বই! কচকচে নতুন টাকার বান্ডিলের মত। নাহ! ঠিক হলনা! তার চেয়ে মুল্যবান।
একটা বই লিখব। লেখা আর হয় না। সব সময় ভাবি; আমিতো লিখতেই পারি।
লিখব এক সময়। কিন্তু সময় আর আসে না।
অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়, শহীদ দিবসের দেয়াল পত্রিকায় একটা কবিতা দিয়েছি; কিন্তু কবি গোলাম মোস্তফার কোন কবিতার অনুকরণে বা নকল করে লেখায়, তা বাতিল হয়ে যায়। আমি সত্যিই নকল করিনি। সেই যে মনে ভাব এল; চাট্টি খানি কথা! আমার কবিতা, কবি গোলাম মোস্তফার মত বা তার প্রায় কাছা কাছি ভাল।
সেই থেকে ভাবতাম আমি কবি। যখন তখন দুছত্র লিখতে পারি। কলেজে এমনিই একটা ঘোষনা পেয়ে, তাৎক্ষনিক ভাবে দুছত্র লিখে জমা দেই। পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে প্রথম হাওয়ায়, কবিতাটি পাঠ করতে বলা হয়, কিন্তু ভাবিইনি যে, আমার কবিতা প্রথম হবে। আর কবিতাতো যখন তখন লিখতে পারি।
তার কপি রেখে লাভ কি! আবার কেউ চাইলে একটা লিখে দেব। সে অনুষ্ঠানে কবিতাটি পাঠ করা হল না।
ঢাকায় এসে কোন পত্রিকায় একটা কবিতা পাঠাই, ছাপাও হল। সম্মানী দেওয়া হবে; সম্পাদক বলেন; কাল একবার আসুন।
কাল পড়শু যখনই যাই সম্মানীর চেকটা সম্পাদক খুজে পান না।
কিন্তু আমার মাত্র(?) ১৫০ টি টাকার জন্য তিন বারের বেশী যেতে ইচ্ছে করল না। কবিতা আর লিখতে মন চায় না।
কবিতাকে ছুটি দিয়ে, সুন্দর জীবন আর দারিদ্রতার হাত থেকে মুক্তি পেতে, জীবনের ঝুকি নিয়ে, বেছে নেই প্রবাস জীবন। নতুন ভাষা আর সংস্কৃতির অথই দরিয়ায় হাবুডুবু খেতে খেতে, ইচ্ছার অনুমতি না নিয়েই, তার কিছুটা ভেতরে ঢুকে যায়।
নতুন জীবনে ভালভাবে বাঁচতে নতুন পেশা শিখি।
নতুন পেশার নতুন কাজে যোগ দেই, মিউনিখ প্রকৌশল বিশ্ব বিদ্যালযে, একটা টেকনিকেল পোষ্টে।
এর মধ্যে নতুন ভাষায় লিখতে পড়তে শিখি। পড়তে গিয়ে চোখ কপালে উঠে! মনে মনে ভাবি; আমাদের লেখকরা না লিখে; এই সব লেখা অনুবাদ করলেই পারেন!
কী পড়েছি এতদিন! এত ভাল সে নতুন ভাষার সাহিত্যটিকে বেসে ফেলি। কত লেখা অনুবাদ করব? একটার চাইতে আর একটা মনকারা! ছোট বাচ্চাদের খেলনার দোকানে ঢুকার মত। যা পড়ি তাই অনুবাদ করতে ইচ্ছে করে।
"খোকা বাবু" সে ইচ্ছার ফসল। তখন জানতামনা যে বইটি বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় চার জন অনুবাদ করে, বাজারে ছেড়েছে। তাদের মধ্যে সব চেয়ে নামকরা অনুবাদক কবি আসাদ চৌধুরী। অনেক চেষ্টা বহু তাগাদার পর, তিনটি কপি হাতে পেয়ে বলি: "তোরা অনুবাদে কেন হাত দিলি!" এর কোন মানে হয়! এত ভাল বইটি এমন, মলিন বাংলায় কলংকিত করলি! বাংলা কি এত অযোগ্য? (ঐ তিনটি অনুবাদের তুলনায়, আমার খোকা বাবু এখনই আমার হাতে অতি যত্নের)। দেখি কবির চৌধুরীর অনুবাদ! জার্মানের বিখ্যাত লেখকদের লেখা! একটু চোখ বুলিয়ে ভাবি: অপরাধটা না করলে হত না!
