কালাইয়ের মা এখন কোথায় আছে কে জানে? শেষবার দেখেছিলাম মাসখানেক আগে। চৈত্রের কাঠফাটা দুপুরের তপ্ত ফুটপাতে প্রতিদিনের মত শরীর এলিয়ে একই ভঙ্গিমায় ভিক্ষে চাইছেন। ভাবলেশহীন মুখখানি পচড়ার দঙ্গলে ভর্তি। শরীর স্থির। পাথরের মত।
পড়নে তেলচিটে শতচ্ছিন্ন সূতি শাড়ী। মুখের সামনে জাল ঘেরা একটা পর্দা। তার ভেতর পোড়া চোখ দুটি। সেই চোখের দৃষ্টি কোন পথ বা পথিকের দিকে, তা বোঝা যায় না। ফুটপাথে রাখা কাঁসার বাটি।
কিছু রেজগি জমেছে। কঞ্চিসর্বস্ব হাড্ডিকে শীর্ণ শিরায় দড়ির মতো পেঁচিয়ে থাকা হাতের তালুখানি আকাশের নীচে পেতে রাখা। তারই আঁকাবাঁকা রেখা ধরে ছুটে চলেছে পদ্মা, যমুনা,মেঘনা। দু-পাশের তীরবর্তি সভ্যতায়, কত ইতিহাস, কত গাঁও-গেরস্থালি,কত চোখের পানি।
কালাইয়ের মা বসে আছেন।
হেমন্তের কুসুম গরম ফুটপাথে। স্থির চিত্রার্পিত মূর্তি। পাথরের মত স্থবির। মোটরের ভোঁ-ভোঁ,হকারের হুক্কা-হুয়া,ট্রাফিকের হুংকার,মজুরের আর্তনাদ,ক্রমশ ছোট হয়ে আসা অতিকায় বিক্ষোভ মিছিলের লেজ - কিছুই তাঁকে টলাতে পারছে না। আকাশের নীচে পেতে রাখা তাঁর করতল।
কি মনে করে, সেই করতলে দশ টাকার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্রেসলেটটাও বিসর্জন দিলাম। সোনা রোদে ঝিক করে হেসে উঠলো রুপালি ব্রেসলেটটা। জবাবে ফাঁটা ঠোঁটখানি একটু নড়লো! চোখের পাতাদুটোও কি কাঁপলো ? টের পাইনি। অনুভূতিগুলো তো অফিস ও বাসার সীমানাতেই বন্দি। তাই গন্ডারের মতো পা চালাতেই ভুলে যাই তাদের ফন্দি।
দু পা এগুলেই ‘এখানে প্রসাব করিবেন না'-সাইনবোর্ডের চোখ রাঙ্গানি। পাশেই আবর্জনার ভাগাড়। স্যুয়ারেজের ভাঙ্গা পাইপ থেকে সূচীভেদ্য দুর্গন্ধ। সেখানকার ময়লা পানির ঠিকানা বেগুনবাড়ী খাল। আলকাতরার মতো রং।
তারই লাগোয়া কালাইদের বসতি। আসলে,অস্থায়ী বস্তি। টিউবওয়েল নেই। ওই খালই কালাইদের পানি খরচের পুঁজি।
ক্ষনস্থায়ীকে স্থায়ী করে দেয়ার কথা বলে ভোটবর্গির দল।
কালাইয়ের মত কাগজ কুড়ূনির বাচ্চারা সারাদিন ধরে শহরের গলিতস্যগলিপ্রান্ত উপত্যকা এতল্লাট ও তল্লাট করে লাট খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। লোহার আঁকশি দিয়ে হৈ-হৈ করে টায়ার চালায়। চাকার তলায় চাপা পড়ে। তা না হলে পিকেটিং করে। কচি হাতে তাই ককটেল ওঠে।
একদিন সকালে পুলিস আসে। জোর গলায় এলাকা খালি করে দিতে বলে। আর আসে বুলডোজার। ছিঁড়ে, উপড়ে, দুরমুশ করে, ছড়িয়ে, ছিটিয়ে, আগুনে, পেট্রোলে বুড়ির ঘর খাক করে রেখে দিয়ে যায়। পোড়া আলুর মত পুতুলের চুলওঠা সেদ্ধ ন্যাড়া মাথা পড়ে থাকে।
ভাঙাচোরা তক্তাপোষটাও অঙ্গার। গলে যাওয়া ফোকলা চিরুনি। কালাইয়ের মায়ের বোবা চিৎকার। আর্তি। কালাইকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
সেদিনই টিভির সুদর্শনা সংবাদ উপস্থাপিকা জানায়, খালের দু-পাড়ের কমপক্ষে একশো অস্থায়ী ছাউনি আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে গেছে। হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। দমকলের ২৭টি ইঞ্জিন সঙ্গে প্রায় দেড়শো জন কর্মী ৩ ঘণ্টার চেষ্টায় বেগুনবাড়ী খালপাড়ের আগুন নিয়ন্ত্রনে আনে। তবে ক্ষতির পরিমান খুব বেশি নয় !
তারপর থেকেই কালাইয়ের মায়ের খোঁজ নেই। জানার তাগিদও নেই।
কিন্তু সেদিন টিভিতে চোখ রাখতেই দেখলাম সাভারের ভেঙ্গে পড়া বাড়িটির কংক্রিটের মাঝে চাপা পড়া এক অভাগীকে দুঁদে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছে-এখন কেমন বোধ করছেন ! কিভাবে আটকা পড়লেন ! এতক্ষন কিভাবে কাটালেন !! ইত্যাদি।
যমের সঙ্গে লড়াই করা রক্তাক্ত মুখখানি জবাব দিতে পারেনি । আমার চোখ আটকে গেল তার পাশেই রক্ত আর বালুতে মাখামাখি রুপালি ব্রেসলেট পড়া একটা নিথর হাতে। অবশেষে চিনলাম কালাইকে ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।