সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার
সুপ্রিয় সহব্লগার এক্সিমোর "মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামাতের রাজনীতি করার অধিকার নেই!" ও রাগ ইমনের "সবার কাছে একটি বিনীত অনুরোধ" পোষ্ট দু'টি পড়লাম। লেখা দু'টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী অপশক্তি জামাতকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার প্রতি আমার সামান্যতম দ্বিমতও নেই। বাবা মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনে নয়, বই পত্র পড়ে ইতিহাস ঘেটে নয়, নিজে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, অনুভব করেছি । বাবা মায়ের হাত ধরে পালিয়ে বেড়িয়েছি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। দেখেছি পাকি বাহিনী, রাজাকার আর আলবদরের অত্যাচার।
দেখেছি এ সময়ে জামাতের ভুমিকা ও ধর্মের নামে তাদের নিশৃংসতার জাতিবিদ্বেসী চেহারা। দেখেছি শহরে, গ্রামে ও গঞ্জে এ দলের কর্মীদের দোর্দন্ড দাপট, খুনী ও ভয়াল চেহারা । দেখেছি রাস্তা ঘাটে, আনাচে কানাচে, নদী এ খালে আমারই দেশমাতার সন্তানদের গলিত লাশ। এদের চেহারায় যে সাপের শীতলতা, তা দেখে অবোধ শিশুরাও শিউরে উঠতো। অনেক ক্ষেত্রে এদের নিশৃংসতা পাকি-সৈন্যদের অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এই জাতিবিদ্বেষী, ঘাতক জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা যে দাবী তোলা হয়ে, নীতিগতভাবে তার প্রতিও আমার পূর্ণ সমর্থন থাকলেও আমার মনে হয়না, তা দেশের জন্যে সুদুরপ্রসারী মঙ্গলজনক কোন ফলাফল বয়ে আনবে। তাতে দুষ্ট ফোড়াটি কেটে বাদ দেয়া হলো বটে, কিন্তু যে কারণে শরীরে ফোঁড়ার পচন ধরছে বার বার, তার কোন সুরাহা হলোনা। আমি আপনাদের মতোই একই ভাবে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ধ্বংস চাই। কিন্তু তাদেরকে নিষিদ্ধ করার পথে নয়, কারণ আমার বিশ্বাস এ পথে তাদেরকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।
আমাদের নিজেদের কিছু পাপ রয়েছে।
সবার আগে নিজেদেরকে পাপমুক্ত করতে হবে। নিজেদেরকে শোধন করতে হবে। নিজেদেরকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিশ্বাযোগ্যতা হারিয়েছে তাদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির পাপে। তাদেরকে, আমাদেরকে সে পাপ থেকে মুক্ত করতে হবে।
একমাত্র এ আত্মশুদ্ধিই হবে কোন একটি অশুভ চক্রকে নির্মুল করার করার একমাত্র পথ, একমাত্র শক্তি। তা না হলে এ অশুভ চক্র, শিকারী কুকুরের মতো ফিরে আসবে বারবার আমাদের নিজস্ব পাপের দুর্বলতার সুযোগে, আরো বেশী ভয়াল, আরো বেশী অশুভ শক্তিতে।
অনেকেই পাপের কথা তুললে বঙ্গবন্ধুর 'সাধারণ ক্ষমা' ঘোষনার কথাটি তুলে আনেন। তাদের সাথে আমি একেবারেই একমত নই। শেখ মুজিবরের 'সাধারণ ক্ষমা' কোন রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ্য করে ছিলনা, বরং ছিল সেসব ব্যাক্তিকে উদ্দেশ্য করে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজেদের ভুল অবস্থানকে বিচার করে নিজেদেরকে শোধন করার মানসিকভাবে তৈরী।
