ক
'আজিম দেখতো কেঅই মনে অয় আইতাছে। '
কমান্ডার আশাবুদ্দিনের কথা শোনামাত্র আজিম তরাক করে বিছানা থেকে উঠে পড়লো। অক্টোবরের আর দু'একটা দিন বাকি আছে। তবে এর মধ্যেই ঘন কুয়াশা পড়ছে দু'দিন ধরে। তবে শীতটা বেশি না।
কুয়াশা ভেদ করে বেশি দূর দেখা যায় না। পূর্বদিকে ক্ষেতের আইল ধরে কেউ একজন আসছে। কাঁধের রাইফেলটা নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেলো আজিম। লোকটা কি একা না পিছনে অন্য কেউ আছে? পাকিস্থানী আর্মি? না রাজাকার? আর্মি বা রাজাকার হলে পিছনে বড় গ্রুপ থাকতে পারে। বেশ দূরে থাকতেই আটকে দিতে হবে।
আজিম পা চালিয়ে হাঁটলো।
বেশ দূরে থাকতেই উঁচু স্বরে লোকটাকে আজিম বললো,'অই কে অইহানে? খাড়া। এক পা-ও আগ্গাইবি না। ' আজিম অস্ত্র উঁচিয়ে রেখেছে। চাঁদরে মুখ,শরির ঢাকা লোকটা দাড়িয়ে গেলো।
'দুই আত উপরে তুল। '
লোকটা দুই হাত উপরে তুলতে তুলতে বললো,'আজিম ভাই,আমি করিম। '
ততক্ষনে আজিমের পেছনে তোতা এসে দাঁড়িয়েছে। 'তোতা গিয়া করিমের তল্লাশি ল। '
তোতা করিমের দেহে তল্লাশী চালালো।
তারপর তাকে আসতে দিলো।
'কিরে চাঁদ্দর দিয়া এমুন প্যাকেট অইয়া গেছিলি কে?' তোতা জিজ্ঞেস করলো।
'আরে যেই কুয়াশা। নাগদা,মুগদা কুয়াশা ডুকে। '
করিমকে ওরা ওদের ক্যাম্পে নিয়ে আসলো।
গ্রামের এক প্রানত্দে ওদের ক্যাম্প। গ্রামটি খুবই ছোট। আট-দশটা মাত্র বাড়ি। তিন ঘর জেলে। বাকিরা কৃষক।
গ্রাম ছোট হওয়ায় ওদের সুবিধা হয়েছে। বাইরের কেউ এলো কিনা সহজেই ধরা পড়ে।
'কি খবর করিম?' কমান্ডার আশাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করলো। করিম আসা মানেই খবর আসা।
'ওসত্দাদ গজারিয়া একরামপুর গাটে হেরা একটা গাটি করছে।
হেই গাটিতথে নৌকাত লুটপাট করে। নাইলে টেকা লয়। অনেক খারাপ করতাছে। আমার দুইদিন ডিউটি আছিলো। দেইখ্খা আইছি।
'
করিম রাজাকার বাহিনীতে চাকরি করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায়ই খবরাখবর দিয়ে যায়। করিমের খবর কখনও মিথ্যা হয়নি।
'নদীতথে অপারেশন চালাইলে সুবিধা। হেরা নদীত আ কইরা থাহে টেকার লেইগা।
মাইয়া মানুষ ধরে। মাইর খাওনের চিনত্দা করে না। '
'ঠিক আছে,দেহি। '
খ
নৌকায় চারজন মানুষ। মাঝি।
গৃহকর্তা মনিরুল। তার স্ত্রী আফিয়া, মেয়ে আম্বিয়া। আম্বিয়া খুবই চিনত্দিত। ডিসেম্বরে তাদের বার্ষিক পরীক্ষা হয়। এবার সে ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠবে।
ক্লাসে সে ভালো ছাত্রী। কিন্তু দেশে যে রকম যুদ্ধ লাগলো এবার বোধ হয় পরীক্ষাটাই দেয়া হবে না।
হঠাৎ আম্বিয়ার মা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে তীব্র আতঙ্কিত। বোরখায় চেহারা ঢাকা থাকায় তার আতঙ্কিত মুখ দেখা যাচ্ছে না।
নৌকা ঘিরে ধরেছে আরো তিনটি নৌকা। প্রত্যেকটা নৌকায় তিনজন করে সশস্ত্র যুবক। দাড়িওয়ালা এক যুবক আদেশ দিলো,'ওই বেটা গাটে নৌকা ভিড়া। '
'আমরা তো একরামপুর নামতাম না। আমরা শম্ভুপুরা যামু।
'
'শম্ভুপুরা যাইস। আগে গাটে বিড়া। স্যারেরা কতা কইবো। '
আম্বিয়ার পড়নে বোরখা নেই। যুবকেরা লালায়িত চোখে তাকে দেখছে।
সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। নদীর এক পাশ দিয়ে সূর্য ডুবছে। অন্য সময় এ সময়টা কেমন যেন উদাস করে দেয় আম্বিয়াকে। আজ এ সময়টা তীব্র আতঙ্ক নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে এ আধো আলো-অন্ধকারেরও যেন লোলুপ চোখ আছে।
এ সন্ধ্যাও যেন ওর দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে আছে।
নৌকা ভীড়লো। দু'যুবক কোন কথা না বলে আম্বিয়াকে জোর করে টেনে নৌকা থেকে নামালো। দু'জনেরই মাথায় টুপি। আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো আম্বিয়ার চিৎকারে।
'মা আমারে বাঁচাও। মা বাঁচাও। '
আম্বিয়ার বাবা মনিরুল ঝাপিয়ে পড়েছেন রাজাকারদের উপর। দু'রাজাকারের সাথে তার ধ্বসত্দাধ্বসত্দি চলছে। একজনের কাছ থেকে তিনি একটি রাইফেল ছিনিয়ে নিয়েছেন।
কিন্তু ট্রিগারে টিপ দেয়ার আগেই পিঠে ছুড়ি বসিয়ে দিলো একজন। এরপর নদী পাড়ে শুইয়ে ছুড়ি চালানো হলো তার গলায়। আম্বিয়ার মাকে গুলি করে ফেলা হলো নদীতে। মাঝি আগেই নদীতে ঝাপ দিয়ে পালাতে পেরেছে।
নদীর পাড়েই পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প।
আম্বিয়াকে রাজাকাররা সেখানে পৌছে দিলো।
গ
'আশাবুদ্দিন বাই আমি পিছের একটা নৌকায় আছিলাম। আমার সামনেই মাইয়াটারে দইরা লইয়া গেছে। বাই যদি অস্ত্রটা লগে থাকতো , পারি আর না পারি একটা গুলি করতাম। ' জাব্বার বললো।
সে গতকাল ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর একরামপুর ঘাটে র্যাকি করতে গিয়েছিলো।
চোখ মুখ শক্ত করে কিছুক্ষন বসে রইলেন কমান্ডার আশাবুদ্দিন। তারপর বললেন,'সবতে র্যাডি অ । আজকাঅই যামু। '
পাটের নৌকাটা মাঝারি।
মাঝি-মাল্লা চারজন। চারজনই কাজের। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের উৎসাহ আছে। কিন্তু অতি উৎসাহ নেই। এদের নিয়ে অপারেশন চালাতে পারলে ভালো হতো।
কিন্তু এরা সামনে গিয়ে একটা খালে ঢুকে যাবে। আর তাছাড়া ওদের একটা ছইঅলা বড় নৌকা দরকার। যাতে ওদের সংখ্যাটা দূর থেকে বোঝা না যায়।
একটু পরেই একটা বিশাল নৌকা পাওয়া গেলো। মুদি-মনোহরি নিয়ে সিলেটের দিকে যাচ্ছে।
পাটের নৌকার মাঝিরা বড় নৌকার মাঝিদের ঘটনা বুঝিয়ে ওদের নৌকায় তুলে দিলো। মুক্তিযোদ্ধারা নি:শব্দে নৌকা বদল করলেন।
বড় নৌকাটির গতি ধীর। তবে একরামপুর ঘাটে যেতে বেশিক্ষন লাগবে না। তারা কাছাকাছি এসে পড়েছেন।
কমান্ডারের নির্দেশে সবাই নৌকার আনাচে কানাচে নৌকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিলো। কমান্ডার অবস্থান নিলেন পানি সেচার যায়গায়-ফোকামে।
রান্না চলছিলো নৌকায়। মরিচ বাঁটছিলো এক মাঝি। আশাবুদ্দিন দেখলেন পাটায় মরিচ নেই।
মাঝি বেটেই চলেছে। তার চোখ পাটায় নেই। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আশাবুদ্দিনের দিকে। আশাবুদ্দিনের ইশারা পেয়ে ওয়াদুদ গিয়ে একটা চড় মারলো মাঝিকে। ও সম্বিত ফিরে পেলো।
ওকে নৌকার মাঝখানে এনে বসিয়ে রাখা হলো।
নভেম্বরের চার তারিখ। শীতের দুপুরের রোদ নাকি নরম থাকে। নৌকা রোদে ঝলমল করছে। কিন্তু রোদ মোটেও নরম মনে হচ্ছে না।
শরির জ্বলে যাচ্ছে। নৌকার রোদ কারো ভালো লাগছে না। অসহ্য রোদ লাগছে। ওহ্ আর কতক্ষন।
