কবি
সফেদ ফরাজী
উন্মাদ পিয়ানোর কম্পন
নিজেকে দিয়েছো ছেড়ে দ্রুতগামী উল্কাপিণ্ডের সাথে।
কেন যে অদৃশ্য ডানা নিয়ে তবু উড়ে আসে উন্মাদ গান
ঘুমের দেশ হতে নবজাগ্রত ডালিম ফুলের মতো
সংকেতময়, আততায়ীর নিঃশব্দ চোখ, যেন
আরও হিম করে দেয় ঘুমহীন রাত্রির বাতাস !
রক্তের ভেতর রৌদ্রের বীজাণু অহর্নিশ কেঁদে চলে
স্তব্ধতার মন্দিরের দিকে
আজন্মকাল, হলুদ জ্যোৎস্না ভেবে ঝরাপাতার প্রার্থনা
কুয়াশার রাক্ষুসী দাঁতের নিচে-- আঘাতে আঘাতে
খসে পড়ছে কেবলি ক্ষুধা ও কামনাকাতর ডানা...
২.
গাছ বড় হলে ছোট হয়ে যায় পথ-- মাটির তলায়
লুকোনো মার্বেল পাথরের মতো তার দীর্ঘশ্বাসগুলো
বাতাসে ভেসে ভেসে কোনো এক স্তব্ধ জানালার পাশে
শব্দহীন, ঝরে-- কিছু পাতা-- কিছু গান
ভেসে যায় কেবল আরও দূরে অন্য এক গানের খোঁজে...
৩.
আমাকে অন্ধ করে কোথায় চলে যায় সে।
রৌদ্র, ঝিল্লীর থেকে সারি সারি চিতাগ্নি এসে
চোখ পুড়ে যায় শুধু; উজ্জীবিত ডানায়
যতো নিরর কোলাহল, পিছু ফেলে
ভীত সিংহের চিন্তার ভেতর বসে থাকি।
এখানে অগ্নিচু দানবের মতো সমস্ত পাড়া কাঁপিয়ে
রক্তক্ষয়ী বার্তা আসে কেবলি রক্তক্ষয়;
কোথাও অকস্মাৎ উড়ে যায় সবুজ বসন্ত
আর আমি ছিন্ন পালকের ফাঁদে আটকা পড়ে যাই।
মরজীবনের পাতা ছেড়ে কোনো একদিন
অবিনাশী আয়নার ভেতর দিয়ে উড়াল দেবো আমিও!
৪.
উন্মাদ পিয়ানোর মতো তুমি বেজে ওঠেছিলে
মৃদু কম্পনে, যতো পথ জেগেছিল পথের বিপরীতে
আমি তাদের গোধূলির সাথে চলে যেতে দেখেছি একদা
মৃত লণ্ঠনের নিচে যে পথে ঝরে পড়ে রিক্ত হলাহল
গোপন উল্কি, ডানাভাঙা পোকাদের গান
এখন সেইপথে নিষ্কাশিত হচ্ছে আমার কঙ্কাল...
৫.
যেনো কোথাও বর্শিতে ঝুলে আছে মৎস্যপ্রাণ
শাদা, পালকের আড়ালে কিছু ঢেউ
কিছু উন্মাতাল পথের চোখ নড়বড়ে বিশ্বাসের মতো
দোল খায়, প্রাচীন ঘণ্টাধ্বনির দিকে
নিভৃতে টুপটাপ ঝরে পড়ে কালের দীর্ঘশ্বাস--
মৃদুমন্দ টের পাই, অর্ধেক জীবন নিয়ে
যখন সবুজ সুতো চলে যায় দূরের নগরে
হাড়ের ভেতর সেই বর্শি বিষটান দিয়ে চলে...
হেই বসন্তকাল
শোনা গেলো পাতার মর্মর, পাখির গুঞ্জন--
আর বসন্ত ধরতে নেমে গেলাম পথে,
নর্দমার পাশে ঝোপের আড়ালে
সৌন্দর্যের সাথে দেখা হলো, হ্যান্ডশ্যাক হলো
আর সৌন্দর্যের নখে গেঁথে গেলো এ-মরজগত!
উড়াল
জলে চাঁদের ছায়া পড়লো আর আমি কি-না
ভাবলাম: বুঝি সে-ই এসেছে নেমে-- !