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র অনুবাদ করেছে "সিদ্ধার্থ" (হেরমান হেসে)।
প্রিয় বান্ধবী বলে আমিও এ অনুবাদে জড়িত। অনেক আগ্রহে প্রিয় মাতৃভাষায় তার রুপ দেখতে বইটি গোগ্রাসে গিলতে গিয়ে দেখি: এখানে হেসের সিদ্ধার্থ কৈ? এ যে আমার (বড়যোর উদার ভাবে বলতে গেলে) কবিতার অনুকরণের মত! এত সুন্দর সৃষ্টি গুলো এরা সাহিত্য সেবার নামে ধ্বংষ করে কেন?
কথা প্রসংগে বলেই ফেলি: তসলিমা নাসরিনের "লজ্জার" মত। বইটি পশ্চিমাদের অনুবাদে, প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার জার্মান অনুবাদ উপহার হিসাবে হাতে পাই। পড়ে তাজ্জব বনে যাই! তসলামা গদ্য লিখতে পারে! আগ্রহের বিরম্বনায়, বইটি বাঙলায় খুজে পাই। পড়ি আর লজ্জিত হই।
জার্মান অনুবাদকরা আমাদের বিরঙ্গনা তসলিমেকে কত যত্নে আব্রু করেছে! মূল লেখার চেয়ে অনেক গুন অলংকৃত করে, তসলিমাকে এখানে এদের ভাষায় মহিমাম্ন্বিত করছে!
কিন্তু আমরা করি ঠিক তার উল্টুটা। অন্ততঃ যত জর্মান অনুবাদ (নাটক এবং বাম পন্থী লেখা ছাড়া) পড়েছি, তার সব গুলো খুব নীচু মানের বাংলায় পড়েছি। জানি না কেন মানুষ এটা করে! কিন্তু করে!
মিউনিখে কাজের সুবাদে বাসের আয়োজন। কোন এক গানের মেলায় নির্ধারিত বাদকের বিনয়ী প্রত্যাক্ষানে আমাকে বাদনের প্রক্সি দিতে হয় (আমি বাদক হিসাবে তার তুলনায় ভাল নই)।
কি জানি কি ভেবে, আমাকে তার গাড়ীতে করে বাড়ী পৌঁছে দেয়।
তবলা নিয়ে নামার সময় একটা "চোতা" দিয়ে বলে: পড়ে দেখবেন?
তবলচির সুবিধা অনেক। তাকে শুধু তাল লয় রক্ষা করতে হয়। "বাহিরে আমার তুমি অন্তরে নও, ভাঙ্গিও না এমধু লগন" এসব গানের সাথে বাজাতে, পরিচিত প্রিয় বন্ধুর সাথে গল্প করার মত মনে হয়। কাজেই কোন কঠিন সাধনায় কাতর ছিলাম না। চোতাটা খুলে পড়তে লাগলাম।
পুরো বইটা পড়ার পরে ভোরের পাখিরা কিচির মিচির করে আর একটি নতুন দিনের ঘোষনা দিল।
আগের রাতের পড়া ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে ছিলাম বলেই স্বপ্নে পড়া সেই গল্প ছবির মত চোখে ভাসল।
দাবাড়ু! লেখক লেখক স্টেফান সোৎবাইগ, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে, মানুষের মানুষ হয়ে না উঠার বেদনায় আত্ম হত্যা করছেন। কিন্ত তার আগে দুবাড়ু বইটি লিখেছেন। এটি তীরন্দাজের প্রথম অনুবাদ (সরাসরি জার্মান থেকে বাংলায় প্রথম অনুবাদের কৃতিত্ব)
তার অনুবাদে নাৎসীদের অত্যচার (ভিন্ন চিন্তার বা মতের অথবা আদর্শের) কী জঘন্য তার কিছুটা অনুভব করলাম।
আমি আরো অনেক পড়েছি, ন্যাসিদের অত্যাচার নিয়ে। কিন্তু বাংলায় এই প্রথম। অনেক বাধা আছে আমাদের মুক্তি যুদ্ধ এত মহান কেন (আমাদের কাছে) তা এদের কাছে তুলে ধরতে। বিপরীত দিকটা সে রকমই। রাজাকারদের আমরা এত ঘুণা কেন করি! তার জবাব দাবাড়ুতে খানিকটা পাওয়া যাবে।
