আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টাঙ্গুয়ার হাওর: মাছ-মানুষ-পাখি আর পাখালের ঝাপ্টাঝাপ্টি - ১

হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই

(এই লেখাটির একটি ভূমিকা দেয়া আবশ্যক, কিন্তু পড়া আবশ্যক নয়। আমরা কয়েকজন টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়েছিলাম এ বছরের জানুয়ারি মাসে। সেটি ছিলো শীতের সময়। সেখান থেকে আসার পর এই লেখাটি লিখে রেখেছিলাম। কোথাও প্রকাশ করা হয়নি।

কয়েকদিন আগে জানতে পারলাম, আমার কয়েকজন বন্ধু টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাবে, আগামী ঈদের বন্ধে। কিন্তু কীভাবে যাবে, গিয়েই বা কী দেখবে- তাই নিয়ে মহা দ্বিধা। বিশ্বব্যাংকের স্টাইল অনুযায়ী ধাবাতে একবেলা উদরপূর্তির অঙ্গীকার আদায় করে 'বিনামূল্যে' সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম আমি। তখনই মনে হলো, হয়তো আরো কেউ যাবেন টাঙ্গুয়ার হাওরে, এই শীতে। আমিও যেহেতু শীতের সময় গিয়েছিলাম, তাই হয়তো পরিবেশ-পরিস্থিতি খুব একটা অদল-বদল হবে না।

লেখাটি কারো কাজে আসলেও আসতে পারে। ভূমিকা শেষ। নিচে লেখা শুরু হবে। ইতোমধ্যে কেউ বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে থাকলে আপনার ব্রাউজারের ব্যাক বাটনে ক্লিক করুন প্লিজ। ) মিটিংরুমে সবাই মোটামুটি চিন্তায় পড়ে গেলাম।

এমন এক জায়গায় যাচ্ছি যেখানে দলের ছয়জনের কেউই আগে যাইনি। জায়গাটা পরিচিত ও সা¤প্রতিক সময়ে বিখ্যাত হয়ে উঠলেও সেখানে কীভাবে যেতে হয়, গিয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে কি-না, আমরা যা যা করতে চাই তা করতে পারব কি-না ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যের অভাবই আমাদের এই দুঃশ্চিন্তার কারণ। রাফি ভাই বারবিকিউ করতে চান। শিক পাওয়া যাবে কি-না, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। অবশেষে ঠিক হলো, মাজহার ভাইকে (এ কে এম মাজহারুল হক, শাবিপ্রবির নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক) ফোনে বলে দেওয়া হবে কী কী কিনতে হবে।

তিনি ও তাঁর ছাত্র রাসকিন সিলেট থেকে আমাদের অভিযানে যোগ দেওয়ার সময় এসব জিনিসপত্র নিয়ে উঠবেন। আর যেসব জিনিস সিলেট বা সুনামগঞ্জ থেকে কেনা সমস্যা, সেগুলো কিনে নিয়ে যাব ঢাকা থেকে। ভালো কথা, আমরা যাচ্ছি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে। এই অভিযানের প্রস্তুতির প্রায় সব কাজই করলেন মাজহার ভাই ও রাসকিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুমতি সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাতে একটু আরামে থাকার জন্য বিছানাপত্র নেওয়ার ব্যবস্থা- সবই তাঁরা করলেন।

সিলেটে পৌঁছে তাদের প্রস্তুতি দেখে আমরা সবাই নিশ্চিত হলাম, ভ্রমণটা বেশ ভালোই হবে। ৩১ জানুয়ারি রাতে আমরা ছয়জন রওনা দিলাম। খুব ভোরেই পৌঁছে গেলাম সিলেট। সেখানে বাস কাউন্টার থেকে মাইক্রোবাসে আমাদের তুলে নিলেন মাজহার ভাই ও রাসকিন। শাবিপ্রবির রেস্ট হাউজে কিছুণ বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশে।

দেড় ঘণ্টা ভ্রমণ করে সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছার পরই শেষ হলো আমাদের আরামের যাত্রা। বিশাল ব্যাগ-ব্যাগেজ একএকজনের। তার ওপর তোশক-লেপ-কাথা-বালিশ তো রয়েছেই। ফেরি করে সুরমা নদী পার হয়ে অপরপাড়ে পৌঁছে শুরু হলো মোটর সাইকেলওয়ালের সঙ্গে দরদাম। আমাদের এখন যেতে হবে টেকেরঘাটে।

সেখানে যেতে হলে এই সময়ে মোটর সাইকেল ছাড়া আর কোনো বাহন নেই। সুনামগঞ্জ থেকে বর্ষাকালে জেলার সবজায়গায় নৌকা-ট্রলার-লঞ্চে যাতায়াত করা গেলেও এই শীত মওসুমে মোটর সাইকেলই ভরসা। জানা গেল, প্রায় চারশ মানুষ এই সিজনাল ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। দু’ঘণ্টা যাত্রার জন্য আড়াইশ টাকা করে আটটি মোটর সাইকেল ভাড়া করা হলো। এমনিতে স্থানীয়রা একটি মোটর সাইকেলে দু’জন করে চড়লেও আমাদের সাথে মালপত্র থাকায় প্রত্যেকের একটি করে নিতে হলো।

