খুব চমৎকার একটা কথা ভাসছে বাতাসে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে সরানোর জন্যই নারী অধিকার নীতিমালা নিয়ে চলমান বিক্ষোভ। যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধাপরাধের সহযোগী হিসেবে অনেকের নামই উচ্চারিত হয়েছে- যুদ্ধের উস্কানি দেওয়া এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে দেওয়া বক্তব্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে বানচাল করবার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে তথ্যদাতা কিংবা গোয়েন্দা হিসেবে যোগ দেওয়া কিংবা আধাসামরিক বেতনভুক যোদ্ধা এবং এই যোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতায় অনেক ব্যক্তির নামই যুক্ত হয়েছে।
দৈনিক সংগ্রামের পাতায় যাদের আস্ফালন চোখে পড়েছে- জালাল ভাইয়ের প্রচেষ্টায় যেসব নথি সংকলিত অবস্থায় এসেছে সামনে তার উপরে দৃষ্টি রেখে বলা যায় বর্তমানের জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটির নেতৃস্থানীয় অনেকেরই উক্তি দৈনিক সংগ্রামের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে।
তারা যুদ্ধাপরাধের দায় স্বীকার করেন না, তারা দলগত ভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এই সত্যও তারা অস্বীকার করতে চান, এটা নিয়ে ভিন্ন বিতর্ক উত্থাপন করা যায়, তবে নারী উন্নয়ন এবং নারী অধিকার নেত্রীরা যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন- আদতে আমার নিজের মনে হয় না যুদ্ধাপরাধী ইস্যুকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের জন্যই এই বায়তুলমোকাররমভিত্তিক উত্তরাধিকার আইনের বিরুদ্ধের সমাবেশ ও বিক্ষোভ। এবং এরই সাথে উচ্চারিত হচ্ছে- কোনো না কৌশলে সরকারও এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক।
আমার নিজের বিশ্বাস- এটা সত্য নয়- যদি সরকার এই আন্দোলনে সহায়তা করে তবে তার নিস্ক্রিয়তাই এই সহায়তার কাজটা করছে- সরকার মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গাটাতে আঘাত হানতে ভীত- এ কারণেই এই ধর্মীয় উন্মাদদের দৌরাত্ব সহ্য করতে হচ্ছে।
তবে সরকার নিজের উদ্যোগে এটাকে লালন-পালন করছে এটা মেনে নিতে আমার আপত্তি আছে। সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের ভেতরে অন্তত ৪ জন ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি সহানুভুতিশীল ব্যক্তি আছেন। তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগেই ইশ্বরের কৃপা প্রার্থনা করলে আপত্তি ছিলো না, ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে বলা যেতো তারা নিজেদের কর্ম সম্পাদনের জন্য যদি এই সান্তনা চান তবে সেটা তার নিজস্ব বিশ্বাসের স্বাধীনতা।
তবে সমস্যা হলো এই ৪ জন উপদেষ্টা ঠিক ধার্মিক নন তবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভুতিশীল, এবং এ কারণেই উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ধর্মীয় ইস্যুর বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
একই কারণে কোনো রকম শরিয়াভিত্তিক বিচ্যুতি না থাকা স্বত্ত্বেও হাসান আরিফ এবং ৪ উপদেষ্টা নিজস্ব উদ্যোগেই নারি অধিকার অধ্যাদেশের খসরা পঠিয়েছেন দেশের আলেম বলে স্বীকৃত মানুষের দরবারে- রিপোর্ট এখনও আসে নি। মেয়াদকৃত ২১ দিনের সীমা অতিক্রম করতে আরও কয়েক দিন আছে- তবে যেহেতু এটা কাজীর গরু ফিরে পাওয়ার আন্দোলন তাই- গোয়ালে না থাকলেও এটার ঘাস কেনবার টাকা উঠাতেও সমস্যা হওয়ার কথা না।
অস্তিত্ব না থাকা স্বত্ত্বেও তাই বায়তুল মোকাররমের সামনে পুলিশকে ধাওয়া করে ধর্মীয় রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ঠ রাজনৈতিক দলরের কর্মীরা।
দেওয়ানবাগী কিংবা ইসলামী শাসনতন্ত্র কিংবা হিজবুত তাহিরির- এদের কর্মীরাই এখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জামায়াতের কর্মীরা অংশগ্রহন করে নি এমনও না।
তারাও নিজস্ব সিদ্ধান্তে এখানে অংশগ্রহন করেছে। সমস্যা হলো জামায়াতের কর্মীদের নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্ত বলে কিছুই নেই- দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে এখানে অনুগত কর্মীকে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা ইউরোপে নির্বাসনে পাঠানো হয়- এবং দলের আমির ও নীতিনির্ধারকেরা বলেন- এই দুস্কৃতিকারীর সাথে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্ঠতা নেই- আমরা তাকে নীতিগত ভাবে বহিস্কার করেছি।
