আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বিদ্যাপীঠ আমার তীর্থ -১

বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।

আমার জন্ম ভূমি ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার বটিয়া গ্রামে। আমার জন্ম ভূমি আমার স্বর্গ। এর চেয়ে সুন্দর জায়গা আমার দৃষ্টিতে সারা পৃথিবীর কোথাও নেই।

এই গ্রামের স্কুলেই আমার প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল। আমি জীবনে প্রথম যে স্কুলে পড়ি তার নাম বটিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমি যখন এখানে ভর্তি হই তখন এটি একটি বড় টিনের ঘর ছিল । তবে কোন বেড়া ছিল না। মোট ৩ জন শিক্ষক ছিলেন।

এখানে এক বছর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পর কোন ছাত্র প্রথম শ্রেণীতে ক্লাশ শুরু করতে পারত। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মূলতঃ পড়ানো হত আদর্শ লিপি বই। সবগুলো অক্ষর চিনতে পারত এমন ছাত্র ছিল বিরল। তবে আদর্শ লিপি বইটি আমার মুখস্ত ছিল। কোনটি কোন অক্ষর তা বলতে না পারলেও ছবি দেখে পুরো বই পড়ে ফেলতে পারতাম।

এছাড়া গণিতও শিখতে হত। গণিতের মূল পাঠ ছিল ১,২,৩ গনণা শেখা। বছর শেষে ১০০ পর্যন্ত গুণতে শিখতে না পারলে খবর ছিল। সেই যা হোক কি ভাবে যেন প্রাক-প্রাথমিক পাস করে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু সমস্যা একটা রয়েই গেল।

এই ক্লাসেও পুরো বই ছবি দেখে মুখস্ত বলতে পারি। কিন্তু কোন শব্দ বানান করে পড়তে গেলেই যত সমস্যা। কিন্তু আমি অনেক কষ্ট আর চেষ্টা করেও এর কোন কুলকিনারা করে উঠতে পারলাম না। পুরো বই মুখস্ত বলতে পারি কিন্তু লেখা দেখে পড়তে গেলেই যত সমস্যা দেখা দেয়। এই ভাবেই শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণী পাস করে তৃতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম।

কিন্তু বানান করে পড়তে পারতাম না। তৃতীয় শ্রেণীতে উঠার পর হঠাত একদিন দেখি আমি ঠিকই বানান করে পড়তে পারছি। খুব মজা পেয়েছিলাম সে দিন। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ই একদিন আমরা কয়েকজন এই স্কুল ছেড়ে অনেক দূরের জয়পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যাই । কারণ ইতোমধ্যেই ঝড়ে স্কুলের ঘরটি পড়ে যায়।

এই ঘরটি আগের টিনের ঘর ভেংগে তৈরী করা হচ্ছিল। কিন্তু ঠিকাদার যিনি ছিলেন তিনি এক নম্বর ইটের বদলে ৩ নম্বর ইট দিয়ে আর সিমেন্টের বদলে কেবল বালি দিয়ে দেয়াল তৈরী করেছিলেন। এলাকার কোন মানুষ প্রতিবাদ না করলেও কালবৈশাখী ঝড় এক দিন প্রতিবাদ করল। ফলে কোন এক সন্ধ্যার ঝড়ে দুই নম্বরী দেয়ালসহ নতুন স্কুল ঘরটি পড়ে গেল। তখন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ক্লাস হতে লাগল।

কখনো আমগাছতলায়, কখনো সুপারি-নারকেল গাছতলায় চলছিল আমাদের স্কুল। তাই অন্য স্কুলে যেতে পেরে আমার বেশী খারাপ লাগেনি। অনেক পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে নিজের গ্রামের স্কুল ছেড়ে আমার অন্য গ্রামের স্কুলে যাওয়া সঠিক কাজ ছিল না। সেখানে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেয়া ছিল কঠিন। কারণ সেখানে ছাত্র ছিল অনেক বেশী।

তাদের অনেকের সাথে পেরে উঠা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে আমার প্রথম স্কুলে যেখানে আমার রোল নং ছিল ১ সেখানে নতুন স্কুলে গিয়ে আমার কোন অবস্থানই রইল না। রেজাল্ট ছিল খারাপ। ফলে আমি আমার নিজের উপরই যেন আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। গণিত বিষয়টা আমার কাছে বিষের মতো লাগতে শুরু করল।

কিন্তু কোন স্যারের সহযোগিতা পাওয়া ছিল অসম্ভব এক ব্যাপার । কারণ এতো ছাত্র-ছাত্রীকে আলাদা ভাবে বুঝানোর কোন সুযোগ ছিল না। ক্লাসে প্রচন্ড হৈচৈ আর চিৎকার হত। এরই মাঝে পড়া বুঝা আমার কর্ম ছিল না। ফলে ক্রমাগতভাবেই আমি অংক আর ইংরেজিতে খারাপ করতে লাগলাম।

চতুর্থ আর পঞ্চম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষায় গণিতে পেলাম মাত্র ২৮ । কেলেংকারীর এক শেষ। এই রেজাল্ট নিয়ে তো ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়া এক কঠিন ব্যাপার হবে। এই মহাখারাপ রেজাল্ট নিয়েই আমি আমার প্রাথমিক শিক্ষার পর্ব শেষ করলাম। দুই স্কুলে পড়ার কারণে আমার জীবনে অনেক শিক্ষকের দেখা পাই।

তবে কোন শিক্ষকের সাথে আমার ব্যক্তিগত ভাবে পরিচয় ছিল না। কারণ পরের স্কুলটা ছিল অনেক বড়। আর ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম অনেক নিম্নমানের। তবে প্রথম স্কুলের শিক্ষকদের মাঝে জনাব আব্দুল লতিফ ( প্রধানশিক্ষক) আর জনাব মেহরাজ উদ্দিন ভূইয়া ছিলেন । সর্বশেষ আমি যখন দেশ ছেড়ে আসি তখনো জনাব মেহরাজ আমার জীবনের প্রথম স্কুলে শিক্ষকতা করেই চলছিলেন।

সেই সময় তিনি প্রমোশন পেয়ে প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। সেই সময়ের শিক্ষকদের মাঝে আন্তরিকতা ছিল। নিজেরা যে খুব বেশী উচ্চ ছিলেন তা নয়। তারপর তারা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। পড়া শিখানোর মূল উপকরণ বলতে ছিল চক, ডাস্টার আর বেত।

মাঝে মাঝে টাকার অভাবে বেত কিনতে না পারলে বাশের কঞ্চি ছিল মহাস্ত্র। ক্লাশে পড়া না পারলে বেতের আঘাত যেমন সইতে হত তেমনি দুই হাতে কানে ধরে বেঞ্চের উপরে দাড়িয়ে থাকাও ছিল আরেক শাস্তি। কেউ কেউ এটাকে আবার অপমানজনক শাস্তি বলে মনে করত। তবে আমার কাছে বেতের আঘাত পিঠে নেবার চেয়ে দুই হাতে কানে ধরে বেঞ্চের উপরে দাড়িয়ে থাকতে খুব একটা খারাপ লাগত না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.