আমাদের দিন কাটতে লাগল। আর সব ভেতো বাঙালির মতই আটপৌরের জীবন। নাহ ! একটু ব্যতিক্রম। যেহেতু বাবু মাসের প্রথম কুড়ি দিন সাইটে থাকত বাকি দশ দিন আমরা বেশ ঘুরে টুরে বেড়াতাম।
একা থাকতে খুব একটা খারাপ লাগত না।
বরং মনে হত ভালই, প্যান প্যানে স্বভাবের ছিলাম না, যেকোন পরিস্হিতিতে মানিয়ে চলতে পারি। যেহেতু আমার কোন অসুবিধা হত না বা হলেও আমি লোকজনের কাছে বলতাম না, এই নিয়ে চিরায়ত বাঙালিরা (খুব বেশি না) মনে মনে একটু রাগ ছিলেন আমার প্রতি! আড়ালে আবডালে আহা উঁহু করতেন আমার জন্য, অবশ্য উনাদের মনোভাবের পরিবর্তন হয় আমি প্রেগন্যন্ট হওয়াতে। সবাই আগ বাড়িয়ে আসতেন খোঁজ খবর করতেন।
তখন আবার আমার লজ্জাই লাগত। আমার খাবার দাবারে রুচি নষ্ট হয়ে যায়।
কোন কিছুই মুখে দিতে পারিনা,তাও জোর করে দুধ, ডিম আর পোলনি(সসেজের মত) খেয়ে দিন রাত পার করে দিতাম। যাইহোক তখন এক ভাই ভাবি আমাকে উদ্ধার করলেন। উনারা আমাদের বাসায় এসে ছিলেন। ভীষণ আদর করতেন আমাকে। উনাদের মহানুভবতা জীবনেও ভুলবনা।
আমৃত্য মনে রাখব। আর ভাবির রান্না! কি যে মজা, এখনও মনে হয় স্বাদ পাচ্ছি।
আমার মেয়েটা হওয়ার পর কয়েক মাস কোথা দিয়ে কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি। বাচ্চা নিয়ে আমি এত ব্যস্ত ছিলাম অন্যদিকে মন দেওয়ার সময়ই ছিল না। সে সময় বাবু এক মাসের ছুটি নিয়েছিল।
আমাকে খুবই সাহায্য করেছে বিশেষ করে বাচ্চার গোসলে। আমিতো ভয়েই অস্হির থাকতাম এই বুঝি পানিতে (বিরাট গামলায় গোসল করানো হত) ডুবে গেল! এক মাস পরে বাবুর চাকরি যথারীতি চলছিল। মেয়েটার সাত মাস হলে আমরা জিম্বাবুইতে ভিক্টোরিয়া ফল্স দেখতে যাই।
গ্যাবোরোন থেকে ট্রেনে করে একদম ভিক্টোরিয়া ফল্স! বেশ সময় লেগেছিল। সারারাত ট্রেনে সকালে সীমান্ত শহর বুলাউয়ো, জিম্বাবুই।
বুলাউয়োতে এক ভদ্রলোক ওখানকার ভার্সিটির টিচার আমাদেরকে এসে উনার বাসায় নিয়ে গেলেন(গ্যাবোরোন থেকেই যোগাযোগ করা ছিল)। ভাইয়ের বাসায় খুব সুন্দর গোলাপ বাগান! কি যে ভাল লাগছিল। আমরা একফাঁকে শহরটা ঘুরে নিলাম। বুলাউয়ো সারা দিন থেকে আবার রাতে ট্রেনে চড়ে সকালে ভিক্টোরিয়া ফল্স স্টেশন! কি মজা!
