আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনাজপুর



উত্তর দিনাজপুর পশ্চিমবঙ্গের নবীনতম জেলা। ভারতভাগের সময় দিনাজপুর জেলাকে দুটিভাগে বিভক্ত করে একটি অংশকে পশ্চিম দিনাজপুর নাম দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সংঙ্গে যুক্ত করা হয়। অপর মুল অংশটি পূ্র্ব-পাকিস্তান অধূনা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। পশ্চিম দিনাজপুরকে আবার দুটিভাগে বিভক্ত করে একটি অংশের নাম উত্তর দিনাজপুর ও অপরটির নাম দক্ষিণ দিনাজপুর হয়। মুল দিনাজপুর বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত ।

প্রাচীনকালে গঙ্গানদীর উত্তরাংশের বাংলা এবং বিহারের কিছু অংশ উত্তরবঙ্গ নামে পরিচিত ছিল । বাংলার এই অংশে প্রস্তরযুগের কোনো চিহ্ন এখনো আবিস্কৃত হয়নি । এটা অনুমান করা হয় যে, নব্যপ্রস্তর যুগে এই ভূখন্ডের জমি গোচারণ এবং কৃষির পক্ষে উপযুক্ত ছিল । এলাকাটি বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত হয়। এতদঞ্চল থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ শতকে প্রথম মানব পদচারণার চিহ্ন আবিস্কৃত হয়েছে (১) ।

দিনাজপুর পূরাতত্ত্বের জন্যও বিখ্যাত । আর্য সভ্যতার আগে বাংলার উত্তরাংশে দিনাজপুরের ভূখন্ডসহ এলাকাটিতে শক্তিশালী পুন্ড্রাগোষ্ঠী তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল । সমগ্র অঞ্চলটি পুন্ড্রবর্ধনভূক্তি নামে পরিচিতি লাভ করেছিল । সমগ্র পুন্ড্রবর্ধনভূক্তি আবার কতগুলি 'বিষয়'-এ বিভক্ত ছিল । এমন একটি বিষয় ছিল 'কোটিবর্ষ'।

অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশ পুনর্ভবা ও আত্রেয়ী নদীর মধ্যস্হিত এলাকাটি কোটিবর্ষ বিষয় নামে পরিচিত ছিল (২) । তার কেন্দ্রস্হল ছিল বাণগড়, যা বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর মহকুমার একটি দ্রষ্টব্যস্হল । কালের নিয়মে ধীরে ধীরে পুন্ড্রাজাতির মধ্যে আর্য্য সভ্যতার মিশ্রণ ঘটেছিল । পুন্ড্রাজাতির পতনের পর বাংলার এই অংশটি মৌর্য্যদের অধীনে আসে এবং পরবর্তীকালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলার এতদঞ্চল বহিরাক্রমনের লক্ষ্যস্হল হয়ে ওঠে ।

ক্রমান্বয়ে মুখৌরী বংশ, চালুক্যরাজ কীর্তিবর্মা (৫৬৭-৫৯৮), মালব্যরাজ মহাসেন, কাশ্মীররাজ তিলকাদিত্য (৭২৪-৭৬০), ভাস্কর বর্মন এবং হর্ষবর্ধন-এর মতো শাসকগণ এই এলাকায় তাঁদের শাসন কায়েম করেন (৩) । পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চল শেরশাহের শাসনের অধীনে আসে । দিনাজপুর, বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী পাল রাজাদের অধীনে নবম খ্রীষ্টাব্দে আসে । অতঃপর সেনরাজাগণ দিনাজপুরের কর্তৃত্ব লাভ করেন । ১২০৪-০৫ খ্রীষ্টাব্দে ইখ্ তিয়ার উদ্দীন মহম্মদ বিন বখ্ তিয়ার খিলজির নিকট লক্ষ্মণ সেন পরাজিত হলে দিনাজপুর সুলতানী শাসনের অধীনে যায় (৪)।

