আওরঙ্গজেব
১৭৮২ সাল। ২২৫ বছর আগের কথা। পলাশী যুদ্ধের ২৫ বছর। বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের বারাসাত জেলার চাঁদপুর গ্রামে প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে শহীদ সাইয়েদ নেছার আলী তিতুমীরের জন্ম। তাঁর পিতা ছিল সাইয়েদ হাসান আলী আর মাতা আবেদা রোকাইয়া খাতুন।
নিকট প্রাচীনকালে যে সকল ওলী দরবেশ বাংলায় ইসলাম প্রচার করতে আসেন, সাইয়েদ শাহ হাসান রাজী ও সাইয়েদ শাহ জালাল রাজীর নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া প্রখ্যাত দরবেশ সহোদর সাইয়েদ শাহ আব্বাস আলী এবং সাইয়েদ শাহ্ শাহাদাত আলী তাদের মুরিদ ও খলিফা ছিলেন। সেই সাইয়েদ শাহাদাত আলীর পুত্র সাইয়েদ শাহ হাসমত আলীর অধস্তন এই ক্ষণপুরুষ শহীদ সাইয়েদ নিছার আলী তিতুমীর। মূলত: তিতুমীর তার নাম ছিল না। ছোটকাল থেকেই তিনি ছিলেন খুবই রোগাটে প্রকৃতির।
কোন ওষুধে যখন ভাল হয় না, তখন তার দাদী তাকে বিভিন্ন জাতের স্বাস্খ্য উপযোগী গাছের ছাল, লতা, পাতা, শিকড় বেটে তিতা রস বানিয়ে দিলে নিছার আলী অনাসয়ে তা পান করতো, কোন্ তিতাই তাকে ধরতো না। এজন্য দাদী তাকে প্রথমে আদর করে তিতা মীর বলে ডাকতেন। আস্তে আস্তে তা পাড়া-মহল্লায় এবং রূপান্তর হয়ে তিতু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
জ্ঞান অর্জন:
তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের রীতি অনুসারে তিতু চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে লেখাপড়া শুরু করে। আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী করার জন্য সেকালের শ্রেষ্ঠ ওস্তাদ মুন্সী লাল মিয়াকে তিতুর শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।
মাতৃভাষা রপ্ত করার জন্য তাকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের পণ্ডিত রামকমল ভট্টাচার্যকে দিয়ে বাংলা, ধারাপাত, অংক ইত্যাদি বিষয় শিক্ষার ব্যবস্খা করা হয়। বিহার থেকে হাফেজ নিয়ামাতুল্লাহ তিতুর গ্রাম চাঁদপুর আসলে তাকে দিয়ে সেখানে মাদরাসা স্খাপন করা হয়। আঠার বছর বয়সে তাকে কুরআন হিফজসহ লেখাপড়া সমাপ্ত করা হয়। তিনি আরবী ব্যাকরণ, ফারায়েজ, হাদিস, দর্শন, তাসাউফ, তর্কশাস্ত্রসহ আরবী, ফার্সী কাব্য ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। কৈশরকাল থেকেই তিতু শরীর চর্চা করতেন।
তার শরীর চর্চার শিক্ষক ছিলেন শেখ মুহাম্মদ হানিফ। শরীর চর্চার সাথে তিনি ডনকুস্তি, হাডুডু, লাঠিখেলা, ঢাল, সড়কি, তরবারী, তীর-গুলতি, বাঁশের বন্দুক চালাতে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
দ্বীনের খেদমতে মনোনিবেশ:
দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মনোনিবেশকালে তিতু কোন ভাল আলেমের হাতে বাইয়াতের ইচ্ছা পোষণ করে বিহার থেকে কলকাতায় তালিবটোলায় আগত 'হযরত জাকী শাহ' নামে জনৈক দরবেশের নিকট মুরিদ হওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করলেন। জাকি শাহ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'বায়তুল্লাহ জিয়ারত না করলে তুমি কোন ভাল ওলীর সান পাবে না। ' অবশেষে তিতু মক্কায় গমন করলে সেখানেই সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভীর সাথে তার দিদার হয় এবং তাঁর হাতেই তিনি বাইয়াত গ্রহণ করেন।
