লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। অপারেশন চশমা
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আমার ভয়াবহ বিপদ। চশমাটা হারিয়ে গেছে।
সকালে উঠেই বলতে গেলে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি।
চশমাটা বালিশের পাশেই থাকে, ঘুমনোর সময় এখানে রাখি, আবার ঘুম থেকে উঠে পরে নিই, কিন্তু আজ ওটা ওখানে নেই। কোথায় গেল? চশমা ছাড়া আমি চলবো কী করে? অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে? অসম্ভব। চশমা আমাকে খুঁজে পেতেই হবে, যে করেই হোক।
আমার চশমার পাওয়ার মাইনাস ছয়, দুই চোখেই।
যারা চশমা পরেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমার সমস্যা কত গুরুতর। চশমা ছাড়া আমি অন্ধের কাছাকাছি।
আমি দেয়াল ধরে ধরে মায়ের ঘরে হাজির হলাম। মা, আমার চশমাটা দেখেছো? পাচ্ছি না।
কই, না তো।
তোর বিছানাতেই তো থাকে।
আমিও তো তাই বলি, সেখানেই তো থাকে। কিন্তু পাচ্ছি না কেন?
ভুলে অন্য কোথাও রেখেছিস হয়তো। খুঁজে দ্যাখ গে ভাল করে।
তুমি একটু খুঁজে দাও না, মা।
আমার হাতে এখন কত কাজ। নিজে খুঁজে বের কর। সামান্য চশমাটাও খুঁজে বের করতে পারবি না, মা-কে খুঁজে দিতে হবে?
এর পর আর কথা চলে না। মা রান্নাঘরে চলে যান।
আমি চশমা অনুসন্ধান অভিযান শুরু করি।
চিরুনি অভিযান। এলোমেলোভাবে খুঁজলে চলবে না, অত্যন্ত সিস্টেম্যাটিক উপায়ে এগোতে হবে। খুব ঠাণ্ডা মাথায়, বরফশীতল মস্তিষ্কে।
আমার ঘরের সব জায়গা, সব চিপা-চাপা খুঁজে ফেলেছি, কাজেই ঐ ঘর এখন সন্দেহতালিকার বাইরে। এখন অন্য সন্দেহভাজন জায়গাগুলো খুঁজতে হবে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মহামূল্য চশমা উদ্ধার করতে হবে।
অপারেশন গ্লাসেস। নিজেকে হঠাৎ শার্লক হোমস জাতীয় কেউ বলে মনে হয়, হোক না সামান্য চশমা। মনে মনে সামান্য শিহরণ অনুভব করি।
কে নিতে পারে আমার চশমা? বাবা নেয় নি তো? বাবার চোখের অবস্থাও আমার মতো খারাপ। হয়তো খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে ভুলে আমার চশমা পরে বসে আছে।
দুজনের চশমা দেখতে একই রকম, কাজেই এই ভুল হওয়া স্বাভাবিক।
আমি বাবার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। তাঁর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চশমাটা খুলে পরখ করে দেখলাম। নাহ, এটা আমার চশমা নয়। বাবার নিজের চশমা।
পরীক্ষা করে দেখে বাবাকে চশমাটা পরিয়ে দিলাম। বাবা কিছুই ঘটেনি এমন ভাব করে আবার পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দিলেন।
এরপর কে বাকি থাকে? পেয়ে গেছি। আমার ছোট বোনটা। ওর বাঁদরামো দেখলে ডারউইনের থিওরি বিশ্বাস করতে ফেলতে অনেকেরই ইচ্ছে করবে।
আমি কিছুদিনের মধ্যেই ওর লেজ গজানোর অপেক্ষায় আছি। কিংবা কে জানে, হয়তো এতদিনে লেজ গজিয়েই গেছে। সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়ায়, এতটুকুন একটা মেয়ে। নিশ্চয়ই ছুঁড়িটা আমার চশমা গুম করে ফেলেছে। ওর পক্ষে সংসদ ভবন লুকিয়ে ফেলাও অসম্ভব কিছু নয়।
আমি ওকে পাকড়াও করি। সে বারান্দায় বসে মাটির হাঁড়িকুঁড়ি দিয়ে রান্নাবাটি খেলছিল, নিতান্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করে। আমি সোজা গিয়ে ওর কান ধরে ক্লকওয়াইজ একটা মোচড় দিয়ে বলি, আমার চশমা ফেরত দে। ফেরত দে বলছি।
সে কোন জবাবদিহির ধার না ধেরে বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠলো (শব্দের মাত্রা কমপক্ষে একশো আশি ডেসিবেল, কানের শ্রুতিক্ষমতার জন্য চরম মাত্রারও ওপরে), আমার কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো।
মা কোথা থেকে যেন ছুটে এসে আমার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। মাথায় একটা চাঁটি মেরে বললেন, ছোট বোনের সাথে এটা কেমন আচরণ?
