যা দেখছি, যা বুঝছি, যা ভাবছি...
ভাত পায় না চা খায়
সাইকেল দিয়ে হাগতে যায়।
আমরা এখন কি পারিনা? আমরা এখন কি জানিনা? আমাদের কোন জিনিসটা নাই? কোন গুনটা নাই? এসব প্রশ্ন এখন খুবই অবান্তর, অকিঞ্চিতকর এমনকি হাস্যকর। আমরা এখন সব পারি, সব জানি, আমাদের এখন স-ব আছে । আমরা সবাই এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ - সর্বগুনে গুনান্বিত । আমরা সবাই এখন সব্যসাচী।
আমাদের দেখে কেউ বলার সাহস পাবে না যে আমাদের কোন কিছুর অভাব রয়েছে। কোন কিছুর অভাব প্রকাশ করার মতো লজ্জাকর, হাস্যকর, পরিহাসকর যে কিছু নেই তা আমরা এখন মনে-প্রাণে, অন্তরে-বাহিরে, সমস্ত সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করি। তাই সব ধরনের অভাব ঢাকার জন্য আমরা এখন ভাব ধরি, ভেক ধরি, ভান করি - প্রতিনিয়ত অভিনয় করি। নিজেদের দুর্বলতা যাতে কোনভাবে প্রকাশ না পায় তার জন্য আমরা এখন উদয়াস্ত পরিশ্রম করি। তাই আমরা এখন চতুর হতে চাই।
তাই আমরা এখন কপট হতে চাই। তুখুর অভিনেতা হতে চাই। জীবনের পরতে পরতে আমরা অভিনয় করতে চাই। চতুরতা-কপটতাকেই আমরা এখন মনুষ্য জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ বলে মনে করি। তাই এ গুণ অর্জনকেই আমরা আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারন করে ফেলেছি।
আর তাইতো কয়েকদিন না খেয়ে পেট গিয়ে পিঠে ঠেকলেও আমরা ভাবের ঠেলায় বলি ঘরে চাল বাড়ন্ত। বছরের পর বছর মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরেও পাত্তা না পেয়ে বাথরুমে হস্তমৈথুন করে, আমরা বন্ধুদের কাছে হাজার খানেক মেয়ের সাথে প্রেম এবং লক্ষ খানেক মেয়ের সাথে সঙ্গম করার অভিজ্ঞতা প্রচার করি। পকেটে কানাকড়ি না থাকলেও আমরা অন্যের সামনে বাকিতে কেনা বেনসন সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে অনেক কষ্টে যোগাড় করা দামি মোবাইল সেট উল্টে-পাল্টে দেখি (দেখাই)। বিদ্যুৎ ও নিরাপদ পায়খানাবিহীন অজ পাড়া-গাঁ থেকে শহরে এসে কায়দা করে চুলের ছাঁট দিয়ে, পাছা দেখিয়ে প্যান্ট পড়ে, কানে দুল লাগিয়ে, হাতে চুড়ি পড়ে আমরা পশ্চিমা আলট্রা মডার্ণ সাজি।
শুধু তাই নয় মসজিদ-মন্দিরে কাউকে ধর্ষণ করার পরমুহুর্তেও ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে জোর করে তা বন্ধ করে দিয়ে আমরা বিশাল আস্তিক সাজি।
এর বিপরীত দিকও আছে, সারাজীবন কওমী মাদ্রাসায় পড়াশুনার পাশাপাশি আল্লাহ্-বিল্লাহ্ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চুল দাড়ি রেখে, সাত দিনে একদিন দাঁত ব্রাশ করে, পুরনো কাপড়চোপড় পড়ে, অপরিস্কার থেকে, কথায় কথায় মার্কস লেনিনের গৎবাধা দুয়েকটা উদ্ধতি বলে আমরা নিজেকে বিশাল নাস্তিক, মহান কমরেড প্রমাণ করার চেষ্টা করি।
এগুলো ছাড়াও আমাদের ভাব ধরার আরো মাত্রা আছে। উচ্চতা তিন ফুট হলেও দুই ফুট উঁচু হিল পড়ে আমরা নিজেকে লম্বা প্রমাণের চেষ্টা করি। স্তন কিংবা চুল না থাকলেও নকল ব্রা ও উইগ পড়ে আমরা নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ যৌনাবেদনময়ী ও কেশবতী মনে করি। বছরের পর বছর প্রেম করে বিয়ে করার পর সংসারে সারাদিন চুলাচুলি-মারামারি লেগে থাকলেও অন্যের সামনে আমরা দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী দম্পতি সাজি।
জ্ঞাণের জ-ও না জেনে হাতে পায়ে ধরে একটি আলহাজ্ব ডিগ্রি বগলদাবা করে শিক্ষক হয়ে কথায় কথায় চ্যাটাং চ্যাটাং ইংরেজী বলে আমরা সবজান্তা শমসেরের জায়গা দখল করি।
চারদিকেই এখন চলছে এই ভাব ধরার প্রতিযোগীতা। নিজেকে একটা কিছু প্রমাণ করতে আমরা সবাই এখন উঠেপড়ে লেগেছি। শুধু ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠিগতভাবে নয় রাষ্ট্রীয়ভাবেও আমরা প্রতিনিয়ত ভাব ধরছি। ইসলামী জঙ্গীবাদ ও ধর্মান্ধ (ধর্মভীড়ু নয়) লোকের ভীড়ে সারা দেশ সয়লাব হয়ে গেলেও আমরা নিজেদের মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে ঘোষণা করি।
