সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু ব্যাপারটা ঠিক এরকমই। এত বছরের জীবনে দেশে বিদেশে বহু জায়গায় গিয়েছি। অথচ বাড়ীর কাছে আরশী নগর সেখানেই যাওয়া হয়নি। এবার যখন তাই আমার কাছে তীর্থের মত যে রবী ঠাকুরের বাড়ি তা দেখার সুযোগ এলো তা হাতছাড়া না করেই রওনা হলাম। সময়টা ২৮ জানুয়ারী।
তীব্র শৈত্য প্রবাহের কারনে এই সফর সফল হবে কিনা তা নিয়ে বেশ কয়েকবার দ্বন্দ্বে পড়েছিলাম আমরা! এমন কি আমাদের বাঙলার বিভাগীয় প্রধান শ্রদ্ধেয় আল ফারুক স্যার একবার যেতে পরবেন না বলে ডেট পেছানোও হয়েছিল। পরে নির্ধারিত তারিখেই যাওয়া হল।
মরার উপর খাড়ার ঘা! ভোর সাতটায় বাস ছাড়বে। সাতটাতেই কলেজ গেটে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি সবচে যে জিনিসটার প্রয়োজন আজকে তাই আনতে ভুলে গেছি।
হ্যা আমার পরিচয় পত্রের কথা বলছি! কি আর করা ছুট ছুট! দ্রুত বাসায় গিয়ে আবার নিয়ে এলাম। এসে দেখি বাসে সামনের দিকে কোন জায়গা নেই। একেবারে পেছনের সিট এর এক কোনায় জায়গা হল। কি ঝাঁকুনিরে বাবা। পুরা থানকুনি ছেঁচা হয়ে গেলাম অর্ধ পথ যেতে না যেতেই।
সাতটা তিরিশে যাত্রা শুরু হল। অবশ্য সারা পথ রাসেলের গম্ভীরার রিহার্সাল শুনতে শুনতে গেলাম। রাসেল নানা হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত সময়ের অভাবে এই গম্ভীরা উপস্থাপন সম্ভব হয়নি। রাস্তায় কলা গাছ দেখিয়ে রাসেল তার নাতীকে বললো নাতী দেখ্যাছো এগলা সব হারঘে ডেসটিনির গাছ।
নাতী বললো এ্যাগলা ধইঞ্চা গাছ নাকি জি নানা?
মধ্যবিরতির মত আমরা দশ মিনিটের ব্রেক পেলাম হার্ডিং ব্রিজ এর কাছে এসে। সুড়ুৎ করে বের হয়ে এসে বাস চেঞ্জ করে ফেললাম।
ছবি দেখুন হার্ডিং ব্রিজের...
পাশেই লালন শাহ সেতু। সেতুর উপর দিয়ে চলে এলাম কুষ্টিয়া। লালন শাহ সেতুটির দৈর্ঘ্য ১.৮ কিমি এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।
সেতুটি নির্মান শুরু হয় ২০০৩ সালে। চীনের প্রতিষ্ঠান মেজর ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো এর নির্মান কাজ করেন। সেতুটির মোট লেন সংখ্যা চার। মোট স্প্যনের সংখ্যা ১৭টি। সেতুটি সম্পূর্ন যান চলাচলের জন্য উম্নুক্ত করে দেয়া হয় ১৮ মে ২০০৪ সালে।
সেতুটি তৈরীর ফলে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ জেলার লোকেদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)
তারপর একবার ভুল পথে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সাড়ে চার ঘন্টা পর পৌঁছাতে পারলাম রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে।
এখানে দেখার মত দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি তালিকা দেখুন-
কুঠিবাড়ির ডানপাশে একটা বড় দিঘি। ওখানে এই নৌকোটা দেখলাম
পাশেই নাগরদোলা।
চারপাশ ঘুরে এসে প্রবেশ করলাম কুঠিবাড়ির ভেতরে।
ঠাকুর পরিবার ৩০ বিঘা জমির ওপর এ কুঠিবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করে। তিনতলা এ কুঠিবাড়ির স্থাপত্যশৈলী অনেকটা প্যাগোডার মতো। দুই বিঘা জমির ওপর চোখজুড়ানো ও মনকাড়া অপরূপ দক্ষিণমুখী এ বাড়ির চারপাশে রয়েছে পদ্মার ঢেউ খেলানো বাউন্ডারি প্রাচীর। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী জেলার পতিসর ও পাবনার শাহজাদপুর নামক স্থানের জমিদারির মালিকানা পান। এসব জমিদারির কেন্দ্রস্থল ছিল শিলাইদহ।
জমিদারি কাজ তদারকি করার উদ্দেশ্যেই কবির ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথসহ অন্যরা কুষ্টিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর রূপ দর্শনে আগমন করেছেন শিলাইদহে।
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ অথবা ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’ কিংবা ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’—কবি রবীন্দ্রনাথের এমন অসংখ্য গান ও কবিতা রচিত হয়েছে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে।
বর্তমানে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বলতেই বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখচ্ছবি ভেসে উঠবে যে কারও চোখের সামনে। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি নামকরণের নেপথ্যের ইতিহাস কম-বেশি সবারই জানা। শিলাইদহ গ্রামটি ছিল বিরাহিমপুর পরগণার অন্তর্ভুক্ত।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় নদীয়া রাজ্যের (বর্তমান কুষ্টিয়া) অন্তর্ভুক্ত হয় এটি। মুর্শিদকুলি খান বিরাহিমপুর পরগণা নাটোর রাজরঘু নন্দকে ইজারা দেন। ১৮০০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর বিরাহিমপুর মৌজা নিলামে কেনেন। তিনি শৈলী নামের একজন নীলকরের কাছ থেকে এ কুঠি কিনে সেখানে বাসস্থান গড়ে তোলেন। কিন্তু কুঠিবাড়ি শিলাদেবীর মন্দিরসহ শিলাইদহ গ্রামটি প্রমত্তা পদ্মার সর্বগ্রাসী থাবা গ্রাস করে নেয়।
