আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

পারভেজ

প্রিয় দেশবাসী, জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। ২০০৭-এর ১২ জানুয়ারিতে এক অনিবার্য পরিবর্তনের পটভূমিতে আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আজ প্রায় ১৬ মাসের সংস্কার কার্যক্রমের ভিত্তিতে আমরা কাঙিক্ষত রাজনৈতিক উত্তরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনা করা। নির্বাচনোত্তর একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা করা।

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা। আপনারা জানেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ছিল সকল রাজনৈতিক দলের অভিন্ন দাবি। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা দ্রুত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজটি সম্পন্ন করি এবং এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরিতে আত্মনিয়োগ করে। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য আমি নির্বাচন কমিশন, সশস্ত্রবাহিনী, মাঠ প্রশাসন ও উন্নয়ন সহযোগীবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

একই সাথে এই ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডকে সাফল্যমণ্ডিত করার প্রয়াসে সার্বিক সহায়তা ও সমর্থনের জন্য দেশবাসীর প্রতি জানাচ্ছি সবিশেষ কৃতজ্ঞতা। একটি অর্থবহ, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার অন্যতম প্রধান শর্ত হল কালো টাকা ও পেশীশক্তি দমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান পরিচালনা, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও গতিশীল করে তোলা। আপনারা জানেন, আমাদের সরকার আপোষহীনভাবে এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে; এবং একটি নির্বাচন-উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে ইতোমধ্যেই বহুলাংশে সাফল্য অর্জন করেছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের তরফ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে আমি সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে চাই। আগামী ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের যে কোনো দিন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্বাচন কমিশন যথানিয়মে নির্বাচনী তফসিল মোতাবেক ঘোষণা দেবে। আশা করি, এরপর সাধারণ নির্বাচন নিয়ে সকল প্রশ্ন, সন্দেহ ও সংশয়ের অবসান হবে। ডিসেম্বরের পর নতুন বছরের সূর্য একটি নির্বাচিত ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকেই স্বাগত জানাবে। এবং সেটা সম্ভব করে তুলবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ, সহযোগী রাজনৈতিক দলসমূহ, সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও শুভবুদ্ধিপরায়ণ নাগরিক সমাজ। আমরা এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত।

আমাদের লক্ষ্য, পূর্বঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে টেকসই গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা। তবে এ কথা সত্য যে, এ লক্ষ্য অর্জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন একটি অভিন্ন জাতীয় ঐকমত্য। সে বাস্তবতার আলোকে রাজনৈতিক দলসমূহ এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় সংলাপের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা মূল সংলাপের পূর্বে ২২ দিনব্যাপী প্রাক-সংলাপ সম্পন্ন করেছি।

সরকারের ৫ জন উপদেষ্টা এ ব্যাপারে নিরলসভাবে ও নিবিড় বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রাক-সংলাপের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। আমরা প্রাক-সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থার ভিত্তি নির্মাণে আমাদের আন্তরিক আগ্রহের বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছি বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সরকারের এই ৫ জন উপদেষ্টা সকল রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে মূল সংলাপের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও গৃহীতব্য বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে মতামত গ্রহণপূর্বক আমার নিকট সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন। এই প্রেক্ষিতে আমি ঘোষণা করতে চাই, আগামী বাইশে মে থেকে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপে বসবো। সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে আমার দফতর থেকে আগামীকাল থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি যাবে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঐতিহাসিক এ সংলাপে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। যাতে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশা এবং সর্বস্তরের জনগণের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। এ কথা অনস¦ীকার্য যে, সূচিত এই জাতীয় ঐকমত্যকে একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও স্থায়িত্ব দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে সরকার, রাজনৈতিক দল, সকল শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রণীত ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই ‘জাতীয় সনদ’-এর মাধ্যমেই স্থাপিত হবে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনী অবকাঠামো।

সূচিত হবে একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ধারা। প্রিয় দেশবাসী, আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি, নির্বাচনকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে সরকার একাধিক কার্যক্রম সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত সংশোধিত নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধান শীঘ্রই জারি করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এসব নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স¦প্রণোদিতভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করছি। সরকারের এই গৃহীত পদক্ষেপের সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকরী সম্পূরক ভূমিকা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

জাতি প্রত্যাশা করে, কালো টাকা, পেশীশক্তি, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব, মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রচারাভিযানে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়সহ সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত করা এবং আইন-শৃংখলার পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে নির্বাচন-উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দল সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছবেন। প্রিয় দেশবাসী, জাতীয় নির্বাচনের আগেই কিছু পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই ব্যক্ত করেছে। তাছাড়া উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানও তাদের কর্ম-পরিকল্পনায় আছে। জনগণের কল্যাণে দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী করতে উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক- এটা সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সরকার চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে সকল প্রকার সহযোগিতা দেবে।

