সবার সাথে বন্ধুত্ত্ব করতে চাই। পরনে স্যুট, টাই। মুখে অনর্গল ইংরেজি। দামি গাড়ি নিয়ে তাদের চলাফেরা। পুলিশি খাতায় ভিআইপি ছিনতাইকারী।
রাজধানীর ব্যাংকপাড়া ও অভিজাত এলাকায় র্যাব, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছিনতাই করে তারা। মতিঝিল এলাকায় এমনি এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় যুক্ত একটি কালো রঙের পাজেরো জিপকে পুলিশ খুঁজছে ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে। পুলিশ বলছে, ধনীর বখাটে দুলালরা নেশার টাকা যোগাড় করতে আবার একটি চক্র পার্টটাইম পেশা হিসাবেও ছিনতাইকে বেছে নিয়েছে। গত ২৬শে জুন সন্ধ্যায় মতিঝিল থেকে গুলশানের বাসায় ফিরছিলেন জেরিন এন্টারপ্রাইজের মালিক ব্যবসায়ী আলী আহমদ। নটর ডেম কলেজের সামনে আসতেই তার গাড়ির সামনে আড়াআড়িভাবে দাঁড়ায় একটি কালো রঙের পাজেরো।
আলী আহমদের চালক গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির চালককে কিছু বলার জন্য নামতেই পাজেরো গাড়ি থেকে নেমে আসা ৪ যুবক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা গাড়িতে ঢুকে আলী আহমদের দিকে পিস্তল তাক করে। তারা আলী আহমদের কাছে থাকা ৫০ হাজার টাকা, একটি ব্লুবেরি মোবাইল ফোনসেট, একটি ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়। এরপর তারা গাড়িতে উঠে দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক হয়ে পড়েন আলী আহমদ।
পরে র্যাব-৩ এর কাছে লিখিতভাবে জানান তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। গত ৩০শে জুন রাত পৌনে ৮টার দিকে লালমাটিয়া ই-ব্লকে অবস্থিত বেসরকারি একটি ফার্ম থেকে গাড়িতে করে বাসায় যাচ্ছিলেন এক কর্মকর্তা। লালমাটিয়া মহিলা কলেজের বাম দিকের রাস্তা দিয়ে মোহাম্মদপুরে যাওয়ার জন্য তিনি টার্ন নিচ্ছিলেন। এ সময় বৃষ্টিতে ভিজে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি।
পরনে অফিসিয়াল পোশাক। কাছে এসে গাড়ির চালকের আসনে বসে থাকা ওই কর্মকর্তাকে বলেন, তার ভাইপোর মরণাপন্ন অবস্থা। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আছে। বৃষ্টির মধ্যে কোন যানবাহন পাচ্ছেন না। একটু লিফট চান।
মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে অপরিচিত মাঝ বয়সী ব্যক্তিকে গাড়িতে উঠিয়ে নেন ওই কর্মকর্তা। গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু ৫ মিনিট পরই মাঝবয়সী ওই ব্যক্তি তার কাছে থাকা কালো একটি ব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে চালকের আসনে বসে থাকা ওই কর্মকর্তার বাম কানের নিচে ধরেন। ভাষা বদলে সে বলে, ‘চুপ’ শব্দ করবি না। মহাখালীর দিকে গাড়ি চালা।
কানের নিচে রিভলবারটি চেপে ধরে বলে, পেছনে তাকিয়ে দেখ আরেকটা গাড়ি আসছে। ওই গাড়িতে আমার লোক আছে। চালাকি করলে গুলি খেয়ে মরবি। তিনি পেছনে তাকিয়ে দেখেন আরেকটি নোয়া মাইক্রোবাস তার গাড়িটিকে ফলো করছে। নিরুপায় হয়ে ওই কর্মকর্তা আসাদগেট দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে খেজুরবাগানের সামনে দিয়ে বিজয় সরণি ঘুরে চলে যান মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে।
এর মধ্যে অস্ত্রধারী চালকের আসনে বসে থাকা কর্মকর্তার বাম পকেট থেকে ৮ হাজার এবং ডান পকেট থেকে ১৬ হাজার টাকা বের করে নেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে গাড়িটি মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ঘুরে আরজতপাড়া মাঠের কোণায় চলে আসে। তখন গাড়িটিকে থামার নির্দেশ দেন অস্ত্রধারী। এরমধ্যে পেছনে ফলো করতে থাকা নোয়া মাইক্রোটিও গাড়ির কাছে চলে আসে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসে আরও ২ জন।
চেহারায় ভদ্রতার ছাপ। দুজন গাড়ির ভেতর তন্ন তন্ন করে টাকার খোঁজ করে। টাকা না পেয়ে ব্যাংকের চেক, অফিসিয়াল কাগজপত্র তছনছ করে। পরে তারা বলে আগামীকাল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে এই মাইক্রোটি দাঁড়িয়ে থাকবে। তুই ২ লাখ টাকা পৌঁছে দিবি।
