স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ছিল ৩১ শয্যাবিশিষ্ট। ওতেই কাজ চলছিল। কিন্তু সামনে নির্বাচন। এখন তাকে ৫০ শয্যায় উন্নীত না করলে চলে না। ভবনটাই বেশি প্রয়োজন।
কারণ, ওটা বাইরে থেকে লোকে দেখতে পায়। ভেতরে কী আছে না আছে, কী হয় না হয়—তা বিবেচ্য নয়। ধোবাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবন উদ্বোধন করা হলো। শয্যা যে ১৯টি বাড়ানো হয়েছে, প্রথম দিনই রোগী বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। হাসপাতালের ৫০ শয্যা উদ্বোধনের দিনই পরিপূর্ণ।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মর্গের শুভ উদ্বোধনও প্রথম দিনই হয়ে গেল।
বাংলাদেশ যেখানে মধ্যম আয়ের দেশ, এশিয়ার চিতাবাঘ হওয়ার পথে, সেখানে এসব উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাঁচি দিয়ে ফিতা কাটা ও চা-বিস্কুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অবধারিতভাবে থাকে ভোজসভার আয়োজন। ভোজসভাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। এক ভাগ দরজা বন্ধ করা কক্ষে ভিআইপিদের জন্য, আরেক ভাগ আম-দাওয়াতি সাধারণ কর্মীদের জন্য।
সেটা হয় বড় হলঘরে বা মাঠের মধ্যে শামিয়ানা টানিয়ে। সেখানকার খাদ্যতালিকা সাদাসিধা।
ভিআইপি রুমের আইটেম থাকে বহু রকম। কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়া আর সবই: সাদা পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা, গোরুর গোশতের টিকিয়া, মাছ কয়েক রকম। এলাকার কোনো জনপ্রতিনিধির পুকুরের বা নদীর সবচেয়ে বড় রুই মাছটি জীবিত না হলেও ভিআইপি রুমের খাবারের টেবিলে আসার সুযোগ পায়।
গুজি আইড় বা চিতল। এই মৌসুমে সরষে ইলিশ না থেকে পারে না। টাকি মাছের ভর্তা। ছোট মাছের চচ্চড়ি। খাঁটি দুধের খাসা দই।
অর্ডার দিয়ে তৈরি ছানার মিষ্টি।
ভিআইপি রুমের ভোজসভার দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মন্ত্রী আসবেন বলে ছুটোছুটিতে ছিলেন উপজেলার অন্যান্য কর্মকর্তা। কোনো এক ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভিআইপি ভোজকক্ষে প্রবেশ করতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও সজোরে বাধা দেন। ইউনিয়নের নেতা ভিআইপি হতে পারেন না।
ভিআইপি খাদ্য নয়, তিনি খাবেন শামিয়ানার নিচে সাধারণ খাদ্য। সরকারি দলের ইউনিয়নের নেতা নিজে জানেন তিনি ভিআইপি ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারেন না। তিনি ঢুকবেনই ভিআইপি ঘরে। প্রবল ধাক্কাধাক্কি। তারপর চেয়ারম্যানের ভাই তাঁকে ‘বেদম পেটায়’।
ততক্ষণে ভিআইপি ভোজসভার খানাপিনা অর্ধেক শেষ। বাংলার মাটিতে কারও পক্ষে মার খেয়ে মার হজম করা সম্ভব নয়। ভোজসভার দরজার সামনের মারামারির খবর মুহূর্তে অপমানিতের বাড়িতে শুধু নয়, রাষ্ট্র হয়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। হাজার হাজার মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ছুটে আসে। এ দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের যুদ্ধে অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হলেও গ্রাম-গঞ্জের যুদ্ধের সৈনিকেরা জাতীয়তাবাদী, তারা স্বদেশি অস্ত্রই এস্তেমাল করে।
এ দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতা আর কোথাও দেখা না গেলেও মারামারির সময় সবাই ন্যাশনালিস্ট ও সেক্যুলার। সব ধর্মাবলম্বী ও সব জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে মারামারিতে গড়ে ওঠে সুদৃঢ় ঐক্য। ভিআইপি ভোজকক্ষে প্রবেশ নিয়ে সরকারি দলের দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ। এক ঘণ্টার মধ্যে ধোবাউড়া দামেস্ক বা বাগদাদে পরিণত হয়। ইউনিয়ন নেতার পক্ষের লোকেরা উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা করে প্রকাশ্য রাস্তার মধ্যে।
চেয়ারম্যানের ভাইদের অবস্থা এতই সংকটাপন্ন যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁদের চিকিৎসা সম্ভব নয়। আহত হয়েছে ২৫ জনের মতো। অল্প স্বল্প জখম যেমন হাঁটু, কনুই বা ঘাড়ের কাছে থেঁতলে গেছে কয়েক শ যোদ্ধার। ভোজকক্ষে প্রবেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার প্রশ্নই আসে না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রোববারের ঘটনা তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং এটি একটি দুর্ঘটনা। ’ অর্থাৎ যিনি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের আঘাতে নিহত হলেন, তিনি তাঁর বাথরুমে আছাড় খেয়েও মারা যেতে পারতেন। সড়ক দুর্ঘটনা বা বজ্রপাতেও মারা যেতে পারতেন। দু-চারজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তারাও ছাড়া পেয়ে যাবে। মিডিয়াও চুপ হয়ে গেছে।
বর্তমান বঙ্গে বিরোধী দলের লোকের হাতে সরকারি দলের লোক মার খেলে এক রকম মামলা, সরকারি দলের লোকের হাতে বিরোধী দলের কোনো হতভাগ্য প্রাণ দিলে অন্য রকম মামলা। বিরোধী দল নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করলে আরেক রকম মামলা। অর্থাৎ জীবন বা মৃত্যুটা বড় নয়, কে কাকে মারল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। রানা প্লাজার পিলার ধরে নাড়াচাড়ার মতো এখন শোনা যাচ্ছে, মন্ত্রীর ভাষায়, আওয়ামী লীগের লোকজন যে মারামারি করছে তার পেছনে বিরোধী দলের হাত রয়েছে। টিভির বেকুব দর্শকেরা ধরে নেবে, ভিআইপি কক্ষে আওয়ামী লীগের অ-ভিআইপি নেতাকে যাওয়ার বুদ্ধি দিয়েছিল বিরোধী দল।
রাস্তার মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান ও তাঁর ভাইদের ওপর অস্ত্রাঘাতের পরিকল্পনাও বিরোধী দলের। যেন এখন বিরোধী দলের কথায় সরকারি দলের লোকেরা ওঠা-বসা করছেন।
আইনের শাসন কোনো ছেলেখেলা নয়। আইনের শাসন ছিল বলে মোগলরা আড়াই শ বছর এবং অবৈধ সরকার হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশরা ২০০ বছর এ দেশ শাসন করতে পারে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার না থাকলে সাড়ে চার থেকে পাঁচ বছরের বেশি কোনো সরকারকে মানুষ সহ্য করে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।