আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কার্লোস বিলার্দো : এক সার্থক রূপকার

কঠিন বাস্তবতা মলিন সরলতার সঙ্গেই বসবাস সবসময়

( লেখাটি দৈনিক সমকালের ১৪ নভেম্বর সংখ্যায় ‘ ফুটবল কা¬সিক বিভাগে ’প্রকাশিত হয়েছে, আমি আমার ব্লগারন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য আবার পোস্ট করলাম ) ‘১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপটা আসলে ছিল আমাদের সবার কাছেই এক সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। বিশেষ করে এর তিন বছর আগে ’৮৩ এর দিকে যখন আমি দায়িত্ব পাই তখন নানা রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের দেশের ফুটবল। এর ওপর আবার আমি মাত্র তিন জন ডিফেন্ডার, পাচ জন মিডফিল্ডার ও দুই জন স্ট্রইকার খেলানোর মত বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলাম। প্রথমে কেউই আমার নতুন পরিল্পনাটা বুঝতে চাইছিল না’ তৎকালীল আর্জেন্টিনার কোচ কার্লোস বিলার্দো যখন এসব স্মৃতিময় কথা বলেন তখন মনের মানসপটে ভেসে উঠে আজ থেকে ২১ বছর আগে অনুষ্ঠিত হওয়া ঘটনাহুল বিশ্ব ফুটবলের মহামিলনের আসরের নানা ঘটনা। সেবার কিন্তু ‘আজেন্টাইন ঈশ্বর’ ম্যারাদোনার কাছে আর্ম ব্যান্ড যাবার কথা ছিল না।

বরং ড্যানিয়েল প্যাসারেলারই দলের কান্ডারি হিসাবে রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। সেসময় তার সঙ্গে কোচের সম্পর্কও ছিলো খুবই ভালো। তবে বিলার্দো দলের অধিনায়ক নির্বাচন করার সময় একেবারে চরম পেশাদারিত্বর পরিচয় দিয়েছেন। বন্ধুত্ব বা অন্য কোনো আবেগকে এতটুকুও প্রশ্রয় দেন নি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একমাত্র ম্যারাদোনার পক্ষেই এত চাপ সহ্য করা সম্ভব হবে।

জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নাম ঘোষনার আগে কোচকে বিস্তর পরমশর্ শুনতে হবে, পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হবে সেটাই স্বাভাবিক। আবার এসব বিষয়ে সরকারের ওপর মিডিয়ার প্রভাবও থাকে প্রচুর। তবে ওসব তুচ্ছ জিনিসে প্রভাবিত দেয়ার মতো দূর্বল চিত্তের লোক ছিলেননা চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রী নেওয়া কার্লোস বিলবার্দো। চাপ বিষয়ে তিনি সব সময় মেনে চলতেন তার এক শিক্ষকের কথা। এক সময়ের সেরা আজেন্টাইন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ একবার রোগী পরীক্ষা করার দীক্ষা দিতে গিয়ে তাকে বলেছিলেন, ‘কার্লোস তুমি সবার কথা শুনবে , সব সমস্যা মাথায় রাখবে কিন্তু কখনো স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবেনা।

মনে রেখো শেষ পর্যন্ত তোমাকেই মূল সিদ্ধান্ত নিতে হবে’ ,অবশ্য শিক্ষকের এই বানী চিরন্তন। যে কোনো পরিস্থিতিতে সবার ক্ষেত্রে সবার জন্য প্রযোজ্য। সব সময়ের জন্য সত্য যেমন সত্য হয়েগিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে আসরের মহাগুরত্বপূর্ন প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার আগে। কোয়িানদের প্রায় গোটা দশেক ম্যাচের ভিডিও দেখিয়ে দলের সদস্যদের সঙ্গে এধরনের একাত্মতা গড়ে তুলেছিলেন। হয়ে গিয়ে ছিলেন সবার আস্থাভাজন।

’৮২ এর পরে পেসোর (আর্জেন্টাইন মুদ্রা) মূল্যমান যখন ক্রমান্বয়ে নিম্নগতির দিকে ধাবমান , দেশের অবস্থা চরম খারাপ, ফকল্যান্ড যুদ্ধের পর দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে ;বহু খেলোয়াড়রা তখন পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিদেশে অবস্থানরত ফুটবলারদের টেনিং দেয়ার পন্থা হিসাবে নিজেই চলে যেতেন কখনো ফ্রান্স, কখনো জার্মানি কখনো বা ইটালি, স্পেন। সেখানে ভালদানো, প্যাট্রিকো হার্নান্দেজ ম্যারাদোনা, গ্যাব্রিয়েল ক্যালদেরোনদের সঙ্গে সময় কাটাতেন ,বাসায় থাকতেন। রাতভর কথা বলতেন বিভিন্ন কলা-কৌশল নিয়ে। ‘ সব কোচের একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে।

আমি এভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম’ বিলার্দোর সরল স্বীকারোক্তি। দ্বিতীয় রাউন্ডের ৪২ মিনিটে পাসকুলির দেয়া একমাত্র গোলে ম্যাচটি নিজেদের করে নিতে পারে আর্জেন্টিনা। আর এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনাল। এর দুই দিন পর ইংলিশরাও প্যারগুয়েকে ৩-০ গোলে হারিয়ে পরের রাউন্ডে তাদের অবস্থান পাকা করে। শেষ আটের ম্যাচের টান টান উত্তেজনা কিছুটা আঁচ অবশ্য বিলর্দো ঠিকই করতে পেরেছিলেন।