১২৮৭-থেকে ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ অবধি দিনাজপুরের ভূখন্ডে অসংখ্য মুসলিম শাসক শাসন করেন । পনের শতকের শুরুতে দনওয়াজের একজন হিন্দু হেকিম, যিনি রাজা গণেশ নামে পরিচিত ছিলেন, ১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে দিনাজপুর রাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে রাজা মহম্মদকে পরাজিত করে দিনাজপুরের কর্তৃত্ব লাভ করেন এবং রাজা দনুজ বা দনুমর্দনদেব নামে পরিচিতি লাভ করেন (৪)। তাঁর শাসনাধীন ভূখন্ড দিনাজপুর নামে চিহ্নিত হয়। অন্যমতে, ১৭২২-১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়ে 'দিনাজপুর' নামটির প্রচলন হয় ।

ইতিমধ্যে রাজমহলের যুদ্ধে (১৫৭৬) পরাজয়ের সাথে সাথে স্বাধীন সুলতানদের শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং বাংলার এই অংশটি আফগানদের অধীনে চলে যায়। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন মোঘল অধীনে থাকার পর ১৭৫৭ সালে মোঘল শাসনেরও অবসান ঘটে। কথিত আছে যে,১৭ শতকের শুরুতে কাম্রী নামে একজন দিনাজপুরের ছয়টি পরগণার স্বত্ব লাভ করেন। এবং এভাবেই বাংলার এই অংশে জমিদারী প্রথার জন্ম হয়। ১৭ শতকের শেষ ভাগে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে রাজা প্রাণনাথ নামে এক ব্যক্তি দিনাজপুরের জমিদারী লাভ করেন ।

তিনি একজন সামন্ত রাজার মতো জমিদারী চালাতেন। মোঘল আমলে ১৭১৭ থেকে বাংলার স্বাধীন নবাবগণ দিনাজপুর সহ বঙ্গদেশ শাসন করে গেছেন। পলাশীর যুদ্ধের পর বৃটিশরা ক্ষমতায় আসা অবধি তাঁরাই ছিলেন এখানকার শাসক। বৃটিশ আমলে স্হাপিত হেমতাবাদ থানা (বর্তমানে উত্তর দিনাজপুরে)মোঘল আমলেও একটি উল্লেখযোগ্য স্হান হিসাবে পরিচিটি লাভ করেছিল। ১৭৬৫-তে দিনাজপুরের জমিদারী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে আসে।

১৭৮১-তে প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিল প্রথা রদ হয় এবং তার স্হল 'জেলা' ধারনা প্রবর্তন করা হয়। জেলাগুলিকে কালক্টরের অধীনে আনা হয় । দিনাজপুর জেলা ১১১৯ বর্গমাইল এলাকা এবং ১২১টি পরগনায় বিভক্ত ছিল (৫)। ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে জেলার আয়তন বাড়িয়ে ৩৫১৯ বর্গমাইল করা হয়। চিরস্হায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়ন হলে জেলার আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ৫৩৭৪ বর্গকিলোমিটার।

প্রতিবেশী মালদা, বগুরা, রংপুর এমনকি পূর্ণিয়া জেলারও বৃহৎ অংশ দিনাজপুরের সাথে যুক্ত হয়েছিল। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ইংরেজরা জেলাটিকে দিনাজপুর সদর, ঠাকুরগাঁ ও বালুরঘাট এই তিনটি মহকুমায় ভাগ করে। জেলায় ৩১ থানা ছিল । ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষে এখানে অগনিত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের পরপর বাংলার এই অংশে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সুত্রপাত ঘটে।

অত্যাচারী জমিদারদের এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক,বুরহানা ফকির এবং আরো অনেকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয়। আবার ১৮৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এই জেলার ভয়ানক ক্ষতি হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দিলাজপুর জেলা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯০১ সালে ম্যালেরিয়া মহামারীরূপ নেয় এবং প্রতি হাজারে ৩৫.২৭ জন মানুষ মারা যায় (৬)। ১৯৪৭ সালে হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতে দিনাজপুর বিভাজন হয়।

দিনাজপুর সদর মহকুমার ৬টি এবং বালুরঘাট মহকুমার ৪টি থানা নিয়ে পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়। তথ্যসুত্র: দিনাজপুর : ১,২,৩,৫ - ইতিহাস ও ঐতিহ্য - সম্পাদক, শরীফ উদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ ইতিহাস সামিতি-১৯৯৬। ৪,৬ - Gazetteer of Bengal and North East India - B.C. Allen, E.A.Gait, C.G.H.Allen and H.F.Howard - Mittal Publication, New Delhi, 1979.

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.