হুমকি দিয়ে বলে, চুপচাপ চলে যা, যদি থানা পুলিশ করিস ফল ভাল হবে না। তিনজনের মধ্যে একজন অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে। নাম ঠিকানা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ভয়ে থানা পুলিশ করিনি। গত ৪ঠা জুলাই গাজীপুর থেকে উত্তরার বাসায় ফেরার জন্য চৌরাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন ইতালি প্রবাসী মিন্টু। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে দাঁড়ায় একটি ব্র্যান্ড নিউ টয়োটা প্রিমিও প্রাইভেট কার।
চালকের আসনের পাশে একজন লোক বসেছিলেন। গাড়িটি মহাখালী যাবে বলে চালক কয়েকজন যাত্রী ওঠালো। ৪০ টাকা ভাড়া চুক্তিতে মিন্টুও উঠলেন ওই গাড়িতে। কিন্তু গাড়িটি কিছুদূর না যেতেই ধারালো ছোরা বের করে তার বুকের কাছে ধরে ওৎপেতে থাকা ছিনতাইকারীরা। তার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা, কয়েকটি এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয় তারা।
মিন্টুকে প্রচণ্ড মারধর করে কার্ডের পিন নম্বরও আদায় করে তারা। পরে মিন্টুর চোখ বেঁধে আব্দুল্লাহপুরে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। কয়েক ঘণ্টা সেখানে পড়ে থাকার পর বনশ্রী পরিবহনের একটি বাসের চালক মিন্টুকে দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করেন। পরে তাকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি এখনও চিকিৎসাধীন।
একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও তারা থেকে যাচ্ছে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপকর্ম করে তারা নির্বিঘ্নেই গাঢাকা দিচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলছেন, বিভিন্ন সময়ে পুলিশের অভিযানে বেশ ক’জন ভিআইপি ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরই তারা আবার জামিনে বেরিয়ে যায়।
মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, মতিঝিল এলাকায় অভিজাত গাড়ি ব্যবহার করে ছিনতাইয়ের অভিযোগ মাঝে মাঝেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময় এরা গ্রেপ্তারও হয়। কিন্তু এদের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, যে গাড়িগুলো এসব কাজে ব্যবহৃত হয় সেগুলো ছিনতাইয়ের সময় নম্বর প্লেট খুলে রাখে। কাজ শেষে আবারও নম্বর প্লেট লাগিয়ে রাস্তায় প্রকাশ্যে চলাফেরা করে।
এ কারণে এদের ধরা কঠিন। গোয়েন্দা পুলিশের ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধ টিমের সহকারী কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, বিভিন্ন সময় ভিআইপি ছদ্মবেশী ছিনতাইকারীদের বিষয়ে অভিযোগ আসে। কিন্তু তারা সংঘবদ্ধ চক্র কি না তা চিহ্নিত করা যায়নি। এদের বিষয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে। তিনি জনসাধারণকে অপরিচিত প্রাইভেট গাড়িতে ওঠার আগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
এছাড়া এ ধরনের কোন ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশকে জানাতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, রাজধানীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে মাঝে মাঝে। তবে এরা সংঘবদ্ধ কোন চক্র নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেশার টাকা যোগাড় করতে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এ ধরনের অপরাধ করছে। এছাড়া অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থেকেও অনেকে এ ধরনের অপরাধ করছে।
এদের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। র্যাব-১ এর পরিচালক লে. ক. রাশিদুল আলম বলেন, মধ্য রাতে রাজধানীর রাস্তায় বেপরোয়া গতির বেশি কিছু গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। তারাই এ ধরনের অপরাধে জড়িত বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব অভিজাত গাড়ি মধ্য রাতে বেপরোয়াভাবে রাস্তায় চলবে তাদের আটক করা হবে।
সোর্স ঃ Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।