মোটর সাইকেল ভ্রমণ থেকেই শুরু হয় কষ্টকর অভিযান। একমাত্র ইটের রাস্তা ছাড়া আইলের ওপর, ক্ষেতের মাঝখান, বাড়ির উঠান, বাঁশঝাড়ের নিচ, উঁচুনিচু মাটির রাস্তা, মরুভূমির মতো ধূ ধূ বালু, পাহাড়ী রাস্তা থেকে শুরু করে পাকা রাস্তাসহ এমন কোনো ধরনের রাস্তা নেই যা এই রুটে পাওয়া যাবে না। আর ড্রাইভারদের চালানো দেখে মনে হলো, আগামীকাল তাদের মাইকেল শুমাখারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা আছে। তাই আজ একটু প্র্যাকটিস করছে। একটু বয়স্করা আস্তে আস্তে চালানোর কথা বললেও আমরা ইয়ংরা মোটামুটি ড্রাইভারদের প্রতিযোগিতা উপভোগই করছিলাম।

পথে পড়লো বিশ্বম্ভরপুর বাজার। প্রায় দেড় ঘণ্টা এভাবে চলার পর জাদুকাটা নদীর তীরে পৌঁছলাম আমরা। ইতোমধ্যেই ধুলোবালিতে সারা শরীর পূর্ণ। নদীর পানিতে হাতমুখ ধুয়ে, ফটোসেশন করে এবং সাম্রাজ্যবাদী কোক-স্প্রাইট খেয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা হলাম। নদী পার হতেই শুরু হল পাহাড়ী রাস্তা।

ছোটখাটো একটি পাহাড়ে মোটর সাইকেল নিয়ে উপরে উঠা এবং সেখান থেকে একইভাবে নিচে নামা সত্যিই রোমাঞ্চকর। পাহাড় থেকে নামার পর দেখা মিলল খাসিয়া নারী-পুরুষের। আমরা যে রাস্তা দিয়ে চলেছি, তার ডান পাশে মাত্র কিছু দূরেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। বিস্ময়ের ব্যাপার, জাদুকাটা নদী পার হওয়ার পর যতোটা পথ গিয়েছি মোটর সাইকেলে করে, তার প্রায় পুরোটাতেই পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত শুরু। অর্থাৎ সীমান্তে সব পাহাড়ই ভারতের।

সহযাত্রী একজন জানালেন- সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ ও শেরপুরের পুরো সীমান্তেই এই অবস্থা। পাহাড় ভারতের, সমতলভূমি থেকে বাংলাদেশের শুরু। দুপুর দু’টোর দিকে পৌঁছলাম টেকেরঘাটে। আমাদের থাকার জায়গা হলো সেখানকার পরিত্যক্ত চুনাপাথর খনির রেস্ট হাউজে। ম্যাজিস্ট্রেট শফিক সাহেব আমাদের রিসিভ করলেন।

খাবারও রেডি। কোনমতে হাতমুখ ধুয়েই খেতে বসলাম আমরা। খাবার টেবিলেই শফিক সাহেব জানালেন, তাঁকে এখনই টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যেতে হবে। সেখানে মাছ ধরা, পাখি শিকার ও গাছ কাটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এসব বিষয় দেখভাল করার জন্য হাওড়ের মাঝখানে চারটি আনসার ক্যাম্পও আছে।

যখনই কোন মাছ ধরা বা পাখি শিকারের খবর আসে, তখনই তারা ছুটে যান সেখানে। তিনি প্রস্তাব দিলেন, এখন হাওড়ে গিয়ে ফেরত আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। তাই সবাই না গিয়ে তাঁর সঙ্গে দু’তিনজন গিয়ে দেখে আসতে পারেন এবং আগামীকাল সারাদিন হাওড়ে থাকার সময় কোথায় দুপুরের খাওয়া হবে, সেটিও ঠিক করে আসা যেতে পারে। এ প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে আমি ও মাহবুব ভাই তাঁর সঙ্গে ছুটলাম। আবার মোটর সাইকেলে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম ডাম্পের বাজারে।

সেখানে কয়লার বিশাল বাজার। অসংখ্য নারী-পুরুষ কয়লা কেনাবেচার কাজ করছেন। এই কয়লা নদীপথে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ডাম্পের বাজার থেকে ট্রলার ছাড়ল যখন তখন বিকাল তিনটা। ছবি ১: এতো পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে! ছবি ২: দুর্গম পথে মোটরসাইকেল যাত্রা ছবি ৩: নদীপথে মোটরসাইকেল যাত্রা ছবি ৪: মরুভূমির পাশে নদী, ওপাশে ইন্ডিয়া ছবি ৫: সন্ধ্যায় অপূর্ব টাঙ্গুয়ার হাওর


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.