হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই
(এই লেখাটির একটি ভূমিকা দেওয়া আবশ্যক, পড়া আবশ্যক নয়। ভূমিকাটি দেওয়া আছে আগের পর্বে। যারা পড়তে চান, সেখান থেকেই পড়ে নিলে ভালো। তবে বলে রাখি, ভূমিকাটি না পড়লে মহাভারতের মতো পৃথিবীর কোনো সাহিত্যকর্ম অশুদ্ধ হয়ে যাবে না, আর পড়লে তা আপনার পেটের ভাত হজমে কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে না। )
ডাম্পের বাজার থেকে ট্রলারে প্রায় দেড় ঘণ্টা যাওয়ার পর ঢুকলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে।
তার মানে এই মওসুমে ঢাকা থেকে হিসাব করলে প্রায় ১২ ঘণ্টা একটানা ভ্রমণের পর টাঙ্গুয়ার হাওরে পৌঁছানো যায়। বর্ষাকালে অবশ্য সুনামগঞ্জ থেকে ট্রলারে দুই ঘণ্টায়ই পৌঁছানো সম্ভব। আমরা যখন হাওরে পৌঁছলাম, তখন বিকেলের শেষভাগ, সূর্য ডুববে একটু পরেই। খাল পাড় হয়ে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকায় যাওয়া মাত্রই ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে কানে এলো দেশি ও অতিথি পাখিদের কলকলানি। আর সে কী দৃশ্য! পাখি দেখতে গিয়েছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, সুন্দরবনে।
কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওরে যত পাখি দেখা যায়, তা অভাবনীয়। দু’চোখ যতদূর যায়, শুধু পাখি আর পাখি। হাজারে হাজারে নয়, অযুতে অযুতে। চোখ যেখানে যায় না, সেখানে তো নিশ্চয়ই আরো লাখ পাখি। ডিউটির সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে হাওরে আসতে হয় প্রতিদিনই।
তাঁর চোখেমুখেও মুগ্ধতা। আর পাখি যখন উড়ছে, একসঙ্গে শত শত পাখি উড়াল দিচ্ছে। সে দৃশ্য প্রকাশ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সূর্য ডুবছে, পাখি উড়ছে, নিচে পানির নিচে দেখা যাচ্ছে ছোট-বড় মাছ- দৃশ্যগুলো একটু কল্পনা করলেই বোঝা যাবে কোথায় আছি আমরা!
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জানালেন, সুনামগঞ্জ জেলার সব ম্যাজিস্ট্রেটকেই পালাক্রমে এক সপ্তাহ করে হাওরের কাজে আসতে হয়। এ সপ্তাহের তাঁর পালা।
মাছ রক্ষার জন্য হাওরের বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে হাওর থেকে মাছ বেরুতে পারে না। বর্ষাকালে হাওরের পানি যখন নদীর সঙ্গে মিশে যায়, তখন এই মাছও নদীর মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ও তাঁরা সুরমা নদীতে মাছ ধরতে দেন না। মাছ যেনো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাই এই উদ্যোগ।
তিনি জানালেন, বর্তমানে হাওরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মত মাছ আছে।
আমরা হাওরের আয়তন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, এই হাওরটি প্রকৃতপক্ষে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধরমপাশা থানার ৪২টি ছোট-বড় হাওর মিলে গঠিত। এই ৪২টি হাওরের একটির নাম টাঙ্গুয়ার হাওর যার থেকে পুরো এলাকাটির নাম হয়েছে। বর্তমানে শুকনো মওসুমে হাওরের আয়তন প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একরের মতো। বর্ষাকালে তা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
সূর্য ডোবার পরপরই টেকেরঘাটের উদ্দেশে রওনা দিলাম। মাঝপথে হাওরে থাকা তিনটি আনসার ক্যাম্পে প্রহরারত আনসারদের সঙ্গে কথা বললাম। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর অফিসিয়াল কাজকর্ম সারলেন। রাতে ফেরার সময় হিজল বনের ডানে বসে থাকা দেশি সাদা বকগুলো দেখে মনে হলো গাছে অসংখ্য বাতি জ্বলছে। জীবনানন্দ দাশ হিজল গাছে কেন মত্ত ছিলেন, তা এই প্রথম অনুভব করলাম।
রেস্ট হাউজে ফিরে রাফি ভাইয়ের বানানো বারবিকিউ (আসলে অর্ধেক বারবিকিউ, অর্ধেক রেজালা। রাফি ভাইয়ের মতে, কয়লার আগুন না থাকাতে নাকি এই অবস্থা। তবে খেতে বেশ চমৎকার ছিল। ) খেয়ে বেশ আড্ডা দিলাম। একটু রাত হতেই বেরিয়ে পড়লাম জ্যোৎস্না পোহাতে।
চুনাপাথর খনির নুড়ির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে আসলাম। দূরে কোথাও মাইকে গান বাজছে ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে ডুগডুগি। ’ শিক মাজহার ভাই আক্ষেপ করলেন বৈরাগীর জায়গায় 'ডুগডুগি' চলে এসেছে বলে। মাত্র কয়েকশ গজ দূরে ভারতের পাহাড়ের ওপরে ছুটে চলেছে ট্রাক। তার আলো আসছে বাংলাদেশে।
জ্যোৎস্না রাতে আর কী চাই!