মজা টের পেলাম সকালে বাবুর আর্তনাদে। কি ব্যাপার! প্রথম রাতে ট্রেনে বাচ্চা নিয়ে আমরা দুজনেই মহাব্যস্ত ছিলাম।
কারণ মেয়েটা খুব ভয় পাচ্ছিল আর বিরক্ত করছিল। একদমই ঘুমাতে পারিনি, আর ট্রেনের শোওয়ার বার্থগুলো কেমন চাপা, বাচ্চা কোলে নিয়ে প্রায় সারারাত জেগে ছিলাম। জিম্বাবুইয়ের ট্রেন বেশ বড়, একটু খোলামেলা মনে হয় ব্রিটিশ কলোনি আমলের। যার ফলে দ্বিতীয় রাতের ট্রেনে আমরা তিনজনেই ঘুমে কাত। সকালে বাবু মানিব্যাগ খুলে দেখে ডলার নাই! কি সর্বনাশ।
ভাগ্যিস ফিরতি টিকেট কাটা ছিল। না হলে বিদেশ বিভুঁয়ে টাকা পয়সা নাই, লোকের কাছে হাত পাততে হত! আমার ব্যাগে বিশ না বাইশ ডলার ছিল, সেখান থেকে সাত ডলার দিয়ে আমরা নাস্তা করলাম। রুটি আর কলা। টুরিস্টের জায়গা। অসম্ভব দাম(আসলে দাম ঠিকই ছিল নিজের কাছে টাকা না থাকাতে ওরকম মনে হয়েছে)।
দুপুরের খাবার বার্গার। ব্যস। বাড়তি কোন কিছু খেতে পারিনি, যেতেও পারিনি। বাচ্চাটার খাবার সাথে ছিল, খালি গরম পানি করে বোতলে দুধ বানানো!
আমাদের ইচ্ছা আছে মেয়েটা বড় হলে হয়ত ওকে নিয়ে আবার আমরা ফল্স দেখতে যাব, কিন্তু ততদিনে বয়স হয়ে যাবে আর মনটাও বুড়িয়ে যাবে!
স্টেশনটা অনেক পুরান। কিন্তু খুব ভাল ভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
হেঁটেই ভিক্টোরিয়া ফল্স দেখতে গেলাম। বেশ হাঁটতে হয়। আমাদের লাগেজ পত্র বেশি না, খালি জ্যান্ত লাগেজ নিয়েই সমস্যা! কখন যে সে বিগড়ে বসে! কিছুদুর হাঁটার পর আমরা পানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হচ্ছে কাপ্তাইয়ের স্পিলওয়ের মুখগুলো সব খুলে দেওয়া হয়েছে! কি ভীষণ পানির শব্দ।
এই সুযোগে মেয়েটা নড়চড়া শুরু করে দেয়।
আমি আর বাবু মুখ চাওয়া চায়ি করি। ভাগ্য ভাল কান্না কাটি করে নাই। প্রচুর টুরিস্ট চারিদিকে গিজগিজ করছে। বেশির ভাগ সাদা। সারা দুনিয়া থেকে লোক জড়ো হয়েছে।
কি অদ্ভুত জায়গা। কেমন গা ছম ছম করে। উঁচু উঁচু গাছ একদম আকাশে উঠে গেছে! নাম না জানা পাখি, মনে হয় বানরও উঁকি ঝুঁকি মারছিল। আমরা তো মেয়েটাকে বুকে সাপটে ধরে আছি। যদি বানর এসে নিয়ে যায়!
পানির শব্দ শুনতে শুনতে হাটছি, একটু পরে ফল্সের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কি সুন্দর রংধনু।
যত কাছে এগুতে লাগলাম পানির তোড়ে বৃষ্টির মত হচ্ছিলো অনেক উঁচু থেকে পানি পরছিলো, আর আমরা ভিজে গেলাম। মেয়েটাকে তোয়ালে পেঁচিয়ে ফেললাম, কারন সাথে ছাতা নাই! এরকম হবে কেউ বলে নাই। তাতে কি বেড়াতে বেরুলে কি সব কিছু হাতের কাছে পাওয়া যায়! যাইহোক, যখন ফল্সের সীমানায় আসলাম কি দারুণ! কি বিরাট জায়গা জুড়ে উপর থেকে ঝপ ঝপ করে পানি পরছে তো পরছেই। শেষ নাই। দেখতেই আছি।
বাবুর মুখেও কথা নাই। সে বরাবরই কাঠকোট্টা, আবেগ বির্বজিত! সেও হাসি মুখে চোখ নাচিয়ে বলছে তুমিতো আসতে চাইছিলে না! দেখ কি সুন্দর, মিস করতে। আমার মুখে কথা নাই। আমি হতবাক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।