনি থেমে থাকা লিফটের গুরুত্বটা ভালোই বুঝলেন বলে মনে হোল। মুচকি হাসি দিয়ে উঠে পড়লেন। সেই সৌজন্য করা মুচকি হাসির অর্থ আমি করতে পারিনি। তাই লিফট থামিয়ে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোর বৃথা চেস্টা করলাম। তিনি ফোনে কথা হবে এই জানিয়ে নেমে গেলেন।
নামতে থাকুন। আমরা সাংবাদিকরা কি কম নেমেছি। প্রতিমাসে এলিনার সংস্থা থেকে টাকা খাচ্ছি। তাছাড়া মিডিয়া কাভারেজ দেয়ার জন্য একাধিক সাংবাদিক এলিনা খানের মামলা গুলোকে হাইলাইট করে থাকে। তার কারন একটাই টাকা..টাকা...আর টাকা।
দু একটি মামলা তিনি সত্যি সত্যি মন দিয়ে করেন। তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনা। সংগঠনটিতো বাচিঁয়ে রাখতে হবে। তবে তারও মাঝে মাঝে মিডিয়া কাভারেজ প্রয়োজন হয়। তাই সাংবাদিকদের মুচকি হাসি দেয়া এও হতে পারে।
দুদিন পার হয়ে গেছে । কোন ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা প্রিন্ট মিডিয়া বিষয়টির ফলোআপ করেনি। আমিও আর ধর্ষিতার ফোন পাইনি। কেন জানিনা গত দুদিন তাকে ফোন দেইনি আমিও। তিনি এখন কেমন আছেন? (চলবে...)
লেখকের মন্তব্য:
হয়তো তিনিও হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
মিডিয়াও চেপে গেছে হঠাৎ করেই। থানা থেকে অনেক বড় বড় ক্রাইম রিপোর্টারেইতো খোরাকী আসে! আর এলিনা খান? তিনিও মিডিয়াতে আসবেন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর রিপোর্ট প্রকাশ করতে। করবেনও। আমরা যারা ব্লগার তারাও ব্লগ লিখতে থাকবো। কেউ কেউ পড়বে।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এক কদমও এগিয়ে আসার চিন্তা করবে না। স্বপ্নবাজদের জন্য থাকবে পরের পর্ব । যারা স্বপ্ন দেখাবে তাদের লাল সালাম। আর আমি আছি, এই শহরের এক বিব্রত ফড়িং। ... উড়বো....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।