একের পর এক বর্গীর আক্রমণে নিজেদের স্বতন্ত্র কোন সংস্কৃতি সৃষ্টি না হলেও আমরা বাঙালি সংস্কৃতি বলে চিৎকার করি। শতাব্দীর পর শতাব্দী পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে শোষিত হলেও আমরা নিজেদের নির্ভীক জাতি বলে দাবি করি। যুগে যুগে সাধারন মানুষের অভাব থাকলেও একসময় গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল বলে আমরা ভাবের আফসোস করি। প্রাণ খুলে কথা বলা ও নিজেদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলেও আমরা নিজেদের স্বাধীন জাতি-গণতান্ত্রিক বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করি। দূর্নীতি করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে টাকার তোষক-বালিশে শুয়ে আমরা জরীপের ফলাফলের প্রতিবাদ করি।
কোটি কোটি লোক চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেও মহাকাশ জয় করে আমরা দুনিয়ার সব সমস্যা সমাধান করে ফেলার ভাব ধরি। না খেয়ে প্রতিদিন কাতারে কাতারে মানুষ মারা গেলেও আমরা ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি বলে মনে করি।
ব্যক্তি, পরিবার কিংবা রাষ্ট্রেও পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল গণমাধ্যমেও প্রতিনিয়ত চলছে এই ভাব ধরাধরি। নীতি-নৈতিকতকা, দায়বদ্ধতা, আদর্শ এসব আপাত সুন্দর শব্দগুলো শোকেসে বন্দি করে গণমাধ্যমগুলো নগ্নভাবেই এ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হলেও আমাদের গণমাধ্যমগুলো তা প্রচার না করে তাদের তৈরিকৃত নায়ক-নায়িকারা কিভাবে বাথরুম করে তা প্রচার করতে, মোবাইল কোম্পানিগুলো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিগুলোর কর্তাব্যক্তিরা কোনদিন কোথায় গিয়ে কিভাবে হেসেছেন তা জানাতে কিংবা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে টন টন কাগজ নষ্ট করছে।
অথচ দায়ত্ব পালন করার ভাব ধরতে আমাদের গণমাধ্যমগুলো যা কিছু ভাল তার সঙ্গে..., অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস কিংবা দেশ ও জনগনের কথা বলে এরকম লোকভুলানো বুলি ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক কিংবা প্রচার সংখ্যার শীর্ষে এরকম লেবেল লাগিয়ে প্রত্যেকেই নিজেকে জনগনের বাপ-মা প্রমাণের চেষ্টা করে।
ভাবওয়ালাদের প্রভাব এখনকার সমাজে এত বেড়ে গেছে যে ভাব না ধরতে পারলে, কপট না হতে পারলে টিকে থাকা যায় না। ভাব না থাকলে নিজের উদর জ্বালা নিভানোর জন্য সামান্য চাকরি এমনকি টিউশনিও এখন পাওয়া যায় না। ভিতরে যা কিছুই থাক না কেন চুল-দাড়ি রেখে গাঁজা খেয়ে চোখ লাল করে মহাজ্ঞানীর ভাব ধরতে পারলেই এখন বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়।
এমনকি শুধুমাত্র ভাবের কারণেই উঁচু দরের চাকরি যেমন কুক্ষিগত করা যায় তেমনি ভাব দেখিয়ে ধান্ধাবাজি করে বিশাল ব্যবসাও দাঁড় করানো যায়। সামান্য কৃষক হওয়ার কারণে আরজ আলী মাতুব্বরকে যেমন প্রথম অনেকে বিশ্বাস করতে চায়নি তেমনি সর্ব গুণের অধিকারী ও সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী হলেও ভাব না ধরতে পারলে এখন তাঁকে লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে হয়।
ভাব ধরতে ধরতে আমরা এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছি যে রাস্তার পাশে কেউ মরে গেলেও আমরা ভাব নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ফিরেও তাকাই না। সব কিছু বুঝেও আমরা না বুঝার ভান করছি। সব কিছু দেখেও আমরা না দেখার ভান করছি।
নিজের গায়ের উপর না পড়লে আমরা কোন কিছুতে এখন গা করতে চাইনা। দুনিয়ার সব মানুষ মরে গেলেও না। আমরা অভিনয় করছি। তুখুর থেকে তুখুরতর অভিনেতায় রূপান্তরিত হচ্ছি। তবু আমাদের সাধ মিটছে না।
নিজেদের অভিনয় গুণ বাড়ানোর চেষ্টা করর্ছি নিরন্তর।
ক্রমাগত অন্যের সাথে এই অভিনয়-ভাব-ভান ধরার সাথে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এখন আমরা নিজের সাথেও অভিনয় করি। আর তাইতো নিজেদের ঢোল এখন আমরা অন্যকে পেটাতে দেইনা। নিজের ঢোল এখন আমরা নিজেরাই পেটাই। আর এর ফলে ঢোল যে শুধু বাজছে তাই নয়, ফাঁকা কলসির মতো বড় বেশিই বাজছে।
কিন্তু কলসি ভরাট থাকলে যে এত ভাব-ভান-অভিনয় করার দরকার পড়েনা ভাবের এই যুগে তাও এখন আমরা ভুলে গেছি। শুধু কি তাই কলসি ভরাট করতে কি লাগে আমরা এখন তাও জানি না। জানি কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।