আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপারেশন মোনায়েম খান কিলিং (এক)



তার সঙ্গে আমার পরিচয় বছর চারেক আগে দৈনিক যুগান্তরে কাজ করার সময়। তখন বন্যায় ঢাকার নিম্নাঞ্চল ডুবতে শুরু করেছে। মোজাম্মেল হক, বীর প্রতীক (৫০) আবার ঢাকার উপকণ্ঠ ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। তো বন্যা দুর্গত আর ও ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে তিনি তখন খুব ব্যস্ত। কালো রঙের একটি সেড তোলা টুপি পড়ে দিনরাত মোটর সাইকেল দাবড়ে বেড়াচ্ছেন।

আমি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসী ভূমিকার কথা আগেই জেনেছিলাম পত্রিকা পড়ে। সে সময় তাঁর ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এ নিয়ে কথা হয়নি। তবু পেশাগত সম্পর্কের বাইরে এক ধরনের শ্রদ্ধাপূর্ণ বন্ধুত্ব হয়। মানুষ হিসেবে তিনি খুব স্পষ্টবাদী, কাউকে তোয়াক্কা করা তার ধাঁতে নেই। সে সময় একগাদা সাংবাদিকের সামনে এক দুপুরে চরম বিরক্তির সঙ্গে তিনি বলেই ফেললেন, 'খোকা ভাই (মেয়র সাদেক হোসেন খোকা) আসবেন বিকালে।

এর আগে ত্রাণ দিতে উনি নিষেধ করেছেন। মেয়র হিসেবে উনি ত্রাণ কাজের উদ্বোধন করতে চান! আরে মিয়া, সেই সকাল থেকে বন্যার্তরা এক হাতা খিচুড়ি খাওয়ার জন্য রোদের মধ্যে বসে আছে। খিদা কি আর এই সব মেয়র - ফেয়র, আর টিভি ক্যামেরা বোঝে? ত্রাণ লাগাও, ত্রাণ লাগাও। মেয়র আসলে তখন দেখা যাবে!' তার নির্দেশে তখনই খিচুড়ি বিতরণ শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় বিএনপি নেতারা আর পুলিশ কর্মকর্তারা কী যেনো তাকে বোঝাতে চান, মাইকের শব্দে ভাল করে বোঝা যায় না।

মোজাম্মেল ভাই শুধু মাথা নাড়েন। মাছি তাড়ানোর মতো বার দুয়েক হাত নাড়েন নেতা আর পুলিশ কর্তাদের উদ্দেশে। * জনপ্রিয় এই মানুষের সঙ্গে ঘন্টা তিনেক আলাপচারিতা হয় সেদিন। বিষয় -- মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রিয় পাঠক, আসুন তারই বয়ানে শুনি, ১৯৭১ এর সেই আগুন ঝরা দিনগুলোর কথা।

শুনি, কিশোর মুক্তিযোদ্ধার সেই দুর্ধর্ষ 'অপারেশন মোনায়েম খান কিলিং' এর কথা। ... '১৯৭১ সালে আমি শাহীনবাগের স্টাফ ওয়েল ফেয়ার হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স মাত্র ১৪ বছর। বাড্ডা, ভাটারা, ছোলমাইদ তখন পুরোপুরি গ্রাম। মাইলের পর মাইল ধানের ক্ষেত, খাল - বিল - জলায় বিস্তৃর্ণ এলাকা।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টও তখন খুব কাছে মনে হয়। পাকিস্তানী সেনারা প্রায়ই আমাদের গ্রামের আশেপাশের মাঠে প্রশিক্ষণ নিতো। ...আমার বাপ - চাচারা সবাই কৃষক, নিরক্ষর মানুষ। আমরা স্কুলে পড়ি। পড়ার ফাঁকে তাদের কৃষিতে সাহায্য করি, গরু চড়াই।

' '২৫ মার্চের রাতে বাবা ধানী জমিতে সেচ দিচ্ছিলেন। আমি গিয়েছি তাঁর জন্য খাবার নিয়ে। হঠাৎ ক্যান্টনমেন্ট থেকে গুলির শব্দ। মর্টারের ফায়ার আর ফ্লেয়ার গানের আলোয় পুরো আকাশ মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে। ... বাবা বললেন, যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। ' আমি তাকে জিগেষ করি, 'আপনি ওই বয়সে যুদ্ধে গেলেন কোন চেতনা থেকে?' তিনি বলেন, 'তখন ওই বয়েসেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাক সেনাদের অত্যাচারের বেশ কিছু কথা আমরা শুনেছিলাম। গ্যারিসন সিনেমা হলে স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের এক লোক। পাক সেনারা তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে। এছাড়া আমাদের গ্রামের পাশে প্রশিক্ষণ নিতে এসে তারা সদ্য প্রসূতি আরেক গৃহবধূকেও গণধর্ষণ করে।

' 'আমরা বাসে চড়লে অবাঙালী কন্ডাক্টর - হেল্পাররা আমাদের সিট থেকে তুলে দিয়ে বিহারীদের সেই সিটে বসতে দিতো। তাছাড়া সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা, বিকমের ছাত্র আনোয়র হোসেন (বীর প্রতীক) ভাই আমাদের বলতেন, পূর্ব পাকিস্তানে কাগজের কল হওয়া সত্বেও এখানে কাগজের দিস্তা যখন ১৪ আনা, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কাগজের দাম ছিলো ৬ আনা। বাবার কাছে শুনেছিলাম, ১৯৬১ - ৬২ তে পাকিস্তান সরকার আমাদের তিন একর জমি অধিগ্রহণ করে মাত্র দেড় হাজার টাকা দাম দিয়েছিল। ' 'আনোয়ার ভাই বলতেন, দেশ স্বাধীন করে বাঙালিদের নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে এই সব অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ২৫ মার্চের পর রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে শুনতাম পাক সেনাদের বর্বরতার কাহিনী।

