। বাউন্ডুলে ব্লগার। যখন ক্লাস সেভেনে উঠেছি তখন বাবার ছোট্ট একটা সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে আমার হলো। অন্য ভাই-বোনদের এবিষয়ে কোনরূপ হিংসা-বিদ্বেষ দেখা গেল না বিন্দুমাত্র! সম্পত্তিটি ছিল একখানা কাঠের আলমিরা! তার ভিতরে ছিল কিছু বই। আর একারণেই এবিষয়ে অন্য কারো কোন আগ্রহ ছিল না।
একমাত্র আগ্রহী উত্তরাধিকারীকে সেই আলমিরার চাবি একদিন হাতে তুলে দিয়ে বাবা বললেন, ‘‘দেখ এযুগে এসব আর কারো কাজে লাগবে না। বাড়ির সব বাতিল জিনিসের প্রতি তোমার আগ্রহ বেশী! এই চাবিটাও বহুবার চুরি করেছ, কেন জানি না। কাজে লাগবে না, তবুও বড় হয়ে বইগুলো পড়বে। মনে রেখ এগুলো বড়দের বই। চাবির জন্য আর এখানে ওখানে হাত টান দিতে হবে না।
বইগুলো কাউকে দিবে না। এগুলো তোমার নিজের, তাই যত্ন করে রাখবে। ”
আসলে বাবার চালাকিটা ধরতে পেড়েছিলাম বড় হবার পরই। বাবা খুব ভাল করেই জানতেন যে, ‘বড়দের বই’ তকমাটি জুড়ে দিলেই তাঁর এই বোম্বেটে পুত্রটি সব বই পড়ে শেষ করবে!
অনেক বইয়ের মধ্যে যে বইখানি প্রথমেই নজর কেড়েছিল সেটি ছিল ভ্লাদিমির ইলিওনচ লেনিন। বইখানার মলাট ছিল আকৃষ্ট করবারই মতন।
মস্কোর প্রগতি প্রকাশনীর বই বলে কথা। পড়লাম, কিন্তু খুব একটা বুঝতে পারলাম না অনেক কিছুই। বাবার কাছে জানতে চাইলে, তিনি বললেন, বড় হয়ে নিজে নিজে বুঝে নিও। দ্বিতীয় বইটি ছিল এডলফ হিটলারের জীবনী! বেশ মজা পেয়েছিলাম বইখানা পড়ে, কারণ এই লোকটি পাগলাটে প্রকৃতির ছিলেন। তখনো এই মানুষটির কৃত কর্ম বা অপকর্ম বুঝে উঠবার মতন বয়স হয়ে ওঠেনি।
এর পর হাতে তুলে নিলাম এ্যালবার্ট আইনষ্টাইন এর জীবনী। এক নাগাড়ে ৬ বার পড়েছিলাম। এরপর এল ১৪ টি খন্ডের একরাশী পুস্তক পড়বার পালা। মার্কস ও এঙ্গেলস এর নির্বাচিত রচনাবলী! ইতিমধ্যেই ক্লাস এইট এ উঠেছি। পড়া শুরু করলাম।
শেষ করলাম ক্লাস নাইন এ উঠে। কিছু কিছু বুঝতে শুরু করেছি! প্রলেতারিয়েত মানে সর্বহারা। বুর্জয়া মানে হলো শোষণকারী শিল্পপতি। সমাজ কাঠামো, সামাজিক স্তরবিন্যাস, উদ্বৃত্ব উৎপাদন, মূল্য; বিচ্ছিন্নতাবোধ, কিভাবে বিল্পব আনা সম্ভব, সামাজিক উত্তরণ, আদিম সাম্যবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরই মাঝে শৈরাচার পতনের আন্দোলন হয়ে গেল।
স্কুল থেকে পালিয়ে মিছিলেও অংশ নিয়েছি। কুকুরের গলায় শৈরাচারের ছবি ঝুলিয়ে তখন বড়ভাই রা মিছিল করত।
এস এস সি পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তী হলাম। শুরু হলো ছাত্রমৈত্রীর সঙ্গে পথচলা। জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি একবারে মফস্বলের কমরেডদের।
নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোতে এই কমরেড ভাইদের জুড়ি মেলা দায়। আর জাতীয় নেতারা নিজের খেয়ে নয়, বরং অন্যের খেয়ে এই কমরেডদের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার আজও মনে পড়ে কৈটোলা বাজারে শামচুল বাইয়ের সঙ্গে গভীর রাতে পোড়া মবিল দিয়ে চিকা মারতে গিয়ে গায়ের লোম দাড়িয়ে যেত।
তারপর, আমার মতন সামচুল ভাই ও বুঝেছিলেন এ করে আর লাভ নেই। নেতারাই আদর্শ বিচ্যুত।
সব ছেড়ে দিলাম। লোহা লক্কর জমা, জানটা নিয়ে পালা! লেখা পড়া তো আগেই শিকেয় উঠেছিল। কোনরকমে প্রানটা নিয়ে রাতের আধারে পালিয়ে বাচলাম। বাবার ছেলে, বাবার কোলে। বাবা কথা বার্তা বন্ধ করে দিলেন।
বাড়িতে ফিরবার সময়, ভুল করে ব্যাগের পকেটে একখানা বিচি রয়ে গিয়েছিল! পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। মা সেটিকে সযত্নে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বাবা সম্ভবত সেই বিচি বাড়ীর পাশের পুকুরে রোপন করেছিলেন। যথারীতি সেই বিচি থেকে গাছ হলো, ডাল-পালা মেলতে থাকলো। পাড়ার বখাটেগুলোও সালাম দিত বাইরে গেলে! এমনকি ছেলে ছোকড়ার দল বিচার নিয়ে আসতে লাগল, ‘‘ভাই আমাদের পাড়ার অমুক মেয়েকে অমুক পাড়ার কয়েকটা ছেলে বিরক্ত করছে।
