আবুলের বাবার বুড়ো বয়সে এমন ভীমরতি ধরবে কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। বুড়ো বয়স বললে হয়তো ভুল বলা হবে। সবেমাত্র চল্লিশের ঘর পার করেছেন উনি ।
তা যাহোক এই বয়সে যদি কেউ হেলমেট, প্যাড, গ্লাভস, গার্ডার পরে ব্যাট হাতে নিয়ে ক্রিকেটার বেশে ঘোরাফেরা করে- তবে তাকে মানুষ ভীমরতি বলবে না তো কি বলবে? আর তার সাথে দেখছি আবুলও কুস্তিগীরদের হেলমেট পড়ে থাকে। আবুলকে সেদিন ডেকে বললাম, কিরে তোদের বাপ-বেটার কি রোগ ধরলো।
তোর বাপ কি এবার জাতীয় দলে যোগদান করবে নাকি? আবুল কোন কথা না বলে আবুলের মতোই মন খারাপ করে বাসায় ঢুকে গেলো।
আবুলের মা মারা যাবার পর থেকেই তাদের পরিবারে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তণ ঘটেছে। আবুলের মা মারা যাবার পর তার বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এই বয়সে আর বিয়ে করে ঝামেলা বাড়াবেন না। কিন্তু আবুল কিছু বুঝে না বুঝে সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করে চেঁচাতো। এরপর আবুলের কথা বিবেচনা করে আত্মীয়-স্বজনরা তার বাবাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু।
এরই মধ্যে পাড়ার এক সাবেক ক্রিকেটারের সাথে আবুলের বাবার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ওই লোকটা যুবক বয়সে প্রথম বিভাগ লিগ-টিগ খেলেছিলো বলে শুনেছি। খুব বকতে পারে লোকটা। নিঃসঙ্গ সময় কাটাতে মাঝে মাঝেই আবুলের বাবা স্টেডিয়ামে যেতেন বিকেল করে। সেখানে জেলা ক্রীড়া সংস্থার লোকজনের সাথেও বেশ সখ্যতা হলো তার।
আরো সখ্যতা হলো কয়েকজন মহিলা ক্রিকেটার, হকি খেলোয়ার ও এ্যাথলেটদের সাথে।
আবুলের যেমন তাগাদা ছিলো বাসায় একটা মা নিয়ে আসার। এখন আবুলের বাবার বিয়ে করার ইচ্ছাটা আরো প্রকট হলো।
একদিন শুনলাম আবুলের বাবা বিয়ে করেছেন। নতুন মা আসার পর আবুলের হাবভাব দেখে তেমন ভালো লাগেনি।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- বিয়ের পর থেকেই দেখছি আবুলের বাবা প্রায় সময় ব্যাট, প্যাড হেলমেট, গার্ডার পরে থাকতেন। মাঠে খুব একটা খেলতে যেতে দেখি নি। হয়তো আবুলের মা বাসায় প্রাথমিক তালিম দিচ্ছেন। আমাদের বাসার পাশেই ওদের বাসা। ছাদে উঠলেই দেখতাম একটা ব্যাট হাতে পায়চারি করছেন এদিক থেকে সেদিক।
হয়তো খেলোয়ার বউয়ের কল্যাণেই তাদের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আবুলের সত মা কি খেলেন তা জানি না। এটুকু জানি উনি ক্রীড়া সংস্থার একজন ভ্যাটান নেত্রী। কোনো দিন আমি ভালো করে দেখিনিও।
ক্রিকেট বোর্ডে হয়তো ওর সত মায়ের কোনো শক্ত লোক আছে।
একটু আধটু ক্রিকেট জানলে আবুলের বাবা জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন এমন ধারণাই করছে পাড়ার লোকজন। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যখানে। আবুলকে বক্সার বানানো হবে কি না বুঝলাম না ।
আর যা হোক আর তা হোক- সোজা কথা হলো ওদের পরিবার নিয়ে পাড়ার লোকজন বেশ রসিয়ে গল্প করার সুযোগ পেয়েছে।
সেদিন রাস্তায় আবুলের বাবার সাথে দেখা হলো।
দেখলাম তার সামনের দুটো দাঁত নেই। হঠাৎ তাকে ফোকলা দেখে আমার হাসি পেলো। কিন্তু হাসিটা এক রকম জোর করে দমিয়ে রাখলাম। বললাম, চাচা আপনার দাঁতের এ অবস্থা কেনো? ক্রিকেট বল লেগে নিশ্চয়?
তিনি থতমত খেয়ে বললেন, হুঁ।
এরপর গটগট করে চলে গেলেন বাজারের দিকে।
আমি তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।
সেদিন সকালে অফিসে যাবার জন্য বের হলাম। আবুলদের গেটের সামনে আসতেই হাউ মাউ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। কোনো কিছু না ভেবেই ওদের বাসায় ঢুকে পড়লাম। আমার দেখাদেখি আরো দশ বারোজন অতি উৎসাহীও ভেতরে প্রবেশ করলো।
সিঁড়ি বেয়ে ওদের দু'তলার বারান্দায় উঠতেই- আমার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেলো। এ কি দেখছি আমি। আমার সাথে আসা উৎসাহীদেরও একই অবস্থা। আবুল হেলমেট পরে আছে আর ওর বাবা ক্রিকেটের যাবতীয় সরঞ্জাম শরীরস্থ করেছেন, ব্যাটটাই হাতে নেই। আর আবুলের মাকে এই প্রথম আমি কাছ থেকে দেখলাম।
একেবারে দৈত্যের মতো হৃষ্টপুষ্ট। তার হাতে একটি হকি স্টিক। ওটা দিয়েই বাপ-বেটাকে সমানে পিটিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আবুলের বাবার সে কি কান্না। আবুল আমাকে দেখা মাত্রই ভাইজান বলে দৌড়ে এসে আমার কোলে ঝাঁপ দিলো।
আবুলের মা এবার হকিস্টিক নিয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আমাদের দিকে আসতে লাগলেন। আমি আবুলকে কোলে নিয়ে ভোঁ দৌড়। পাড়ার লোকজনও ধুরমুর করে বের হয়ে এলো। আবুলকে নিয়ে সোজা হাঁটা দিলাম স্থানীয় ক্লিনিকের দিকে। দূর থেকে কানে ভেসে আসছিলো আবুলের বাপের কান্নার শব্দ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।