এমতো আরো বিভ্রমে ডুবে ডুবে
আমি হারিয়েছি আমার ব্যক্তিগত ডানার উড়াল--
গাঢ় স্তব্ধতার নিচে, পড়ে আছে যে বসন্তকাল
তাতে দেখা গেলো ভাঙা এক হাতঘড়ির ওপর
অসংখ্য শূন্যতা ক্রূর চোখে তাকিয়ে রয়েছে
বোবা ঘণ্টাধ্বনির দিকে--
যেখানে নিজের হৃদপিণ্ড হাতে একদল লোক
দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর, কারো প্রতীক্ষায়
সেখানে উড়ে পড়ছে এখন বিবর্ণ হাড় ও কঙ্কালের গান--
টিকিটঘর ও খয়েরি বিষাদ
‘সবাই কি পারে যেতে বোবা হরিণের দেশে?’
মুঠোভর্তি কোলাহল নিয়ে অতল জলের তলে
ডুবে যেতে যেতে শঙ্খচূড় প্রশ্ন রেখে গেল--
বিরুদ্ধ স্রোতের টানে স্তব্ধতার চাক ভেঙে
যত যত শোভাযাত্রা ধায়, ভাবি, কী-বা পেল
এবার বসন্তে খুনী হয়ে
ওই দূর দিকচক্রবালে যারা থাকে, ডাকে, তারা কি সফল?
২.
একদিন হয়তো আমিও উন্মাদের পিছু নেব--
হে লাল টিকিট, যদি না দেখাও পথ নিষ্কৃতিপুরের
উৎসবের সম্পাদনা বৃথা হয়; ঘুমের ভেতর
প্রতিরোজ নির্ভয়ে যে ঝাউবন জেগে ওঠে
তার নিচে কোনো এক ছায়াদেবতা কামড়ে ধরে আছে যেন
নভোছক, আলোকচিত্রিত ডানা-- পথের নির্দেশ
ভুল হয়; অনর্থ বাতাসে দেহে বাড়ে এত এত ক্ষয়
গোলমাল, প্ররোচনা, তবু সামাজিক, সঙ্গ ছাড়ে না!
অন্ধকারের ভেতর থেকে
একদিন তুমুল বৃষ্টির রাতে, মনে হলো আমার পাশে শুয়ে আছে লম্বাটে এক অন্ধকার; বিদ্যুতের তারের মতো আমাকে পেঁচিয়ে আছে তার অসংখ্য হাত আর অসংখ্য লাল চোখ বিদ্ধ করছে ক্রমাগত; জলের ভেতর শুকনো মাটির ঢিল ছুঁড়লে যেমন ভুরভুর করে গলতে গলতে জলে মিশে যায়, তেমনি আমিও ধীরে ধীরে মিশে গেলাম যেন তার ভেতর প্রদেশে; যেখানে এক বিশাল অট্টালিকা শূন্যে ঝুলে আছে, তার বারান্দায় পাহারাদারের মতো পায়চারি করছে দেহহীন অসংখ্য পা, সন্তর্পনে, কীভাবে যেন ঢুকে গেলাম সেই গৃহের ভেতর আর তৎক্ষণাৎ দেহহীন অসংখ্য হাত আমাকে বসিয়ে দিল হাড়ের তৈরি একটা চেয়ারের ওপর; চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই গৃহে কোনো দেয়াল নেই, পাটাতন নেই, কেবল উপরে অসংখ্য চোখ দ্বারা নির্মিত একটা সিলিং, সেই সিলিং থেকে আলোক রশ্মিতে ঝুলে আছে অসংখ্য মুখ, প্রতিটি মুখের সামনে একটি করে নীল পুস্তক, প্রতিটি পুস্তকের মলাটে গাঢ় লাল অরে লেখা একটি মাত্র শব্দ ‘জীবন' ! আর সেই শব্দটির ওপর ঘোরাফেরা করছে কিছু বাদামি উঁইপোকা...
শৈলকথা
চব্বিশ মাইল পথ পকেটে নিয়ে ঢুকে যাই কবরখানায়;
দেখি, সম্মোহনী রিমোটে অন্তরঙ্গতার ঢেউ নৈঃশব্দে ছুটে
নিয়তির উল্টোমুখে আরশী দখল করেছে নগ্ন ছবিশহর
আর তাক রাখা সেইসব ভৌতিক খোলস...
স্মরণীয় প্রান্তরে অতীতের নীল পাখি শিস্ দিয়ে যায়
অথচ ধোঁয়ায় ঢাকা তারকাবাগান
ভাঙাচোরা মনঘর হতে থাকে কালের শ্মশান...
