বিজয় দিবসের সন্ধ্যা। বন্ধু দম্পতির পরিবারে প্রথম সন্তানের আগমনের সংবাদে তাদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য সস্ত্রীক রওনা হই। রাস্তায় রিক্সার উদ্দেশ্যে হাঁক দেই,
-যাবেন?
-কৈ যাইবেন?
-মুসলিম বাজার।
-যামু, ২৫ ট্যাকা ভাড়া লাগবো।
-কেন? ভাড়াতো ২০ টাকা।
-হেইটা ঠিক। তয় আইজ বিজয় দিবস, হের লাইগা ৫ ট্যাকা বেশি দিবেন।
-কেন? আজ বিজয় দিবস বলে আপনি ৫ টাকা বেশি নিবেন কেন? যা ন্যায্য তাই নেবেন।
-আইচ্ছা, ২০ ট্যাকা দিয়া আপনে খুশি থাকলে কতা নাই, উডেন।
রিক্সা চলছে আমরা দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছি।
মুঠোফোনে বন্ধুকে বললাম, “আমরা আসছি, বাসায় থাকিস”। হঠাৎ রিক্সাচালক হঠাৎ
হঠাৎ রিক্সাচালক বলে ওঠেন,
-আইজ তো আমরা রেকর্ড করলাম ভাই।
-কীসের রেকর্ড?
-ক্যান জানেননা! আইজকা ২৭,১১৭ জন ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রী লইয়া জাতীয় পতাকা বানাইসে। অহন দুইন্যাত আমরাই সব থেইকা বেশি মানুষ লইয়া সব থেইকা বড় পতাকা বানানি দেশ।
-আপনি তো ভালো খবর রাখেন! (তখনও জানতাম না যে আমার আরও বিস্মিত হওয়া বাকি)
-কি যে কন, এমুন খবর আবার রাখুমনা, দেশের হগ্গলে জানে।
ক্যান আইজ তো লাখ লাখ মানুষ লইয়া জাতীয় সঙ্গীতও গাইলাম।
-ভালো লাগল আপনার কথায়, কিন্তু আপনি এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন কেন? এটাতো ঘুরপথ আপনার সময় বেশি লাগবে আবার কষ্টও বেশি হবে।
-আরে সোজা রাস্তাত অনেক জাম। আহনের সময় দুই ঘন্টা লাগসে ছুট্টা আইতে।
- এই রাস্তায় এত জ্যাম কেন?
-ভাইজান দেহি কোন খোঁজখবরই রাখেননা, আইজ বিজয় দিবস বইলা সব গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়া যাইতাসে।
বহুত মাইনসে ঘুরতে বাইর হইসে, হের লাইগা এতজাম। কী করব কন, বিএনপি আর জামাতিগো জ্বালায়তো মাইনসে এতদিন ঘর থেইকা বাইর অইতে পারে নাই। মাইনসে আর কত সইয্য করবো! অতিস্ট অইয়া আইজ সবতে বাইর অইসে।
রিক্সা চলতে থাকে, আবার হঠাৎ করে তাঁর প্রশ্ন,
-আপনের কী মনে অয়, ৫ তারিখে নির্বাচনের পর বিএনপি আর কিছু করতে পারব?
- কী বলেন, সব্বাই না আসলে এই নির্বাচন কি গ্রহনযোগ্য হবে? আবার ৯৬ সালের মত হবে না? আর জামাতে ইসলাম কি মানবে? দেখেছেন দেশের কী অবস্থা?
-কী কন ভাই! দেশের এই হাল কি আপনে-আমি বানাইসি? বানাইসে বিরোধীদল। আর জামাতের কথা থোন।
তবে এইটা সত্য কোন খেলাই একলা খেইল্যা মজা নাই।
-আপনি মনে হয় সরকার পার্টি?
-ক্যান ভাই, এইটা কইলেন ক্যান? বিএনপি আর জামাতের বিরুদ্ধে কথা কইলেই কি মাইনসে আওয়ামী লীগ অয়? কই আপনেরে আমিত বিএনপি বা জামাতি কই নাই!
-আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি আরে আপনি রাগ করছেন নাকি, ও’কথা আমি কিছু ভেবে বলি নাই।
-এই সমস্যা, খালি পাবলিক কইয়া আর কিছু নাই। অইলে আওয়ামী লীগ, নাইলে বিএনপি-জামাত। আরে আমিত কোন পার্টি করি না।
যেইটা নেইয্য হেইটা কমু না!