তবে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের এই উদ্যোগ কোনো অবস্থাতেই আমাদের প্রধান লক্ষ্য অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে বিঘœ ঘটাবে না। জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা থাকব আপসহীন। আমরা শুধু আশা করব, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বৃহত্তর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল আবহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তন করা ছাড়া আমাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে পর্যবসিত হবে। সে লক্ষ্যে আমাদের প্রথম কাজ রাজনীতির গুণগত উত্তরণের সকল বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হওয়া।

এ বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর স¦প্রণোদিত অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন আশা করি। জাতি আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ, সৎ, যোগ্য এবং গতিশীল নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা সৃষ্টির জন্য প্রত্যাশিত সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও কার্যকরী সম্পর্ক জনগণ অকুণ্ঠচিত্তে কামনা করে। রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সকল কার্যকলাপে সুস্থ ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার প্রবর্তন ও তা অক্ষুণœ রাখার বিষয়ে ঐকমত্যের অপরিহার্যতা সকলেই উপলব্ধি করবেন বলে আমি আশা করি। প্রিয় দেশবাসী, নির্বাচন-পরবর্তী সংসদ কার্যকর করার ঐকমত্য নির্বাচনের আগেই প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।

এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাবনা ইতিমধ্যেই আলোচিত হয়েছে। কেউ নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করবে না, সংসদ বয়কট করবে না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমি আশা করবো, সংলাপে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ জনস¦ার্থে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার করেছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং প্রয়োজনে আরও এগিয়ে নেওয়ার দায়বদ্ধতা উপলব্ধি করতে হবে। সে ব্যাপারে প্রস্তাবনার মাধ্যমে ঐকমত্যে উপনীত হতে হবে।

একথা আজ সর্বজনবিদিত, দুষ্ট রাজনীতির একটি অন্যতম উৎস হচ্ছে লেজুড় রাজনীতির অপসংস্কৃতি। যে শুভ উদ্দেশ্যেই অঙ্গ সংগঠনের জন্ম হয়ে থাকুক না কেন, আজকের রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ অঙ্গ সংগঠন আদর্শহীন লেজুড় রাজনীতির অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। রাজনীতিকে এই অপসংস্কৃতি থেকে উদ্ধার করে সুস্থ ধারা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে এর গুণগত উত্তরণ আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। সংলাপের মধ্য দিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনুধাবন ও সুস্পষ্ট সমাধান আমাদের বের করতে হবে। প্রিয় দেশবাসী, বর্তমান বিশ্ব অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং দ্রুত অগ্রসরমান।

বিশ্ব¦ অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে হতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক। প্রতিটি দিন, প্রতিটি কর্ম-ঘণ্টা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে যে, আমরা সকল প্রকার নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিত্যাগ করব। চির অবসান ঘটবে হরতাল, অবরোধ ও সহিংস বিক্ষোভের। জাতি ভবিষ্যতে কোনো প্রকার নৈরাজ্যমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখতে চায় না।

এখানে আমি আরেকটি বিবেচ্য বিষয় তুলে ধরতে চাই। ক্ষমতাকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকীকরণের প্রবণতা বিগত দিনে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি পেয়েছে। দুঃখের বিষয়, দলীয়করণের এই অসুস্থ সংস্কৃতি কোনো অর্থেই জাতির জন্য শুভ নয়। যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে প্রশাসন পরিচালনা একটি সার্থক শাসন-ব্যবস্থার অপরিহার্য দিক। সকল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ বিষয়ে আজ গভীরভাবে ভাবতে হবে।

আমি আশা করবো, সংলাপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে কার্যকর সমাধান ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আপনারা জানেন, ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এর পূর্ববর্তী নৈরাজ্যমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারণ ছিল আইনের শাসনের ভয়াবহ অবক্ষয়। আমাদের সরকার আইনের শাসন কায়েম করার ক্ষেত্রে আপোসহীন ভূমিকা পালন করছে। আপনাদের সকলের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থনের জন্যই সম্ভব হয়েছে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। এজন্য আমি সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং আপামর জনসাধারণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