মক্কা থেকে ফিরে ব্রেলভী বাংলার অন্যান্য ভক্তগণের সাথে সাইয়েদ নিছার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ, মাওলানা আব্দুল বারী খাঁ (মাওলানা আকরম খাঁর পিতা), মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন, মাওলানা সুফী খোদাদাত সিদ্দিকী, মাওলানা কারামত আলী প্রমুখের সাথে কলকাতায় শামছুন্নেছা খানমের বাগানবাড়িতে এক বৈঠকে একত্রিত হন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পাটনাকে মুজাহিদদের কেন্দ্রীয় রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং প্রত্যেক প্রদেশে প্রাদেশিক রাজধানী রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কলকাতা থেকে ফিরে এসে তিতুমীর নিজ গ্রাম চাঁদপুরে ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। পরে সরফরাজপুর (সর্পরাজপুর)বাসীর অনুরোধে তিতুমীর তথাকার শাহী আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুন:সংস্কার করেন। এখানে জুমার নামায পর তিনি নিয়মিত মুসল্লিদের উদ্দেশে ভাষণ দিতেন।
সরফরাজপুরের মসজিদ পুন:সংস্কার, নিয়মিত নামাযের ব্যবস্খা এবং নামায অন্তে তিতুমীরের ভাষণে পুঁড়ার জমিদার কৃষäদেব রায়কে সন্ত্রস্ত ও তটস্খ করে তুলে।
তিতুমীরের আহ্বান:
তিতুমীরের দাওয়াতের মূল কথা ছিল আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্খাপন, প্রত্যেক কাজে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা-এর নির্দেশ পালন, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মা'রেফতের সমনðয়ে জীবন পরিচালনা।
ষড়যন্ত্র ও দাড়িগোঁফের খাজনা:
পুঁড়ার জমিদার কৃষäদেব রায় তিতুমীরের গতি বিধির গোপন তথ্য পাওয়ার জন্য জমিদারের দালাল মতিউল্লাহকে গোয়েন্দা কাজে নিয়োগ করে এবং তিতু একজন ওহাবী ধর্মাবলম্বী বলে প্রচার করতে থাকে। অত:পর জমিদার কৃষäদেব রায়, গোবলা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় ও গোবরডাঙ্গার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপধ্যায়ের পরামর্শক্রমে এলাকার শান্তি-শৃকôখলা ভঙ্গের অযুহাতে মতিউল্লার চাচা গোলাপ, জ্ঞাতি ভাই নেপাল ও গোবর্ধনকে নিয়ে এক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিতুমীরের বিরুদ্ধে জোর, জুলুম, জবরদস্তি করে বাপ-দাদার রীতি অনুসারে ধর্ম পালনে বাধাদান, দাড়ি রাখতে বাধ্য করা, গোঁফ ছাঁটা, গো হত্যা, আরব দেশের অনুকরণে নাম রাখতে বাধ্য করা ইত্যাদির বিচার এবং যাতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধতে না পারে সেজন্য প্রভাবশালী জমিদার কৃষäদেব রায়ের নিকট প্রতিকার চেয়ে পরিকল্পিতভাবে আবেদন করায়।
আবেদনকারীদের নালিশ পেয়ে কৃষäদেব রায় হুকুম জারি করলেন (১) যারা তিতুর কথা শুনে ওহাবী হবে, তাদের দাড়ি রাখার জন্য ২.৫০ টাকা এবং যারা গোঁফ ছাটবে তাদের গোঁফ ছাঁটার জন্য ১.২৫ টাকা খাজনা, (২) কাঁচা মসজিদ তৈরি করলে বছরে ৫০০ টাকা এবং পাকা মসজিদ তৈরি করলে ১ হাজার টাকা জমিদার সরকারের নজরানা, (৩) বাপ-দাদার রাখা নাম পরিবর্তন করে ওহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রতি নামের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা, (৪) গো-হত্যা করলে, তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে এবং (৫) তিতুমীরকে যে তার বাড়িতে স্খান দিবে তাকে ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হবে। তিতুমীর কৃষäদেব রায়ের বিচার শুনে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে তিনি কোন অন্যায় করেননি। তিনি শুধু ইসলাম প্রচার করছেন। সুতরাং তার কাজে হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। নামায পড়া, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি তাদের ধর্মীয় নির্দেশ।
এ কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি অন্য ধর্ম পালনে বাধা দেয়ার শামিল।
অত্যাচার শুরু:
