সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
প্রথম পর্ব: Click This Link
তবে বিষয়ের পাশাপাশি আঙ্গিকেও টোকন ঠাকুর বহুমাত্রায় নিরীক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন। আগেই বলেছি, ব্ল্যাক আউটই, সম্ভবত, এযাবতকালের বাংলাদেশে সবচাইতে নিরীক্ষাধর্মী পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এই ছবির আঙ্গিকে কিছু প্রতীক-রূপকের ব্যবহার ও স্বপ্নীল পরাবাস্তবতা জটিল এক ন্যারেটিভ নির্মাণ করেছে। টোকন ঠাকুর মুরুব্বি হিসেবে ঋত্বিক ও কুরোশাওয়াকে টাইটেল-কার্ডে মানলেও, তার ছবিতে ঋত্বিকের মেলোড্রামা কিংবা কুরোশাওয়ার সামুরাই-সংস্কৃতিকে ঘিরে নির্মিত বিশেষ সিনেমারীতির তেমন কিছু দেখা গেলনা। বরং চলচ্চিত্রিক ভাষা নির্মাণের েেত্র তিনি যেন বুনুয়েল কিংবা ফেলিনিকে অনুসরণ করছেন।
অশ্ব এই ছবিতে অনন্য এক রূপক হিসেবে হাজির হয়েছে। টোকন ঠাকুর তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছেন 'আস্তাবল'। মাদল-রাফির চিলেকোঠার কলিংবেল হ্রেষাধ্বনি করে। অর্ণবকৃত সাউন্ডট্র্যাকে বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে এই হ্রেষাধ্বনিকে। ছবিশেষের টাইটেলকার্ড শেষেও এনিমেশনে দেখা যায় একটি ঘোড়া পাহাড় থেকে নেমে আসছে উপত্যকা বেয়ে।
হয়তো তারুণ্য, তেজ, গতি ও পৌরুষ ইত্যাদি নানা অর্থ নির্মাণে অশ্ব-রূপকের এই যথেচ্ছ ব্যবহার। পরাবাস্তব-মুহূর্ত নির্মাণ করতে টোকন কুয়াশাঢাকা সকালকে বহুবার ব্যবহার করেছেন। বাউলের শিঙা, পুষ্পাবৃত শাল্মলীর কাছে মাদলের ছুটে আসা ইত্যাদি মুহূর্তগুলোকে স্বপ্নময় করে তুলতে কুয়াশাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে কোনো কোনো পরাবাস্তব মুহূর্ত তৈরি করতে পরিচালকের চিন্তাশক্তির সীমাবদ্ধতা ল করা গেছে। যেমন একটি কল্পনার দৃশ্যে দেখা যায় রাফি ও মিটির স্থিরচিত্রনির্ভর কয়েক মিনিটের একটি দৃশ্য, যেখানে সাউন্ডট্র্যাকে রাফি ও মিটি প্রেমময়, কবিত্বপূর্ণ অথচ হেঁয়ালীতে ভরা সংলাপ শোনা যায়।
এই সিকোয়েন্সটির পরে দেখা যায় রাফি ও মিটি বিয়ের পোশাকে একটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। সিঁড়িভাঙ্গা শেষ হলে তারা একটি গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। রাফি গেটের তালা খোলার জন্য চাবি ঘোরায়, তালা খোলে না। ইতস্তত ও বিব্রত রাফি মিটিকে জানায় সে ভুল চাবি নিয়ে এসেছে। স্বপ্নদৃশ্যের অবসান ঘটে।
কনসেপ্ট হিসেবে চমৎকার, অর্থাৎ মিটিকে তার জীবনসঙ্গী করা হচ্ছে না। কিন্তু এই চমৎকার স্বপ্নটির কী অপূর্ব চিত্রায়ণই না হতে পারতো: ধরা যাক একটি সাদা সিঁড়ি, আশেপাশে কোনো দেয়াল নেই, কেবলই শূন্যতা, সিঁড়ির শেষে একটি পরাবাস্তব ধাঁচের গেট, তাতে ওই ধাঁচেরই একটি তালা ...। এধরনের দৃশ্য কীভাবে নির্মিত হতে পারে, তা উপলব্ধি করতে আমরা ফেদেরিকো ফেলিনির এইট এন্ড হাফ ছবিটির কথা স্মরণ করতে পারি। ব্ল্যাক আউট ছবিতে বেশ কিছু লং শট রয়েছে, তবে বিগ কোজ-আপের ব্যবহার সচেতন দর্শকমাত্রই চোখে পড়বে। এই বিগ কোজ-আপের অতিরিক্ত ব্যবহারের হেতু বোঝা গেলনা।
টোকন কি এভাবে নিজস্ব সিনেমা-ভাষা নির্মাণ করতে চাচ্ছেন? পোড়োবাড়িতে বালক মাদল ও যুবক মাদলের, সময় ভেঙ্গে, একইসঙ্গে ঘোরাঘুরির দৃশ্যটি নির্মাণে দতা দেখিয়েছেন পরিচালক, তবে এই দৃশ্যটি মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর প্রত্যাবর্তন টেলিফিল্মটির কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের। ঠিক একই রকম দৃশ্য প্রত্যাবর্তন-এ রয়েছে।
এই ছবির অভিনয়রীতি খুবই অনানুষ্ঠানিক, একারণে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রশংসাযোগ্য। রাফি ও মাদল চরিত্রে তানভীর হাসান ও রাহুল আনন্দ দু’জনেই চমৎকার অভিনয় করেছেন। তবে মিটির চরিত্রে তিনার অভিনয় সাবলীল হয়নি।