সুতরাং এই বিশেষ উত্তরাধিকারী আইনের বিরোধিতায় শুরু হওয়া জিহাদেও জামায়াত কর্মীদের অংশগ্রহন দলীয় সিদ্ধান্ত মেনেই হয়েছে- তবে দলগত ভাবে আন্দোলন না করবার সুবিধা হচ্ছে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো দায় স্বীকার অসস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হয় না। দলীয় ভাবে ঘটনার দায় স্বীকারের দায়িত্ব নিতে হয় না।
সরকারই উস্কানি দিয়ে এমন করাচ্ছে এটার বিরুদ্ধে আমার নিজের অবস্থান।
কোনো তথ্য প্রমাণ নেই যে সরকার এই আন্দোলনকে নিজেদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে- আবার এমনও দৃষ্টান্ত নেই যে সরকার আসলে এটার বিরোধিতা করছে- দুটোই নিছক অনুমাণ। এবং আমার অনুমাণ সরকার আরিফের ইস্যুতে যে অবস্থান নিয়েছিলো সেটার পেছনে একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিলো এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যের বলির পাঠা ছিলো আরিফ।
এখানে নারী অধিকার ইস্যুতে কাউকে বলির পাঁঠা বানানোর সুযোগ নেই- এমন কি সরকারের নিজের আগ্রহ নেই এটা নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টির। উন্মাদনা সৃষ্টির পেছনে যদি যুদ্ধাপরাধী ইস্যু থাকে তবে সেটা নিছক অনুমাণই হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ্রহ হয়তো সরকারের নেই- তবে এটা নিয়ে কথা চালাচালি হচ্ছে- সরকার যদি এই সহায়তা চাইতে অস্বীকার করে তবে তা সেই ৪ জন উপদেষ্টার নিরবিচ্ছিন্ন ধর্মীয় রাজনীতির পৃষ্টপোষকতার কারণেই ঘটবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তৈরি করা আইনকে পুনুরুত্থিত করলেই ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। ইস্যুটা সম্ভবত যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নয় বরং ধর্মীয় রাজনীতি বাঁচানোর সিদ্ধান্তকে সহায়তা করবে।
সব মেঘের আড়ালেই সোনালী সূর্য থাকে। এখানেও একটা সোনালী সূর্য্যের অস্তিত্ব আছে-
ধর্ম যতটা শোভন সংস্কার হোক না কেনো ধর্মীয় রাজনৈতিক গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় হানাহানি মানুষকে ধর্মীয় রাজনীতিবুমূখ করে তুলতে পারে- হয়তো এইরকম মসজিদ ভিত্তিক গণআন্দোলন এবং হানাহানি অব্যহত থাকলে মানুষ নিজে থেকেই এই দাবি তুলবে। তারাই ধর্মীয় রাজনীতির কবর খুঁড়বে।
এই আশাবাদই এখন ভরসা।
সরকার যেমন নমনীয় অবস্থান নিয়েছে- পুলিশ নিজেও মোলায়েম এই ইস্যুতে- প্রতিটা মানুষ রীতিমতো বিস্মিত হয়েছে পুলিশ মসজিদে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে দেখে।
মসজিদের প্রতি যে অবিচল ভক্তি এই একই অবিচল ভক্তিই হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয়। মসজিদ কলংকিত হচ্ছে ধর্মীয় রাজনীতির দুষণে এটা যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তবে জনসমর্থনে ঘাটতি পড়বে না মোটেও।
তবে পুনরায় আমার উপলব্ধি জানাই- আমার নিজের মনে হয় যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে জামাতবধের ধারণাটা বদলানো প্রয়োজন।
জামায়াত বধের জন্য আর ১০ বছর পরে অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে- দলীয় ভাবে জামায়াত ১৯৭১এর বিরোধী পক্ষে থাকলেও এখন জামায়াতের অধিকাংশ কর্মীই এই জায়গাটাতে নেই- তারা সবাই ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি- তাদের কাছে ১৯৭১এর কোনো অবস্থান নেই- তারা বাংলাদেশেই ধর্মীয় প্রজাতন্ত্র নির্মানের স্বপ্ন দেখে- এই প্রবণতা খারাপ কি ভালো -এটা প্রগতির পথ না কি এটা অধঃপতনের পথ এটাই তাদের সাথে মতাদর্শীক সংঘাতের বিষয় হয়ে যাবে আর ১০ বছর পরে- তখন কি পন্থায় আমরা এদের বিরোধিতা করবো? তাদের পূর্বতন নেতারা যুদ্ধাপরাধী ছিলো- এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করলাম- তারা দোষি সব্যস্ত হলো- তাদের প্রাপ্য শাস্তি টারা পেয়ে যাওয়ার পরে আদতে কি ঘটবে? জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ বদলে যাবে?
জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ বদলাবে না, বরং তাদের লক্ষ্য মানুষের ধর্মিয় অনুভুতির কোমল জায়গাটাতে আঘাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্তি- এই লক্ষ্যে তারা সফল হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত চিত্র কি রকম হবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক মানচিত্র কেমন হবে এটা বিবেচনা উচিত এখন থেকেই-
আজ-কাল-পরশু একদিন না একদিন যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে- তবে এদের বিচার হলেই আসলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিধন হবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।