-এটা আপনি ঠিক বলেছেন। আসলে এটাই সমস্যা। দেখেন না এখনো স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছে সেটা নিয়ে কিছু লোক অযথা বিতর্ক তৈরি করে।
- কাইজ্জা তো লাগাইবই। আমরা পড়ালেখা করি নাই, আমাগো মনে কোন প্যাছঘোছ নাই।
আর আপনেরা শিক্ষিত মাইনসেরা সোজা জিনিসরে প্যাছায়া জিলাফি বানান। এইডাতো পানির লাহান পরিষ্কার, শ্যাখ সা’বে স্বাধীনের ডাক দিসে আর জিয়ায় রেডিওত হেইটা পইড়া শোনাইছে।
-ব্যাপারটা আপনি যত সহজে বললেন আসলে বাস্তবে কি এত সহজে বলা যায়?
- ক্যান যাইব না! যেইটা সইত্য সইত্য অইসে হেইটাই বইখাতাত ল্যাখেন। বানায়া মিছা কতা না ল্যাখলেই অয়।
কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর তিনি আবার শুরু করেন,
- হোনেন, আমার ব’স অহন অ্যাকষট্টি বচ্ছর।
মুক্তিযুদ্ধের সোময় আছিলাম উন্নিশ বচ্ছরের। সরাসরি অস্ত্র লইয়া যুদ্ধ করি নাই। তয় মুক্তিবাহিনীগো কাছে পাকিস্তানী ক্যাম্পের আর রাজাকারগো খবর দিতাম। উনাগো নৌকা বাইয়া পার করসি। গেরামের বাড়ি বাড়ি থেইকা চিড়া-মুড়ি, ভাত-ডাইল যোগাড় কইরা মুক্তিবাহিনীরা যেই জাগাত পলায়া থাকতো হেই জাগাত নিয়া দিয়া আইছি।
একবার মুক্তিবাহিনীর একজন পায়ে গুল্লি খাইলে হ্যারে খাটিয়া কইরা আমি আর আমার তিন মামাতো-খালাতো ভাই মিল্যা কান্ধ কইরা তিন মাইল দূরে এক ডাক্তারের কাছে লইয়া গেছিলাম। আমি নিজেরে মুক্তিযোদ্ধা কইনা। কিন্তু হেই সময় যারা ইন্ডিয়া বইয়া আছিলো বা রাজাকার আছিলো হেগো অনেকতেই অহনে সার্টিফিকেটওয়ালা মুক্তিযোদ্ধা অইছে। এইরহম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাগো কাছে গেলে হেগো থেইকা মিছা কিচ্ছা ছাড়া সইত্যটা আর কী জানবেন! আপনের ব’স তো কম, মনেতো অয় যুদ্ধ দেখেন নাই। মুক্তিযুদ্ধের কথা কি বই পইড়া জানসেন?
-হ্যাঁ মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি।
বড়দের কাছে শুনে আর বই পড়েই তো জানতে হবে। কিন্তু এ’কথা বললেন কেন?
-কারণ যুদ্ধ হইসে মোটে বিয়াল্লিশ বচ্ছর। অহনতরি অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন। হেগো কাছ থেইকা আসল কতাটা হোনেন। ক্যান আপনেগো এলাকাত কোন মুক্তিযোদ্ধা নাই? হের কাছ থেইকা হোনেন।
তাইলে আসল সইত্য জানবেন। আর এই সইত্য কতাগিলি বইয়ে ল্যাখেন। যদ্দিন এইগুলান না ল্যাখবেন আর ভুয়া লোকের লেখা পড়বেন তদ্দিন এই সমস্যার কোন সমাধান অইবনা। আর অহনে না করলে ভবিষ্যতের আপনেগো পোলাপাইনরা তো আরও উলটাপালটা জানব।
-অনেক দামী কথা বলেছেন ।
সে কারনেই আজ অনেকে বলে এই কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক মানুষ না। আবার অনেক পণ্ডিত বলে মুক্তিযুদ্ধে নাকি ৩০লাখ লোক মারা যায় নাই। বড় জোড় ৩ লাখ মারা গেছে। আরও কত কী!
বলতে বলতে আমার গন্তব্যে পৌছে যাই।
তিনি আবারও বলে,
-রেডিওত একটা গান হুনছিলাম।
ঐসব জ্ঞানী মাইনসেরা এইসব কইলে হেগো হেই গানটার কতা হোনায়া দিবেন
“ আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়” ।
ভাড়া নিয়ে রিক্সাওয়ালা চলে গেলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকি। আসলেই তো সত্যটা কত সহজ। শুধু সেটা বলার সৎসাহস থাকা চাই।
এই যা! উনার নামটাতো জানা হলনা।
আমার স্বগতোক্তি শুনে আমার স্ত্রী বলেন,
- কেন উনার নাম তো উনি বলেছেন। শোননি, উনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আর একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কি হতে পারে!
বাতাসে মুসলিম বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বিশ হাজার বাঙালীর আত্মা সেই সাক্ষ্য দিয়ে যায় — একজন মুক্তিযোদ্ধার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ই সবচে’ বড়।
অভিমন্যু
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।