বিশেষত তার স্বরপ্রপেণ দুর্বল মনে হয়েছে। রাফি ও ধ্র“ব এষের আলাপচারিতার দৃশ্যটি খাপছাড়া লেগেছে, দৃশ্যটির সংলাপগুলোও পারম্পর্যহীন মনে হয়েছে। অন্যান্য চরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে ধ্রুব এষের অভিনয়ও খুব কাঁচা মনে হয়েছে। রাফি ধ্রুব এষের বাসা থেকে নেমে যাবার পরে দেখা গেল তারা দু’জন কথা বলছেন -- একি সম্পাদকীয় ভরাডুবি, নাকি অপ্রথাগত ন্যারেটিভের খেয়াল, তা ছবি দেখে ঠাহর করা মুশকিল।
এই ছবির সম্পদ হলে এর সংগীত।
শায়ান চৌধুরী অর্ণব তরুণ মিউজিশিয়ান, ফোক গানের ফিউশন করে যিনি আলোচিত, কিন্তু এই ছবিতে তিনি ব্যাপকভাবে পশ্চিমা যন্ত্রের ব্যবহার করেছেন। বিশেষত পিয়ানোর ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। ছবির শব্দগ্রাহকও তিনি, তাই সংগীত আর শব্দকে তিনি একহাতে নিয়ে সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছেন। ছবিতে ব্যবহৃত 'মুহূর্ত কেন এত বড়ো' এবং 'সময়, সবুজ ডাইনী' গান দু'টিও তিনি দতার সঙ্গে গেয়েছেন, প্রথমটি তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে ও কম্পোজিশনে, দ্বিতীয়টি থিম সং আকারে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তার গায়কী এক্ষেত্রে আমাদের অদ্ভূত এক নিঃসঙ্গ চরাচরে নিয়ে হাজির করে। কফিল আহমেদের 'আগুনে খাই আগুনে ঘুমাই', 'বন্ধু থাকো বন্ধু থাকো', 'যিশু আমার চন্দ্র কোপায়' গান তিনটিও এই ছবিতে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে।
তার 'না প্রেমিক না বিপ্লবী' ধাঁচের গানগুলো এই সময়ের বাংলা গানে অন্যতম সংযোজন, টোকন ঠাকুরের ছবিতে গানগুলোর সুপ্রযুক্ত ব্যবহার হয়েছে।
ভিডিওগ্রাফি ও সম্পাদনা এই দু'টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন সামির আহমেদ। একই ব্যক্তির কাজ হওয়ায় এই দু'টির সমন্বয় ভালোমতোই হয়েছে। সম্পাদকের সুপার ইম্পোজিশন ব্যবহার চোখে পড়ার মতো, স্বপ্নদৃশ্যের খাতিরে বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। চিত্রনাট্যের ডকুমেন্টশনের ঝোঁকের পাশাপাশি ক্যামেরাও কখনো কখনো প্রামাণ্যচিত্রের মতো করে পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই এলোমেলোভাবে মুভ করেছে।
এক্ষেত্রে চিলেকোঠায় সবাই মিলে মদ্যপানের দৃশ্যটির কথা মনে করা যেতে পারে। ছবির শেষের দিকে পিকাসো-দালি-ভ্যানগগসহ অন্য অনেকের চিত্রকর্ম কোলাজ করে চোখের নিমিষে দেখিয়ে দেয়া, দ সম্পাদনার উদাহরণ। একের পর এক স্টিল না-দেখিয়ে দ্রুতগতিতে দেখিয়ে দেবার মাধ্যমে কিছু কারণ ও কিছু অকারণ রহস্যসহ পুরোটা বুঝে উঠতে না-পারার অপ্রাপ্তি দর্শকদের মধ্যে কাজ করবে, যা ছবিটির শৌর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্ল্যাক আউট ছবিটির চমক হলো এর এনিমেশন ও চিত্রকর্মের বিপুল ব্যবহার। ছবি আঁকা, শিল্পনির্দেশনা ও এনিমেশনের কাজটি করেছেন আব্দুল হালিম চঞ্চল।
বাংলাদেশের কোনো ছবিতে এই মাত্রায় এনিমেশন ব্যবহার করা হয়নি। শুরুর ও শেষের টাইটেল কার্ড ছাড়াও ছবির ভেতরেও 'জোছনা রাতে নিঃসঙ্গ ঈগল' প্রভৃতি চিত্রকল্প নির্মাণ করতে পরিচালক এনিমেশনের ব্যবহার করেছেন। বিশেষত শেষের টাইটেল কার্ডে দালির 'গলিত সময়' চিত্রকর্মের কনসেপ্ট আশ্রয় করে যে-এনিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে তা মুগ্ধ হবার মতো।
পরিশেষে বলা যায়, ব্ল্যাক আউট হলো বক্তব্যে সাহসী ও আঙ্গিকে নিরীক্ষাধর্মী একটি চলচ্চিত্র। টোকন ঠাকুর তার প্রথম ছবিতেই পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন।
বোঝা যায় চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বে তার ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।