একটি দেশের জাতির পিতা হিসেবে সবাইকে নিয়ে দেশ গঠনের মহান উদ্দশ্যেই এ মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন শেখ মুজিব। (যেসব আবালরা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে মানতে চায়না, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলাম! নিজে কখনো আওয়ামী লীগ করিনি, কোন দলই করিনি, কিন্তু যেমনি শেখ মুজিব আমার কাছে অবশ্যই জাতির পিতা, তেমনি জিয়াউর রহমানও আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী। এদের ও লাখো মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমার হাজার সশ্রদ্ধ সালাম! আমাদের স্বাধীনতার প্রতি আমার এ সন্মানবোধ তা তাদের পরবর্তী যে কোন কর্মের উর্ধে তুলে রেখেছে। যাদের এ স্বাধীনতার প্রতি সন্মানবোধ নেই, তারাই এদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন তোলে ও তাদের প্রতি আমার ঘৃনা আবারও প্রকাশ করলাম। ) যারা এ মহানুভবতার অপব্যবহার করেছেন, এটা তাদের দোষ, শেখ মুজিবের নয়।
অনেক সময়েই একজন মহাঅপরাধীকেও তার শুদ্ধি ও অনুশোচনার পথ ধরে ক্ষমা করেন সে দেশের রাষ্ট্রনায়ক। তার অর্থ এই নয় যে, সে পাপকে বৈধ করা হলো। পাপ পাপই থেকে যায়। ইসলামের নাম করে রাজাকার ও আল বদর সংগঠনের মাধ্যমে পাকি দখলদারীদের সমর্থন ও নিজ দেশের জনগনের উপর ধর্ষন আর হত্যাজজ্ঞে যে পাপী জামাত, সে পাপকে কখনো ক্ষমা করেন নি শেখ মুজিব।
জার্মানী হিটলারের 'ন্যাশনালিষ্ট দলকে' নিষিদ্ধ করেনি।
কিন্তু তাদের আভ্যন্তরিন সু-রাজনীতির মাধ্যমে সেসব দলকে মাথা চাড়া দেয়ার সবরকম সুযোগকে বন্ধ করে রেখেছে। প্রতিটি গনতান্ত্রিক দলই (ডান বা বাম যাই হোক না কেন) তাদের নীতিগত বিরোধিতা, পার্লামেন্টে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সত্বেও এই ন্যশনালিষ্ট দলগুলোর প্রশ্নে একমত। কোন ইস্যুতেই এসব দলগুলোর সাথে গনতান্ত্রিক দলগুলোর কোন আদার প্রদান নেই। আমাদের পাপ, আমরা তা করিনি। আমাদের দেশের দলগুলো প্রয়োজনে ব্যবসা করে জামাতের সাথে।
আওয়ামী লীগ করেছে বিরোধী দলীয় আঁতাত করে, বিএনপি করেছে কোয়ালিশন করে। এটা বঙ্গবন্ধুর পাপ নয়, পাপ আমাদের স্বাধীনতাপরবর্তী রাজনীতির। সবার আগে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত দরকার, তার আগে যে কোন নিষেধের পথ অর্থহীন ও অশুভ।
বাংলাদেশের সাধারন মানুষ ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধ নয়। নিজেদের কলঙ্ক মোচন না করে, নিজের অর্থ ও প্রতিপত্তিলিপ্সার কাছে রাজনৈতিক নীতিবোধকে জলান্জলি দিয়ে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা তাদের কাছে কতোটা গ্রহনযোগ্য হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
একমাত্র নিজেদের পাপ মোচনের পরই সাধারণ মানুষ গনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বিশ্বাস করতে শিখবেন। তখনই তার বুঝতে শিখবেন, একটা দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার পথে ধর্মের চেয়ে রাজনৈতিক নীতিবোধ ও দেশের প্রতি ভালবাসায় বেশী দরকারী। তখনই তারা শিখবেন, জামাত ও ধর্মকে বেসাতি করে যে সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে চায়, তাদেরকে কিভাবে প্রতিহত করতে হবে। জামাত ও এসব দলগুলোর মুলোতপাটন একমাত্র এই পক্রিয়াতেই সম্ভব। তার আগে যে কোন নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহযোগ্যাতা পাবে না।
পরিনামে আরো বেশী শক্তিশালী হবে অশুভ মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হাত। আমি নিজেও বিশ্বাস করি, জামাতের এদেশে রাজনীতির কোন অধিকার নেই। কিন্তু আমরাই আবার এ অধিকার তাদেরকে দিয়েছি এবং গনতান্ত্রিক পথই হচ্ছে তাদের কাছ থেকে সে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার একমাত্র পথ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।