ঘাটে একটা মুদি মালের নৌকা ভেড়ানো।
পাশে রাজাকারদের একটা নৌকা। নৌকার মাল্লাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে নৌকার ছাঁদে । মাঝি নৌকার সামনে দাড়ানো চার আর্মির পায়ে ধরে কাঁকুতি মিনতি করছে। মাঝিকে নিয়ে হাসহাসি করছে আর্মিরা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম গুলি করলো চাঁন মিয়া।
থ্রি নট থ্রির গুলিতে এক আর্মির বুকে বিশাল ছিদ্র হয়ে গেলো। এরপর মেশিন গানের এক টান দিলেন কমান্ডার । চার আর্মির বুক ঝাঝড়া হয়ে গেলো। নদীর তীর থেকে সাথে সাথে চাইনিজ রাইফেলের পাল্টা জবাব এলো। পাকিস্থানীদের মেশিনগানও চালু হলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।
কিন্তু কমান্ডার আশাবুদ্দিনের রাডারের মতো চোখে ধরা পড়ে গেছে পাকিস্থানীদের মেশিনগানের অবস্থান। আগে থামানো মুদি মালের নৌকাটাও বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। ঐ মেশিনগানের গুলি এসে লাগছে সামনের নৌকায়। কমান্ডার ঝুঁকি নিয়ে অবস্থান বদলে উঠে পড়লেন নৌকার ছইয়ের এক পাশে। শত্রুর মেশিনগান লক্ষ করে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন।
কয়েক সেকেন্ডেই ফল পাওয়া গেলো। মেশিনগানের গুলি বন্ধ। সম্ভবত: লোকটা আহত হয়েছে। তবে এক ঝাঁক চাইনিজ রাইফেলের গুলি ছুটে এলো তার দিকে। গুলির কাভার নিয়ে পাকিস্থানী আর্মিরা কোন রকমে জীপে উঠে পালালো।
রাজাকারগুলি একটিও গুলি না ছুঁড়ে নদীতে ডুব সাঁতার দিয়েছে আগেই।
আসত্দে আসত্দে তীরে উঠে এলো মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি। আর্মিদের ক্যাম্পে তল্লাশী চালালো। এগিয়ে এসেছে আশে পাশের কয়েকজন সাহসী মানুষ।
'ভাই ক্যাম্পে মানুষ আছে নি দেহেন।
'
ক্যাম্পে কাউকে পাওয়া গেলো না। তবে মেয়েদের কাপড় চোপড় পাওয়া গেলো। আজ সাড়াদিন বিভিন্ন নৌকা থেকে লুট করা মালামাল পাওয়া গেলো।
ক্যাম্পের বাইরে কমান্ডার আশাবুদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। বীরদের নেতাকে ঘিরে কয়েক জনের একটা জটলা।
মুদিমালের নৌকার মাঝি তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথা বলছে। তবে কেন কাঁদছে তার কথা থেকে তা বুঝা যাচ্ছে না। ফিরে ফিরে আসছে তার মেয়ের কথা। তার মেয়ের আজ সাতদিন।
সাতদিনেই মেয়ে 'মা' বলতে পারে। পৃথিবীর কোন বাচ্চার মুখে তিনি এ বয়সে 'মা' ডাক শুনেননি। তার মেয়ে খুব সুন্দর। পৃথিবীতে এত সুন্দর বাচ্চা জন্ম হয়নি।
'ভাই রাজাকাররা নৌকা থামাইছে।
মাঝি পত্থমে বুঝতে পারে নাই হেরা রাজাকার। হেগো লগে তক্কাতক্কি করছিলো। হেল্লেগা হেরে মাইরা লাইতে চাইছে। আপনেরা না আইলে মাইরা লাইতো। বাইচ্চা যাওনের খুশিতে হের মাথা ওলট পালট অইয়া গেছে।
'
কমান্ডার তার গ্রুপ নিয়ে নৌকায় উঠলেন। বেশিক্ষন এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না।
সেই মাঝির কান্না ঠিক হচ্ছে না। সে এখন কমান্ডারের সাথে তার নৌকায় উঠছে। তার মাথা ওলট পালট হয়ে গেছে।
এ ওলট পালট সহজে ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। #
শরীফ উদ্দিন সবুজ
০১৯১৩৩৯৮২২০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।