পরদিন সকালে সবাই মিলে আবার ছুটলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে। একই পথ। আমাদের দু’জনের জন্য পুরনো, বাকিদের জন্য নতুন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ট্রলার বা ইঞ্জিন নৌকার ব্যবস্থা করে দিলেন। মাঝপথে শ্রীপুর বাজারে দুপুরের জন্য চাল-ডাল-মাছ কেনা হলো।
তারপর আবার ছুট!
সকালের দিকে পাখি একটু কম থাকে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দুটো ট্রলার নিয়ে আমরা সবাই হাওরের বুকে পড়ে থাকলাম দুপুর পর্যন্ত। আস্তে আস্তে এগুনোর চেষ্টা করছি। কিন্তু পাখিদের খুব কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। একটু গেলেই উড়ে যাচ্ছে।
দুপুরে আনসার ক্যাম্পে খেয়ে আবার বেরুলাম। আবার দেখা মিলল গত দিনের সেই অপরূপ দৃশ্য!
রাতে ফিরে আবার কয়েকজন বেরুলাম জ্যোৎস্নায় হাঁটতে। চুনাপাথর খনির পাশ দিয়ে হাঁটছি। আগে যেখানে খনি ছিল, এখন সেখানে লেক। পাশেই ভারতীয় চুনাপাথরের খনি।
বাংলাদেশের খনি শেষ হয়ে গেছে আগেই, যেটুকু আছে সেটি তোলার চেয়ে আমদানি করায় কম খরচ হয়। তাই ভারতের সেই খনি এখন বাংলাদেশ আমদানি করছে।
পরদিন সকালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে পেছনে ফেলে রওনা দিলাম আমরা। প্রথম দিনের মতোই একই পথে যাত্রা। তবে এবার অনুভূতিটা ভিন্ন।
সময়ের কারণে ডিজিটাল ক্যামেরার মতো জীবনের মেগাবাইটেও জমা হলো দু’দিন সময়ের কিছু নতুন স্মৃতি, ছবি। মাছ-মানুষ-পাখি আর পাখালের ঝাপ্টাঝাপ্টি দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে গেলো আমাদের দু'টি দিন।
*যারা যেতে চান*
টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় এখনো কোন পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠেনি। তাই সেখানে যারা যেতে চান, তাদের সবরকম প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হবে।
১. যারা ঢাকা থেকে যাবেন, তারা সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ কিংবা সরাসরি সুনামগঞ্জ যেতে পারেন বাসে।
সেখানে নদী পার হয়ে মোটর সাইকেলে টেকেরহাট, এবং সেখান থেকে ডাম্পের বাজার হয়ে ট্রলারে আসতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওরে। একটানা ভ্রমণ করলে সময় লাগবে ১২ ঘণ্টার মতো।
২. জানুয়ারি মাসে টাঙ্গুয়ার হাওরে বাইরের নৌকা প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। তাই আগে থেকে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতি নিয়ে আসলে সুবিধে হবে।
৩. এখানে এই সময়ে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তাই এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে আসতে হবে। রাতে থাকার প্রয়োজনীয় লেপ-তোশক-বালিশ ইত্যাদি নিয়ে আসতে হবে।
৪. বর্ষাকালে আসলে সরাসরি সুনামগঞ্জ থেকে ট্রলারে আসা যাবে। সময় লাগবে মাত্র দু’ঘণ্টা। বর্ষাকালে ট্রলারে হাওরে কোনো গ্রামের কাছাকাছি থাকতেও পারবেন।
কিংবা দিনে এসে দিনে ফিরে যেতে পারবেন।
৫. যারা কষ্টসহিষ্ণু নন, তারা কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা নিয়েই এখানে আসবেন।
৬. টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। তাই মাছ ধরা, পাখি মারা, গাছ কাটা ইত্যাদি কোনো কাজ করা যাবে না। হাওরে কোমল পানীয়র ক্যান থেকে শুরু করে এমন কিছু ফেলা যাবে না যাতে হাওরের সার্বিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ছবি পরিচিতি:
১. অপূর্ব টাঙ্গুয়ার হাওর। দেখা যাচ্ছে হিজল গাছ
২. ভারত থেকে চুনাপাথর আসছে বাংলাদেশে
৩. রাফি ভাই বারবিকিউ বানাচ্ছেন
৪. শ্রীপুর বাজারে আমরা জনগন
৫ ও ৬. হাওরে বুকে আমরা ক'জন যুবক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।