শুনতাম মুক্তি বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর। এ সবই আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। ' * মোজাম্মেল হক বলে চলেন, 'আমি অন্য তিন চাচাতো ভাই আজাহারুল ইসলাম বকুল, গিয়াস উদ্দিন ও আবু সাঈদের সঙ্গে পরামর্শ করলাম, এক রাতে রহিমুদ্দীন ও আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে ত্রিপুরা যাবো। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করবো। কিন্তু পরিকল্পনা বাড়িতে আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আমি, বকুল আর সাঈদ পালাতে পারিনি।

অন্য ঠিকই ত্রিপুরা চলে গিয়েছিলো। ' 'এদিকে আমার মন মানে না। স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনি, দেশের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। মনে হয়, সব তরুণ - যুবারা যুদ্ধ করছে, আর আমরা মায়ের আঁচলের ছায়ায় আরাম - আয়াশে আছি। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।

১০ - ১৫ দিন বাড়িতে বসে থাকার পর আমি আর সাঈদ আবার যুক্তি করলাম, বাড়ি থেকে পালাবো, যুদ্ধে যাবো। এবার বাবা - মাকে বললাম, যদি টাকা - পয়সা দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি না দাও, তাহলে টাকা - পয়সা ছাড়াই বাড়ি থেকে পালাবো। তখন বাপ - চাচারা পরামর্শ করে টাকা - পয়সা দিয়ে আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন। ' 'তাহলে শেষ পর্য়ন্ত বাড়ির সম্মতিতে যুদ্ধে যান?' 'হ্যাঁ, আমি আর সাঈদ কিছু টাকা জুতোর ভেতর আলাদা করে লুকিয়ে, জামা - কাপড় গুছিয়ে এক রাতে রওনা হই। নরসিংদী পর্যন্ত বাসে, তারপর লঞ্চে কমিল্লার নবীনগর।

শুনেছিলাম, কুমিল্লার সিএনবি রোড পার হলেই ত্রিপুরার বর্ডার। পথে পথে শত শত মানুষের দেখা পাই, যারা পরিবার - পরিজন নিয়ে দলে দলে শারণার্থী হিসেবে ভারত যাচ্ছেন। কেউ বা আবার যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। কুমিল্লা পৌঁছে আমরা একটি রিকশা ভাড়া নেই সিএনবি রোড যাবো বলে। ' 'কিন্তু রিকশা ওয়ালা আমাদের ঘুর পথে নিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা করে ফেলে।

তখন আমরা রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করি। পথ - ঘাট কিছুই চিনি না। এক লোক আমাদের এসে বলে, আপনারা আমার বাসায় চলেন, রাতটা কাটান, ভোরে আমরাই আপনাদের বর্ডার পার করে দেবো। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। ' 'উপায় না দেখে আমরা সেই রাতে ওই লোকের বাসায় উঠি।

রাতে খাবারের জন্য একটা মোরগ কিনবে বলে সেই লোক আমাদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেয়। সারারাত বর্ডারে মর্টার বিনিময়ের শব্দ শুনি। গোলাগুলি বন্ধ হলে ভোরের দিকে দুজন লোক আমাদের সিএনবি রোডে নিয়ে যায়। তারা গোমতি নদী দেখিয়ে বলে, ওই পারে ইন্ডিয়া। লোক দুজন আমাদের পকেট হাতড়ে টাকা - পয়সা সব রেখে দেয়।

জুতার ভেতরে লুকানো সামান্য কিছু টাকা তখন আমাদের শেষ সম্বল। ' 'লুঙ্গী পরে ছোট্ট গোমতি নদী হেঁটে পার হই। ত্রিপুরা সীমান্তের উঁচু পাহাড় দেখা যায়। ' আমি বলি, 'তাহলে, সীমান্ত পার হয়ে ট্রেনিং নিলেন। আর যুদ্ধ শুরু হলো?' 'আরে নারে ভাই, অত সহজে হয় নাই।

প্রথমবার ভয়ে পালিয়ে এসেছি। ওপারে গিয়ে কোনাবন হয়ে কলেজটিলা ট্রিনিং ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে ক্যাম্প চিফ ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা রশিদ ভাই। সেখানে আমাদের ১৫ দিন রাখা হয়। থাকা - খাওয়ার অবস্থা আর বলতে! খাবার বলতে শুধু ডাল আর ভাত।

আর ডাল যে দুর্গন্ধ হতে পারে, তা বলার নয়। আমরা রশিদ ভাইকে অতিষ্ট করে মারি, ভাই, আমাদের ট্রেনিং এ পাঠাবেন না?' 'তিনি আমাদের পাঠালেন পাশের নির্ভয়পুর ট্রেনিং ক্যাম্পে। সেখানে পৌঁছে দেখি, ক্যাম্পের নামই শুধু নির্ভয়পুর, আসলে নবাগতদের ভয় পাওয়ানোর মতো সব রকম ব্যবস্থাই সেখানে আছে। ট্রেনিং নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সবার ‘চোখ উঠেছে’। জ্বর আর ডায়রিয়ায় একেকজনের অবস্থা কাহিল।

পরিস্থিতি দেখে নামধাম রেজিস্ট্রি করার আগেই আমার চাচাতা ভাই বেঁকে বসে। সে আমাকে বলে, চল, আমরা পালিয়ে দেশে ফিরে যাই। এখানে ট্রেনিং নিতে গেলে আর বাঁচতে হবে না। যুদ্ধের আগেই অসুখে এখানেই আমাদের মরতে হবে!...তার কথা শুনে আমি সত্যি সত্যি ভয় পাই। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা চোরের মতো পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসি।

'... (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।