আমি ফোঁসফোঁস করে বললাম, বজ্জাতটা আমার চশমা নিয়েছে। ওকে ফেরত দিতে বল।
ওর বয়েই গেছে তোর ঐ ভাঙা চশমাটা নিতে। নিজের ঘরে খুঁজে নে গে, যা।
আমি আমার ছোট বোনটিকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। পেছন থেকে সে খিক খিক করে গা জ্বালানো হাসি হাসল, আমার পিত্তি জ্বলে গেল। মায়ের হাতে এই বয়সেও বিভিন্ন উপলক্ষে আমাকে মার খেতে দেখে সে খুব আমোদ পেয়ে থাকে। নাহ, সে-ও নেয় নি। তাহলে চশমাটা কোথায় গেল? রাতদুপুরে কি ওটার পাখা গজিয়েছে যে আমার ঘর থেকে উড়ে চলে গেছে?
আমি অত্যন্ত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ।
কাজেই যে কোনো ঘটনার একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাই না। কাজেই আমি হাল ছেড়ে না দিয়ে বাথরুমে খুঁজে দেখলাম, রান্নাঘরে খুঁজে দেখলাম। কাজের বুয়া হাজেরার মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, আমাদের গেটের দারোয়ান তসলিম মিয়াকে জিজ্ঞেস করতেও ছাড়লাম না। সম্ভব অসম্ভব কোন জায়গাই খুঁজতে বাকি রাখি নি। বুয়া আমার প্রশ্ন শুনে মুখ ঝামটা দিয়েছে, আর তসলিম মিয়া চশমা নিয়ে ভাঙ্গারির দোকানে বেচে দিয়েছে কীনা জিজ্ঞেস করাতে আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গি করেছে।
আমি সারাদিন চশমা খুঁজে ক্লান্ত, অবসন্ন, পরিশ্রান্ত। অপারেশন চশমা বিফল হয়েছে, বলাই বাহুল্য। আমি হতাশ হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। এভাবে হেরে গেলাম? অজানা তস্কর আমার চশমা নিয়ে চম্পট দিলো? চশমা হাপিশ হয়ে গেল, আট ঘণ্টা ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও কোন কিনারা করতে পারলাম না?
হঠাৎ মাথার মধ্যে দশ হাজার পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলে উঠলো। আমার মনে পড়ে গেছে শার্লক হোমসের বিখ্যাত স্বতঃসিদ্ধ, When you have eliminated the impossible, whatever remains, however impossible, must be the truth. অর্থাৎ, যখন সব অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়, তখন যা বাকি থাকে, সেটা যত আজগুবিই হোক না কেন, সেটাই সত্য।
চশমা হারানো কিংবা চুরি যাওয়ার সব অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে বাকি থাকলো কী? চশমাটা আমার চোখেই আছে।
নাকে হাত দিতেই চশমাটা হাতে ঠেকল। আমি তবুও আয়নার সামনে একবার দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। হ্যাঁ, এই তো চশমা।
রাতে চশমা পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই আর সকালে নির্ধারিত জায়গায় পাই নি। ইউরেকা, চশমা পেয়ে গেছি। অপারেশন চশমা সফল হয়েছে। আমি আয়নার সামনে ভীষণ গম্ভীর মুখে শার্লক হোমসের ভাব করে দাঁড়িয়ে থাকি। একটি অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক উপায়ে হারানো চশমা খুঁজে পেয়েছি।
একটু দেরী হয়েছে, তবুও পেয়েছি তো। আমার কাজকর্ম এমনই নিখুঁত। যুক্তি ছাড়া চশমা উড়ে চলে যেতে পারে না, এটা আমি প্রমাণ করেছি।
নেই কো খালে, নেই কো বিলে, নেই কো মাঠে গাছে,
কান যেখানে ছিল আগে, সেখানটাতেই আছে।
কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা আমার ক্ষেত্রে হবে, "চশমা যেথায় ছিল আগে, সেখানটাতেই আছে।
"
বলা বাহুল্য, চশমা সংক্রান্ত এই ঘটনাটি আমি কাউকে বলিনি। কারণ, মানুষের হাসির পাত্র হতে শার্লক হোমসের মতো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোন মানুষ কখনোই চাইবে না। মূর্খ মানবজাতি ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করবে না, প্রথমেই একচোট হেসে নেবে।
তাছাড়া প্রথমেই যে প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে হবে সেটা আমার জানা আছে। সবাই জিজ্ঞেস করবে, চশমাটা যে আমি চোখে দিয়ে আছি, সেটা কেন সবার শেষে দেখলাম।
সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, খানাতল্লাশি চালিয়ে সবার শেষে দেখলাম যে চশমাটা আসলে হারায় নি, এর কারণটা কী? প্রথমেই কেন নিজের নাকের ডগায় তাকালাম না? তাছাড়া আর কেউ কেন লক্ষ করলো না, যে জিনিসটা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেটা আমার নাকের ডগাতেই লেপটে আছে? আর চশমা পরেও আমি অন্ধের মতো দেয়াল ধরে ধরে কেন হাঁটছিলাম, সেটাও তো একটা ঘোলাটে ব্যাপার।
সে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না বলেই তো "অপারেশন চশমা"-র কাহিনী এখনো গোপন রেখেছি।
(৯ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।