প্রিয় দেশবাসী, আপনারা সকলেই একমত হবেন যে, আমাদের সরকার দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা না করলে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে জনগণ হয়তো পুরোপুরি অবগত হতে পারত না। দুর্নীতি জাতীয় অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু। দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র থেকে আমাদের যে কোনো মূল্যে বেরিয়ে আসতে হবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের সকলকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমি আশা করি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং সকল শ্রেণী-পেশার জনগণ এমন প্রস্তাবনা রাখবেন যাতে ভবিষ্যতে সকল দুর্নীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষমতার বিন্যাসের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে ভারসাম্যের অভাব। অত্যধিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা স্থিতিশীল ও দায়িত্ববান শাসন ব্যবস্থার জন্য মোটেও সহায়ক নয়। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদগুলোর মধ্যে কী ধরনের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শুভ ভূমিকা রাখতে পারে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তৈরি ও সেক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সংলাপের একটি অন্যতম প্রধান অর্জন হতে পারে। আমি আশা করবো সকল পক্ষ এ বিষয়ে তাদের মেধা ও মনন খাটিয়ে সরকার ব্যবস্থা ও রাজনীতির গুণগত উত্তরণের পথে জাতিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একথা অনস¦ীকার্য যে, আজ জাতি নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের সার্বিক স্থিতিশীলতা কায়মনোবাক্যে কামনা করে।

ক্ষমতার ভারসাম্য, আইনের শাসন, সুস্থ রাজনীতি, কার্যকরী সংসদ, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থার অনুষঙ্গ মাত্র। এ সকল অনুষঙ্গকে ধারণ করার মতো একটি অবকাঠামো বা রূপরেখা থাকা আবশ্যক। এমন একটি অবকাঠামো বা রূপরেখা যা জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে জাতিকে সবসময় ঐক্যবদ্ধ রাখবে। রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে তা কোনক্রমেই যেন স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমি সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন এবং আপামর জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি- আসুন, আমরা পরবর্তী সরকারগুলোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এমন একটি অবকাঠামো বা রূপরেখা তৈরি করি, যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা সর্বদা অটুট থাকবে।

এ বিষয়ে আপনাদের সকলের প্রজ্ঞালব্ধ প্রস্তাবনা ও ঐকমত্য আজ জাতির একান্ত কাম্য। আমরা আশা করছি, রাজনৈতিক দলগুলো খোলা মন নিয়ে আসন্ন সংলাপে অংশ নেবে। আমি আশ্বাস দিতে পারি, সরকারের কোন পূর্ব-নির্ধারিত এজেন্ডা নেই। কারো বিরুদ্ধে বৈরীভাবও নেই। রয়েছে সমঝোতা-উন্মুখ মুক্ত মন।

রাজনৈতিক অঙ্গনের যাবতীয় সমস্যা, সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয় বিষয়ে তাদের মতামত রাজনৈতিক দলগুলো খোলাখুলিভাবে তুলে ধরবেন। রাজনৈতিক কাঠামোর গুণগত উত্তরণের লক্ষ্যে গঠনমূলক প্রস্তাব রাখবেন। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকদের অংশগ্রহণ সহজতর করতে এবং আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ করে দিতে আমি আগামীকাল থেকেই সারাদেশে ঘরোয়া রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছি। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য নিঃসংকোচে এবং মুক্তভাবে রাজনৈতিক কর্মীদের চলাফেরা, সভা অনুষ্ঠান, অন্যান্য পন্থায় প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে নির্বিঘেœ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনাক্রমে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে, যার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে কমিশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রাসঙ্গিক এসব বিষয় বিবেচনায় এনে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী যথাসময়ে জরুরি আইন ও বিধিমালার সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহ স্থগিত বা শিথিল করার ব্যবস্থা নেবে। নির্বাচনকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করতে যা যা করা প্রয়োজন তার সবকিছু করতে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রিয় দেশবাসী, সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা যে সফল হতে পারি, তার নিকটতম উদাহরণ হল দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো তিনটি প্রধান খাদ্যশস্য বোরো ধান, গম ও আলু উৎপাদনে রেকর্ড। এই বাম্পার ফলনের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছি, সদিচ্ছা ও উদ্যোগ থাকলে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি।

এই বিশাল অর্জনের জন্য আমি সরকার ও জাতির তরফ থেকে কৃষকসমাজকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। এই অর্জনের পেছনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মাঠ প্রশাসন ও সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ। আমি আশা করছি, আগামী আমন মৌসুমেও কৃষিখাতের এই নবজাগরণের ধারা অব্যাহত থাকবে। সরকার বিভিন্নমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষককে সকল প্রকার সহায়তাদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রিয় দেশবাসী, সংলাপ এক অর্থে একটি বিশ্বাস-নির্ভর উদ্যোগ।

আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, বৈরিতা থাকতে পারে, প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, কিন্তু শেষ বিচারে এগুলোই আমাদের মুখ্য পরিচয় নয়। জাতি আমাদের সকলের কাছে আশা করছে একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল উত্তরণ। এই পথে এগুতে হলে আমাদেরকে সংকীর্ণতা, প্রতিহিংসা ও অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। আমি জানি, এসবের ঊর্ধ্বে উঠার সেই সাহস আমাদের আছে। এই সাহস প্রকাশ করার এখনই সময়।

আমাদের পেছনে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রিয় মাতৃভূমির পনেরো কোটি মানুষের প্রতিটি হৃদয়ে সময়ের বাস্তবতায় আজ অপ্রতিরোধ্য স¦প্ন জেগেছে। এই স¦প্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্তরণের, বিশ্বদরবারে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান উদ্ভাসিত জাতীয় পরিচয় নিয়ে দাঁড়াবার। প্রিয় দেশবাসী, নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায় দেশের সাধারণ জনগণের ভূমিকাকেই আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আমরা অতীতের দলীয় রাজনীতির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে আর ফিরে যেতে চাই না।

আমরা দেশের সরকার ও রাজনৈতিক কাঠামোয় গুণগত ও অর্থবহ পরিবর্তন চাই। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাতে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব্ জনগণকেই নিতে হবে। নির্বাচনে যাতে সৎ, যোগ্য, জনকল্যাণে নিবেদিত, দেশপ্রেমিক, মেধাবী ও দক্ষ প্রার্থীরা জয়যুক্ত হয়ে জাতীয় সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, সেটাও আপনাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একটি আলোকিত ভবিষ্যৎ নির্মাণের চাবিকাঠি জনগণ, অর্থাৎ ভোটদাতাদের হাতেই গচ্ছিত থাকে। আমি আশা করবো, দেশের সকল ভোটার নির্বাচনের দিন তাদের এই সাংবিধানিক দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালন করবেন।

নিজের ভোটাধিকারের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সৎ, দেশপ্রেমিক, স¦চ্ছ ও সত্যিকারের জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় আমরা নিশ্চিতভাবে সাফল্য লাভ করবো, ইনশাল্লাহ্। দেশমাতৃকার জন্য এক সোনালী ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচনে আগ্রহী রাজনীতিবিদদের জন্যও আগামী নির্বাচন সুবর্ণ সুযোগ এনে দিচ্ছে। আমি আশা করবো, প্রবীণদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের সৎ, যোগ্য ও উদ্যমী নাগরিকেরা এই সুযোগের যথাযথ সদ্ব্যবহার করবেন। প্রিয় দেশবাসী, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমি আশাবাদী, আমাদের লক্ষ্য যখন এক ও অভিন্ন, তখন মত ও পথের আপাত-পার্থক্য সৌহার্দ্যমূলক আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে আমরা দূর করতে পারবো। গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, মূল্যবোধ ও বিধি-বিধান এদেশের মাটিতে আমাদেরকে অবশ্যই প্রোথিত করতে হবে।

এবং তা যেন হয় চিরস্থায়ী। এই টেকসই ব্যবস্থা যেন শত প্রতিকূলতা ও বাধা-বিঘেœর মুখেও আমাদের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বকে বিশ্বমঞ্চে সগর্বে প্রচার করে, তা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। শেষ করার আগে আমার আজকের বক্তব্যের কয়েকটি কথা পুনরুল্লেখ করতে চাই : ১। এ বছর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেই নবম জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২।

আগামী বাইশে মে থেকে আমরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করবো। ৩। আগামীকাল থেকে দেশব্যাপী ঘরোয়া রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। ৪। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচনী প্রচারণা সহজতর করার জন্য আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী যথাসময়ে জরুরি আইন ও বিধি-বিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা স্থগিত বা শিথিল করবো।

৫। নির্বাচনের পূর্বেই সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের প্রয়াস নেয়া হবে, যাতে করে নির্বাচনের পরে সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত উত্তরণ ঘটে। সংলাপকে সফল করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এক কথায় বলতে গেলে এখানে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। আকাঙক্ষার দিক থেকে জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ।

এখানেই আমাদের মূল শক্তি। ২০০৭ সালের এগারোই জানুয়ারিতে যে যাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম, তার সফল পরিণতি আমাদের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাঙিক্ষত লক্ষ্যে আমরা অবশ্যই পৌঁছব। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বছরের শেষে আর থাকবে না। কিন্তু রয়ে যাবে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

আমরা প্রবলভাবে আশাবাদী, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের আজীবন লালিত স¦প্ন ও আশা-আকাঙক্ষা একটি বাস্তব রূপ পাবে। সেই আলোকিত ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.