বন্ধুত্বের সুবাদে "ফ্রান্স কাফকা" নিয়ে অনেক আলোচনা হযেছে। আমি খোকা বাবু বেছে নিয়েছি। তীরন্দাজ চেয়েছে ফেরবান্ডলুং (অন্য শরীর)
ফ্রান্স কাফকা আমার কাছেও পীড়ের মত! তখনকার দুরারগ্য যক্ষায় ৪১ চছর বয়সে মারা যান। কিন্তু তীরন্দাজের আগ্রহের কাছে আমাকে ছাড় দিতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হল; আমার খোকা বাবু তীরন্দাজ এখনো পড়েন নি।
কিন্তু আমি তার বইযের সব লেখকের লেখা জার্মন ভাষায় আগেই পড়েছি।
হাইনরিখ বোল-এর বেশ কটি "আনেকদ্যোতে বাঙলায় পড়লাম। কিন্তু জার্মানে আবার পড়ার তাগিদ রইলনা। অন্য শরীরের নামটা আমার অনুভূতিতে এখনো সচল হয়নি। ইতিহাস, জীবন যাপন আর মূল্যবোধের কারণে, এখানকার অনেক শ্রেষ্ট রচনা আমাদের বোধের বাইরে থাকবে।
এটাকে স্বীকার করে নিয়ে, অনুবাদ গ্রন্থটি পড়তে হবে।
ভাষা অনেক ক্ষেত্রে ইউরুপ পাড়ী দিয়ে ( ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতিক কারণে) বাঙলায় পৌঁছুতে পারেনি। লেখকের ইচ্ছা অনেক ক্ষেত্রে তার কারণ। ভাষাটি আরো একটু কাব্যিক হতে পারত। সেটা আমার ব্যাক্তি গত আক্ষেপ।
অনুবাদকের ব্যাক্তিগত জীবন কাহিনী না হলেও, জলপথে ভ্রমনের কারনে নদীর ঢেউ, প্রচ্ছদে লেখকের জীবনের ছাপ রেখেছে। গল্পের সংগে আঁকা ছবিগুলো, গল্পের ছবি অনেক খানি মূর্ত করতে পেরেছে।
অরিত্র চাকলাদার নামের এই কিশোর শিল্পীকে অংকনের আঙ্গিনায় কষরতের অনুমতি দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। বইটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে তীরন্দাজ নিকের ব্লগার আনিস হক-কে প্রায় আশি হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। এত পরিশ্রম করে অনুবাদ করে প্রকাশ করতে, নিজেকেই খরচ যোগাতে হয়! মরার উপড় খাড়ার ঘা এর মত সাক্ষ্যাতকার নিয়ে, সাংবাদিক ভদ্রলোক, চা পানের জন্য কিছু টাকা চাওয়ায়, লেখক অনুবাদক, বেশী সাক্ষ্যাত দেননি।
তাই বইটির খুব একটা প্রচার পত্রিকার মারফত হয়নি। একুশের বই মেলায় "চারুলিপি"-র স্টলে অন্যশরীর পাওয়া যাবে। জার্মান সাহিত্যের মূল ধারার সাথে পরিচিত হতে চাইলে অন্যশরীর বইটি পড়ে দেখা যায়।
অনেক জটিলতার মাঝে, টাকাও একটা বড় বাঁধা থাকায়, আমার বই প্রকাশ হলনা, কিন্তু তীরন্দাজের বইটি অটোগ্রাম সহ উপহার পেয়ে, সে আক্ষেপ কিছুটা কমেছে। পঠক পড়ুক, সে বাসনায়, অন্যশরীরের সুস্বাস্থ কামনা করে, পুতুলের পুথি পাঠ এখানেই শেষ করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।