তাই প্রতিপক্ষের নাম জানামাত্রই শিষ্যদের নিয়ে মিটিং সেরে ফেলেন। তাদের বলেন যে, তিনি নিজে ম্যাচটি উত্তাপ মারত্মকভাবে টের পাচ্ছেন, অন্যদের মনোভাবও বুঝতে পারছেন । কিন্তু এও মনে করিয়ে দেন যে বাকী জিনিস ছাড়িয়ে এটি একটি নিছকই একটি ফুটবল ম্যাচ। পরে সংবাদ সম্মেলনে অবাক হয়ে দেখেন যে ববি রবসনসহ সবাই একই সুরে কথা বলছে! ‘আমি সাইড লাইনে বসে দেখলাম বারনেস বলটিক্রস করল ও লিনেকার হেড করায় তা গোল কিপারের কাছে পৌছে গেলো, দশ মিনিট পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল’ ম্যাচের শুরুটা এভাবেই মনে আছে তার। অবশ্য এতটুকু বাদ দিলে গোটা ম্যাচটাই যে নিয়ন্ত্রন করেছে আর্জেন্টিনাবাসীর প্রিয় ‘দিয়াগো’ তা এখন কারই বা জানতে বাকী আছে? ‘ঈশ্বরের হাত’ হিসাবে খ্যাতিময় সেই গোল এবং একটু পরেই এল পাচজনকে পাশ কাটিয়ে করা ওই অসাধারন রোমাঞ্চকর গোলটি ।

দলের সমর্থকরা তখন আকাশে উড়ছেন। চির শত্র“ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওমন জয়ের পরই দলের কোচ সহ সবার মনে হতে থাকে , হ্যা সত্যি তো , এবারের কাপটা আমাদের হতে পারে। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৫১ এবং ৬৩ মিনিটে ম্যারাদোনা দুটি গোল করে নিজের উচ্চতা আরও বাড়িয়ে তোলেন। । ফাইনালে যেখানে তাদের প্রতিপক্ষের নাম যান্ত্রিক ফুটবলের অন্যতম ধারক ‘কাইজার’ বেকেন বাওয়ারের পশ্চিম জার্মানি।

এরপর সেই কাক্সিক্ষত দিন। ২৯ জুন, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচটি কোনোভাবেই ইতিহাসের পাতা থেকে থেকে হারিয়ে যাবার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারেনা। প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এিগয়ে থাকা আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় গোলের দেখা পায় ভালদানোর পা থেকে। এরপরই অ্যাজটেকায় উপস্থিত এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার দর্শক অবাক হয়ে অবলোকন করল অন্য এক জার্মানদের। ।

তাদের এই নব কাউন্টার অ্যাটাক কৌশলের উৎপত্তি কিন্তু বিলার্দোর মাধ্যমেই। তিনিই সাইড লইনে বসে থেকে আপন মনে একবার বলে ফেলেছিলেন, ‘এখন জার্মানদের উচিত প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হওয়া’। পাশে বসা বেকেনবাওয়ার তা শুনে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগান। রুমিনিগে এবং ভোলার পরপর দুটো গোলই করেন কর্নারের মাধ্যমে। ম্যাচে তখন ২-২ সমতা।

অন্য দিকে রাগে ফুসছেন আর্জেন্টাইন কোচ। কারন প্রতিকূল পরিস্থতিতে কি করনীয় তা নিয়ে গবেষনা-অনুশীলন তিনি দলকে করিয়েছেন অনেক। যাই হোক, খানিক পরে বুরুচা¹া জয়সূচক গোলটি করায় স্বস্তি নেমে আসে তার মনে। আর ঐ বিশ্বকাপ আসরের চ্যাম্পিয়ন এবং আর্জেন্টিনা হয়ে যায় সমার্থক ও পরিপূরক এক নাম। এত কিছুর পরও একটা আক্ষেপ কিন্তু তার রয়েই গেছে।

ম্যাচ শেষ হওয়ার পরপর সেসময়কার প্রেসিডেন্ট আলফোনসিন শুভেচ্ছা জানাতে টেলিফোন করেন তাকে। আর তাতে লেগে যায় পাক্কা ২০ মিনিট। ততক্ষনে পুরষ্কার বিতরনীর আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেছে। হায় হায় ট্রফি হাতে বা মেডেল পরিহিত একটা ছবিও যে রইল না তার কাছে ! ‘ঠিক আছে কোনো অসুবিধা নেই, এবার হয়নি তাতে কি? পরের বার ঠিক ছবিটা তুলে নিবো’, নিজের মনকে সান্ত্বনা দেন বিলার্দো। তাই ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলার প্রেরনা খুজে নিতে খুব দূরে কোথাও যেতে হয়নি তাকে।

এ কারনেই তিনি এখনও মহান। এক বিশ্ব জয়ী ক্লাসিক টিমের সার্থক রূপকার।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.