কৃষäদেব রায় তিতুমীরের নিকট থেকে পত্র পেয়ে পত্রবাহক কামাল উদ্দিনের পুত্র আমিন উল্লাহর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, কে সেই ওহাবী তিতু? আর, বেটা তুইবা কে? নিকটে থাকা জনৈক মুচিরাম ভাণ্ডারী বলল, 'হুজুর ওর নাম আমন মণ্ডল, বাপের নাম কামন মণ্ডল। আপনার প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো এখন দাড়ি রেখেছে বলে আপনি তাকে চিনছেন না। ' এ কথা শুনে আমিন উল্লাহ নির্ভীকচিত্তে জবাব দিলেন, 'হুজুর আমার নাম আমিন উল্লাহ, বাপের নাম কামাল উদ্দিন, লোকে আমাকে আমান এবং বাপকে কামন বলে ডাকে।
' কৃষäদেব রায় রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'ব্যাটা দাড়ির খাজনা দিছিস? নাম বদলের খাজনা দিছিস? আচ্ছা, মজা দেখাচ্ছি। আমার সাথে তর্ক করিস। এতো বড় স্পর্ধা। ' এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে ভরে শাস্তি দিতে। অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীর আমলে ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন শহীদ আমিন উল্লাহ।
সংবাদ মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে, তারা মর্মাহত হলো। কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করা গেল না।
ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক:
তিতুমীরকে শায়েস্তা করার জন্য কলকাতায় জনৈক লাটু বাবুর বাড়িতে এক সভায় লাটু বাবু, গোবরা গোন্দিপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, গোবরডাঙ্গার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপধ্যায়, নূরনগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদারের সদর নায়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, পুঁড়ার জমিদার কুখ্যাত কৃষäদেব রায়, বশিরহাট থানার দারোগা চরম মুসলিম বিদ্বেষী রামরাম চক্রবর্তী, যদুর আটির দুর্গাচরণ চক্রবর্তী প্রমুখ উপস্খিত হয়ে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, 'তিতুমীরকে দমন করতে না পারলে, তাদের হিন্দু জাতির পতন অনিবার্য। যে করে হোক তাকে শায়েস্তা করতেই হবে। ইংরেজদের বুঝানো হবে যে তিতু তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছে এবং হিন্দুদের বুঝানো হবে তাদের গো-মাংশ দ্বারা হিন্দু দেবীকে তিতু চরম অপমান করেছে ও হিন্দুর মুখে কাঁচা গো-মাংশ গুঁজে দিয়েছে।
' সভা শেষে সকলের অনুরোধে দারোগা রাম রাম চক্রবর্তী ঘোষণা করলো আমি প্রাণ দিয়ে আপনাদের সাহায্য করবো এবং যে করে হোক তিতুকে রাজদ্রোহী প্রমাণ করবো।
বিদ্রোহের অযুহাত ও ইংরেজদের ভূমিকা:
কলকাতায় ষড়যন্ত্রের পর কুখ্যাত জমিদার কৃষäদেব রায় সরফরাজপুরের লোকদের নিকট হতে খাজনা আদায়ে লোক পাঠায়। কিন্তু মুসলমানরা অবৈধ খাজনা দিতে অস্বীকার করলে তিতুমীরকে ধরে আনার জন্য ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল পাঠানো হয়। কিন্তু তারা তিতুকে ধরে আনতে সাহস পায়নি। ফলে কৃষäদেব পরবর্তী প্রয়োজনীয় করণীয় নির্ধারণে যাদের কাছে পরামর্শ ও সাহায্য কামনা করে বিভিন্ন স্খানে লোক পাঠালো।
তারা হলো (১) অনুকুল চন্দ্র মুখোপধ্যায়কে গোবর ডাঙ্গায়, (২) খড়েশ্বর মুখোপধ্যায়কে গোবরা গোবিন্দপুর, (৩) লাল বিহারী চট্টোপধ্যায়কে শেরপুর নীলকুঠির ম্যানেজার মি: বেনজামিন, (৪) বনমালী মুখোপধ্যায়কে হুগলী নীলকুঠিতে এবং (৫) লোকনাথ চক্রবর্তীকে বশিরহাট থানায় পাঠান। উল্লেখ্য, লোকনাথ চক্রবর্তী ছিল বশিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি। সাহায্যের জন্য বিভিন্ন স্খান হতে কৃষäদেবের সাহায্যে শত শত লোক লাঠি, তলোয়ার, ঢাল, সড়কিসহ শুক্রবার জুম্মার নামাযরত অবস্খায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং তাতে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ফলে দু'জন শাহাদৎবরণসহ বহু লোক আহত হয়। অত:পর মুসলমানরা কলিঙ্গের পুলিশ ফাঁড়িতে কৃষäদেব রায় গংদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