”
আমার উত্তর! ‘‘ঠিক আছে দেখিয়ে দিস, বলে দেবোখন, এদিকে যেন আর না আসে”।
এসব জনসেবার ফাকে শুরু হলো আমার পুনরায় পথচলা। লক্ষ্য যেভাবেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাব। সাইন্স ছেড়ে কলা খেলুম! আবার ভর্তী হলাম বাড়ীর কাছের এক কলেজে। পরীক্ষা দিলাম।
সবকলেজের ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজীতে বেশী নম্বর পেলাম। কিন্তু যুক্তিবিদ্যায় ফেল!!!! কলেজের স্যাররাও বিরক্ত! অবশেষে যুক্তিবিদ্যার স্যার বিনেপয়সায় পড়াতে শুরু করলেন আপদ বিদেয় করবার উদ্দেশ্যেই! অবশেষে পাশ! কোন কোচিং নেই। গাইড নেই। ফর্ম তোলার পয়সা নেই। এক বন্ধু ধান চালের ব্যবসা করত।
সে পাঁচশ টাকা দিয়ে বললো, ‘‘যা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী হ। আমরা তো লেখা পড়াটা ছেড়েই দিলাম, তুই আছিস নীলমনি! দেখ তোর বাবার মান পুনরুদ্ধার করতে পারিস কিনা। তুই পারবি। ” আমার সেই বন্ধু আজও আমার বন্ধু। তো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম।
‘‘সমাজবিজ্ঞান”!!!! বাবা আবার আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। খরচের টাকা দেওয়া শুরু করলেন। শুধু বলেছিলেন, ‘‘বাবা তোর ভুল ছিল না রে। ভুলটা আমারই ছিল। তোর হাতে অত অল্প বয়সে এসব বই আমার তুলে দেয়া উচিৎ হয়নি।
যা হবার হয়েছে। আমি জানি তুই জীবনে আর ভুল পথে যাবি না। তোর যা ভালো লাগবে তাই করিস। তুই আমার বংশের প্রথম সন্তান যে বিশ্বাবদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। আমি টাকার অভাবে পারিনি।
এডওয়ার্ড কলেজের বারান্দায় বসে কেদেছিলাম। ভর্তীর টাকা ছিল না। খরচ দেবারও কেউ ছিল না। অবশেষে জামিরতা স্কুলের হেড মাষ্টার (বাবার এই শিক্ষক কে আমরা দাদা বলে ডাকতাম) সঙ্গে করে নিয়ে পাবনা পলিটেকনিকে ভর্তী করে দিয়েছিলেন প্রথম ব্যাচে। তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিস, তুই এখন আমার চেয়ে অনেক জ্ঞানী।
তোর জীবন তুই বেছে নিস। ”
বাবার কথাই সত্যি হলো। জীবনে আর ভুল করিনি। রাজনীতিতে আর জড়াইনি। তবে মার্কস এঙ্গেলস গুলে খেয়েছি।
সাম্যবাদ বলি আর সমাজতন্ত্র বলি সবই গুলে খেয়েছি সমাজবিজ্ঞানে সরবোচ্চ ডিগ্রী পাওয়ার সুবাদে। এই আলোকে এবং নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ‘‘ওসব আর চলবে না। দেখুন না, পুজিবাদী আধুনিক শিল্পবাদী সমাজব্যবস্থায় পুজিবাদী গণতান্ত্রীক সরকারের মাননীয় শিল্প মন্ত্রী একজন সাম্যবাদী”। তেমনি মাননীয় তথ্যমন্ত্রী। এরা পুজিবাদী শিল্প সমাজের গাড়ীতে পতাকা টানিয়ে শোষিত, বঞ্চিতের কথা ভাববেন? সে আশা না করাই ভাল।
আচ্ছা বলুন তো, পৃথিবীর বুকে কোন তত্বটি যেকোন ধর্ম আবির্ভাবের চাইতেও বেশী আলোড়ন তুলেছিল সমগ্র বিশ্ব্যবাপী? উত্তরটি হলো ‘‘মার্কসবাদ”। মার্কসবাদ এখন সমাহিত। কাজেই তরুণ কমরেডদের প্রতি আমার অনুরোধ, নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলুন। আপনার নেতারা আপনাদের মতন কমরেডদের কথা চিন্তা করবার সময় পান না। পুজিবাদ এখন আপনার আমার সকলেরই ধর্ম।
মানেন আর নাইবা মানেন, মানুষের ধর্ম দুইটা, একটা সমম্পর্কে আমরা জানিনা কিন্তু প্রতিনিয়ত পালন করে চলেছি। আর অন্যটি সম্পর্কে জানি যে এটি আমার ধর্ম, কিন্তু পালন করি না। প্রথমটি হলো পুজিবাদী অর্থনীতি, আর দ্বিতীয়টি হলো ইসলাম, খ্রীষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।