কোনো একদিন
কোনো একদিন হাতের তালু থেকে বেরিয়ে আসবে রোদ;
রাতের বিরুদ্ধে দিনের মিছিল, দেশে দেশে মুদ্রাদোষে
হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো বাউণ্ডুলে নৈঃশব্দের বেদনা থেকে উঠে
ক্রমশ: বুকভর্তি প্রগতির হাওয়া নিয়ে প্রাণে প্রাণ দ্যোতনাপ্রবণ;
আর সংশয়ে ডুবে থাকা প্রথার পোশাক ছিঁড়ে তত্ত্বের সত্য প্রমাণবর্তী হলে
জটাজট খুলে যাবে সুফলা মাটির ভাঁজ, অন্ধস্কুলে আলোবৃষ্টি--
দৃষ্টির প্রখরতায় অন্ধকার কেটে গিয়ে বিজয়ী কল্পবিজ্ঞান সাধনে-ভজনে
পরাজিত হতে হতে ‘প্রভু’ মৃত হয়ে যাবে।
সুপ্তিঘোর পুরাণ
সুপ্তিঘোর লেগে থাকে গ্রন্থিতে, সমর্পণে
মহাজাগতিক ইঙ্গিতসূত্রমালা অনুধাবন করা না গেলে
পর্দার আড়ালে কী যেন নড়ে ওঠে মনে হয়
দ্বিধাবিদ্ধ হয়েও তোমাকে নির্মাণ করতে
সাধনা সাধনা খেলায় বেলা বয়ে যায়,
বরঙ প্রবিষ্ট না হয়ে আড়ালচারী অদ্ভুত অদ্ভুত রহস্য ছড়াও তুমি
ধোঁয়াশার গহ্বরে, বিস্মরণের অবুঝ চাকায়...
দৃশ্যমান হতে পারো নাকি দৃশ্যের ক্যানভাসে প্রাণিত এক্সপ্রেস
নাকি লীন তুমি প্রমাণ আখড়ায়, ঐশীবর্গমূলে শূন্যকোঠায়...
নিমজ্জন
এখনো কিছু দৌর্বল্য দূরবর্তী পাহাড়ের সবুজ গাছে, ঝিকিমিকি রোদে
হাজার যুগ যুগ মুহূর্তভাণ্ড বুক-সমুদ্দুরে, খেয়া হয়ে আছি
টানগণিতের সূত্রে ভাবনাসড়কে বিকারহীন দর্শন উঠে এলে
চোখের সম্মুখে দেখি গহীন পরিখা থেকে উঠে আসছে
লাল লাল আগুনের চোখ, প্রভাতসংগীত...
আসন্ন মরুদিন
এসে গেল বুঝি অপরিচয়ের দিন, গুপ্ত প্রতারণা--
কেমনে বাড়ছে দেখো অন্ধকার-ঝাউলতা, ঐ জমাদার
আর আগুনমুখো দেবতারা গান গাইছে প্রেমের
বাতাসের মন কাঁদছে, পরাধীনতার আভার নিচে
ভয়ে ভয়ে ডুবে যাচ্ছে নবউত্থিত চাঁদ,
আর সমস্ত নত্রপুঞ্জ গুটিয়ে নিচ্ছে স্ব স্ব আলোকিত ডানা
যেন মৃত্যুভয় ঘোরাফেরা করছে চরাচরে
হে চন্দ্রবর্মা, সিংহবর্মা, প্রিয়স্বজনেরা কোথায় তোমরা আজ
এই দেশে, এই সবুজে আসন্ন মরুদিনের পায়ের আওয়াজ
বেদনা মন্দিরের দিকে
সমস্ত ধ্বংসের শেষে অবশিষ্ট কিবা থাকে আর?
বড়জোড় একটা দীর্ঘশ্বাস একা একা ঘুরে ফিরে
অবশেষে নিজের ছায়ার কাছে নিজেই হাস্যস্পদ হয়ে ওঠে
করুণাঘেরা দেবমন্দিরের ভেতর এত এত মিথ্যাচার
এত এত ভ্রম ও অহং নিয়ে ঘুরছে জগতযন্ত্র--
বোবাঘড়ি শুধু জানে এইসব ভোজবাজি
অতিক্রমনের পথ আর কতদূর বাকি!
মন তবু জাগে? বাতাসে দোল খায় গাঢ় অবহেলা,
সরল সত্যের সাথে, প্রতিটি স্তব্ধতার নিচে
চাপা পড়ে থাকে একজন উন্মাদের হাসি
রক্তাক্ত অথচ উজ্জ্বল
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।