কিন্তু পুলিশ ঘটনা স্খলে না গিয়ে থানায় বসে লাশ দাফনের নির্দেশ দেয়। থানায় বসে আরো রিপোর্ট দেয়া হয় যে, জমিদারের লোকজন খাজনা আদায় করতে গেলে তাদের খাজনা না দিয়ে মারপিট করে, দু'জনকে আটক করে। ফলে আটক লোকদের উদ্ধারের জন্য জমিদারের লোকজন তিতুদের আক্রমণ করে মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়। ' শুধু তাই নয়, জমিদাররা ঘটনার ১৮ দিন পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই বলে মিথ্যা মামলা দায়ের করে যে, তিতু নীল চাষদ্রোহী, জমিদারদ্রোহী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীদ্রোহী, ভীষণ দাঙ্গা প্রকৃতির ওহাবী মুসলমান। জমিদার কৃষäদেবের দু'জন বরখন্দাজ ও একজন গোমস্তাকে খাজনা আদায় করতে গেলে তাদের মারপিটসহ গুম করে।
বহু অনুসান করেও আমরা তাদের পাচ্ছি না। তিতু দম্ভভরে ঘোষণা করছে, 'সে এ দেশের বাদশাহ সুতরাং খাজনা আর জমিদারদের দিতে হবে না। ' উভয় মামলার তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত করে কলিঙ্গ পুলিশ ফাঁড়ির জমাদ্দার। তিনি উভয় মামলার দুর্বল অবস্খা উল্লেখ করে অধিক তদন্তের জন্য বশিরহাট থানার অভিজ্ঞ দারোগা রামরাম চক্রবর্তীর উপর ন্যস্ত করার প্রতিবেদন পেশ করেন আদালতে।
ফলে মামলা দু'টি রামরাম চক্রবর্তীর নিকট তদন্তভার ন্যস্ত হয়। এদিকে বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মুসলমানদের দায়ের করা মামলার প্রধান আসামী জমিদার কৃষäদেবকে কোর্টে তলব করে জামিন দেন। পরে রামরাম চক্রবর্তী তদন্তের নামে সরফরাজপুর এসে তিতুমীর ও তাঁর লোকজনকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে প্রধান আসামীর বাড়ি বসে জামাই আদরে কাটিয়ে যে তদন্ত রিপোর্ট দেয় তাহলো (১) জমিদার কৃষäদেব রায়ের গোমস্তা ও পাইকদের তিতুর লোকজন বেআইনীভাবে আটক করে, পরে আটক লোকজন কৌশলে সেখান থেকে পালয়ে যায় সুতরাং গুমের মামলা অচল ও খারিজযোগ্য এবং (২) তিতুমীর ও তাঁর লোকজন জমিদার কৃষäদেব রায় গংদের বিরুদ্ধে খুন-জখম, লুট, অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত যে অভিযোগ এনেছে তা মিথ্যা ও বানোয়াট। বরং তার লোকজন নিজেরাই তাদের মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছে। রিপোর্টের ভিত্তিতে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালত উভয় মামলা খারিজ করে দেয়।
দু:খের বিষয় হলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবৈধ খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি ফলে তাদের খাজনা আদায় বৈধ হয়ে যায়। পরে বিভাগীয় কমিশনার মামলার বিষয় অবহিত হয়ে বললেন, জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট যে রায় দিলো তা একদিকে জমিদারদের অবৈধ ও উৎপীড়নমূলক খাজনা ব করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না অপরদিকে প্রতিপক্ষের উত্তেজনাকর মনোভাব লাঘব করারও কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত যখন ১৮৩১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপীল করার জন্য যখন মুসলমানরা কলকাতায় গেল তখন কমিশনারের অনুপস্খিতির জন্য আপীল করা সম্ভব হলো না। এইভাবে মুসলমান প্রজাদের উপর তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ন, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুরবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী এবং পুুঁড়ার উল্লেখিত জমিদার কৃষäদেব রায়দের দ্বারা অত্যাচার, জেল-জরিমানা, জুলুম-নির্যাতন ও উৎপীড়নের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। একইভাবে বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে জমিদার রাম নারায়ণের বিরুদ্ধে জনৈক মুসলমানের মামলার সাক্ষী হিসাবে এই বলে সাক্ষ্য দেন যে, “উক্ত জমিদার তার দাঁড়ির জন্য তাকে ২৫ টাকা জরিমানা করে এবং দাঁড়ি উপড়েও ফেলে।
কিন্তু তাতে কোন ফল হলো না।
অত্যাচারের ফলে হিযরত:
মুসলমানরা যখন মসজিদ ধ্বংস, বহু লোক হতাহত এবং বাড়িঘর ভস্মীভূত হওয়ার প্রতিকার পেল না। তখন সহযোগীদের পরামর্শে তিতুমীর তাঁর লোকজন নিয়ে সরফরাজপুর থেকে ১৭ অক্টোবর ১৮৩১ সালে নারকেলবাড়ীয়া হিজরত করেন। ২৯ অক্টোবর জমিদার কৃষäদেব রায় সহস্রাধিক লাঠিয়াল ও অস্ত্রধারী গুণ্ডাবাহিনীসহ নারকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করে বহুলোক হতাহত করে। ৩০ অক্টোবর অত্র সংক্রান্ত মামলা দায়ের করতে গেলে কোন ফল হলো না।
প্রতিকার তো দূরের কথা পুলিশ কোন তদন্তেও এলো না। উপরন্তু জমিদার বাহিনীর অত্যাচারে তিতু বাহিনী চরম অসহায় হয়ে পড়লো। ৬ নবেম্বর কৃষäদেব পুনরায় মুসলমানদের উপর আক্রমণ, গাবরডাঙ্গার নীলকর জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ও মোল্লাআটি নীলকুঠি ম্যানেজার মি: ডেভিসকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুললো। ফলে ডেভিস ৪০০ হাবশী সৈন্যসহ নারকেলবাড়ীয়া আক্রমণ করলো। সংঘর্ষকালে মুসলমানরা ডেভিসের বজরা ধ্বংস করে দেয়।
এ বিষয়ে বশিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী এবং হিন্দু জমিদারগণ তিতুমীরের লোকদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকারের কাছে একযোগে মিথ্যা, কাল্পনিক, বিকৃত, উদ্দেশ্যমূলক রিপোর্ট/অভিযোগ দিল।
চতুর্মুখী হামলা:
সঙ্গত কারণে তখন দেশে ছিল ইংরেজ শাসন। তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহী ছিল না। কিন্তু হিন্দু জমিদার, অত্যাচারী স্খানীয় ও ইংরেজ নীলকরদের ষড়যন্ত্রে তিতুকে চিত্রিত করা বিদ্রোহী সন্ত্রাসী হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে তিতুমীরের ব্যক্তিগত কোন সংঘাত ছিল না।
গুজব অনুযায়ী দেশী-বিদেশী নীলকর, পাদ্রী ও স্বার্থানেðষী হিন্দু জমিদারদের পক্ষ থেকে বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: আলেকজান্ডারের কাছে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অনবরত উত্তেজনাকর রিপোর্ট ও চিঠিপত্র সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। বশিরহাটের দারোগা রামরাম চক্রবর্তী তিতুমীর ও তার লোকজন সম্পর্কে যেসব কাল্পনিক, মিথ্যা, বিদ্বেষপ্রসূত, বিকৃত রিপোর্ট সরকারের কাছে প্রদান করে এবং হিন্দু জমিদারগণ ও কালেক্টর এবং জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অনবরত লিখতে থাকে। লেখালেখির ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট তিতুমীরকে দমন করার জন্য গভর্নরের নিকট লেখে। সাথে সাথে গভর্নর আবার এই রিপোর্টের ভিত্তিতে নদিয়ার কালেক্টর ও আলীপুরের জজকে নারকেলবাড়ীয়াতে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিকারের ব্যবস্খা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। গভর্নরের আদেশ পেয়ে নদিয়ার কালেক্টর অনাকাঙ্খিতভাবে কৃষäদেব রায়কে দ্রুততার সাথে দেখা করতে বলেন।
আলীপুরের জজ সাহেব তখন নদিয়ায় অবস্খান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।