সে সময় শাহ মুখদুম মৌলুক খোরশেদের নামানুসারে খোরশেদপুর মৌজাতে ১৮৬২ সালে আবার নতুন কুঠিবাড়ি, ডাকঘর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু স্থানটির নাম খোরশেদপুর না হয়ে শিলাইদহই থেকে যায়।
কুঠিবাড়ির ভেতরে তৃতীয় তলায় এই নৌকোটা রাখা।
এই ছবিটি কুঠিবাড়ির পেছনের দিকে তোলা। লোহার দৃষ্টিনন্দন প্যাঁচানো সিঁড়ি।
এখানে তিনি রচনা করেন মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, ক্ষণিকা, নৈবদ্য প্রভৃতি। তার অনবদ্য সৃষ্টি গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্প রচিত হয়েছিল এখানেই, গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান সৃষ্টি হয় এই শিলাইদহে।
উপর থেকে সামনের অংশ।
আরেকটি ছবি দেখুন। আমাদের ভ্রমনের বেশির ভাগ কমিটির দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত সবুর মিয়া ভ্রমনে গিয়া কোন কাজ করেনাই।
দেখেন প্রমান দেখেন। কোনার দিকে খেয়াল কইরা দেখেন। কার যেন মনোযোগ দিয়া ছবি তোলে।
বের হয়ে আসলাম কুঠিবাড়ি থেকে । পেটে ততক্ষনে হরিন খরগোশ ছুঁচো সব ভীষন বেগে দৌড়াদৌড়ি করছে।
না মানে ইয়ে পেটে আগুন জ্বলছে!
কুঠিবাড়ি যাবার আগে দেখে গিয়েছিলাম রান্না চলছে!
খাবারের অপেক্ষায় শেষে একতারা তুলে নিলো কেউ কেউ। বিরস বদনে সদ্য কেনা একতারা বাজাচ্ছে আর কি!
অবশেষে খাওয়া দাওয়া লটারি সবই হল। একটা পাঁচ টাকা দামের পেন পাইলাম লটারিতে। এমন কপাল খারাপ। সব লাস্ট পুরস্কার ছিল এটা।
তারপর লালনের মাজারের পথে যাত্রা। পথে মীর মোশাররফ হোসেনের জমিদারবাড়ি যাবার কথা ছিল । সময় স্বল্পতার জন্য যাওয়া হলনা।
লালন কত্ত সুন্দর করে বলেছে গাঁজায় দম না নিতে। তারপরও আমার খালি আফসোস লাগছিলো গাঁজায় দম নিতে না পারার।
মোটামুটি ১৭ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাউল মতের উন্মেষ হলেও এই মত কে জনপ্রিয় করে তোলেন লালন শাহ। লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসুত্র তার নিজের রচিত অসংখ্য গান। কিন্তু লালনের কোন গানে তার জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য তিনি রেখে যাননি, তবে কয়েকটি গানে তিনি নিজেকে "লালন ফকির" হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন।
নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত: কিছুই বলিতে পারে না। "তথাপি কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতিরেকেই একটি সূত্রে তাকে হিন্দু কায়স্থ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যদিও লালন হিন্দু না মুসলমান এই কৌতূহল ও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে জীবদ্দশায়। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের মাজারসংলগ্ন কালী নদীর পাড়ে এই ম্যুরালটি নির্মাণ করা হয়েছে ।
মাজারের বাইরে বিভিন্ন ফকির ফকিরানীর কবর রয়েছে।
লালন শাহের মৃত্যু নিয়ে সুন্দর ঘটনা আছে। ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুরদিন রাত ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কে বলেনঃ “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতিই নীতিই পালন করা হয় নি। তারই উপদেশ অনুসারে তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি করা হয়।
আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।
(তথ্যসূত্র; উইকিপিডিয়া)
লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তাঁর বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরের সংরক্ষিত আছে।
যদিও অনেকের দাবী এই স্কেচটিতে লালনের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি। এটি সেই ছবি--
'আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়। । '
বের হয়ে এলাম মাজার থেকে।
তারপর কমলার সাথে বিস্কুট খেতে খেতে ফিরতে শুরু করলাম নিজের শহরের দিকে। সারাপথ বিভিন্ন বাংলা গান ঢোল আর খন্জনী বাড়িয়ে শুনিয়েছে আমাদের গুনধর বন্ধু শিল্পীরা।
দর্শকের রিকোয়েস্টে ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনেনা ,বন্ধু যখন বউ লইয়া, সাদা দিলে দাগা দিলা ক্যানে, বন্ধু আমার বিয়া হইব কবে এই টাইপ গান ও ছিল।
পরিশেষে দীর্ঘ পোষ্ট পড়ার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভবিষ্যতেও এরকম পোষ্ট পড়বেন আশা করি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।