সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার
বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা, সমাজবোধের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের ভেতরেই তার অভিজ্ঞতালব্ধ পরিয়ে যাওয়া সময়কে সম্বল করে কিছু বোধের জন্ম নেয়। আমাদের দৈনন্দিন পদচারণায় প্রতিটি বোধই বর্তমান ও ভবিস্যতকে লক্ষ করে সমান ভাবেই মুল্যবান। আনন্দবোধ আমাদেরকে আনন্দকে অনুভব করতে শেখায়, অন্যের সাথে ভাগ করতে শেখায়। দু:খবোধ আমাদেরকে দু:খকে অনুভব ও জয় করতে শেখায়। পাপবোধ সম্ভ্যাব্য পাপ থেকে নিজেকে দুরে রাখার পাথেয় হিসেবে কাজ করে।
পুন্যবোধ আত্মাকে পবিত্র করে, ও সে পবিত্রতাকে সন্মান করতে শেখায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ধনাত্বক বোধ হিসেবে আনন্দ ও পুন্যবোধ আমাদেরকে যে ভাবে আমাদের পুর্ণশক্তিতে সামনের দিকে এগুতে শেখায়, তেমনি ঋনাত্বক বোধ হিসেবে পাপ আর দু:খ বোধ আমাদেরকে সে চলার পথে নিজেদের কর্মের প্রতি সতর্ক হতে সহায়তা করে। এমনি আরো অনেক অনেক বোধের জন্ম ঘটে ভিন্ন ভিন্ন মানসে, ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে। এ বোধগুলোকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে এগুলোকে অনুভব করা যে মানুষ, মানবতা, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যে কতোটা জরুরী, একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উদাহরণে তাকে জোরালো করতে চাইছি।
সেটা ছিল ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরের কোন এক শীতার্ত দিন।
অন্যান্য অতিথিদের পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে সবাইকে ছাড়িয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন রাষ্ট্রনায়ক। চোখ নীচের দিতে নিবদ্ধ। তারপর নঞ্চের উপর হাঁটু গেড়ে সন্মান জানালেন মৃতদের। শুধুমাত্র মৃতদের প্রতি সন্মান জানানোই নয়, ক্ষমা চাইলেন সমস্ত পৃথিবীর কাছে। পুরো অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মুখে কোন কথা নেই।
এক নীরব বেদনায় যেন বাকহারা সবাই। পোলান্ড ও সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দ্যেশ্য পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে এসেছেন জার্মান চ্যন্সেলর উইলী ব্রান্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার প্রায় চৌদ্দ বছর পর। হিটলার বাহিনীর হাতে ইহুদীদের ও অনার্যীয়দের নির্বিচার গনহত্যা, বর্বরতায় বিশ্বের সামনে ঘৃণিত জার্মান জাতি। ইউরোপের দেশে দেশে বিভিন্ন এলাকায় ছড়ানো কন্সেট্রেশান ক্যম্প এই হনহত্যার দলিল হয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে।
এমনি এক সময়ে উইলী ব্রান্ট তার এই ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে নিজেকে বিশ্ববাসীর সামনে এক বিরল উচ্চতায় তুলে ধরলেন নিজেকে। এ ক্ষমা প্রার্থনা পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বিশ্ববাসীর সামনে জার্মান জাতিকে সন্মান ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে তার এই পদক্ষেপ নোবেল পুরস্কারের চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান।
তার কিছুটা সময় পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে স্বাধীনতার বিরূদ্ধ, অশুভ এ বর্বর শক্তি হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস এদের ভুমিকা কথা তো করোরই অজানা নেই।
এ ভুমিকা যারা অস্বীকার করবে, তারা দেশের ও আমাদের শত্রু। এদেরকে সুংগঠিত করতে যে জামায়াতে ইসলামীর প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ হাত ছিল, সেটাও প্রমানিত সত্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি যে গৌরবের নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলগুলোর আরো বেশী ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সা, তাদের দুর্নীতি ও সুবিধাবাদী কর্মকান্ডকে পাথেয় করে জামায়াত আবার জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। আজ প্রায় আটত্রিশ বছর পরও জামায়াত একটি বারও তাদের কুকর্মের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি।
যে হানাদার প্রভুর প্রভুত্বকে বাংলাদেশের মাটিতে টিকিয়ে রাখার তাদের এই নিশৃংশ পদচারণা, তারাও একটি বারের জন্যেও তারাও কোন অনুতাপ প্রকাশ করে নি।
কিন্তু আমরা প্রমানিত ভাবেই এক নির্লজ্জ, বোধহীন, মেরুদন্ডহীন জাতি! আমরা এই জামায়াতকেই ভোট দিই। এদের গুনগান গাই। আওয়ামী, বিএনপির রাজনৈতিক অসদাচরণের প্রতিবাদ হিসেবে জামাতের হাত ধরে মুক্তি খুঁজি। আওয়ামী, বিএনপি আমাদেরকে রাজনৈতিক মুক্তি দিতে পারে নি, এটা যত বড় সত্য, তারচেয়ে বড় সত্য, “জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি ঘৃণিত, নারীধর্ষনকারী, খুনী, স্বাধীনতা বিরোধীর” জায়গা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হতে পারে না।
আমরা তা মনে রাখি না, আমাদের পাপ ও কষ্টবোধ, যারা এ স্বাধীনতার জন্যে জীবন দান করলেন, তাদের প্রতি কুতজ্ঞতা ও সন্মান আজ অবধি এতটুকু শক্তিশালী হয়নি যে, আমরা এই অশুভ মানবতা বিরোধী শক্তিকে চিরদিনের জন্যে স্তব্ধ করতে পেরেছি। এর কারণ কি? কারণ আমরা আমাদের ইতিহাসকে তথা এই বিরদ্ধ শক্তির কুকর্মের ধরে রাখিনি, তুলে ধরিনি আমাদের চোখের সামনে। যদি করতাম, তাহলে তাদের অনাচারের যে দলিল আমাদের চোখের সামনে থাকতো সারাক্ষন, তাকে অস্বীকার করে জামায়াতকে ভোট দিতে যেতাম না। ভাষা আন্দোলন, উনসত্তুরের গনআন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধের জাতি আমরা, আমরা কি তারপরও এতোটা নির্লজ্জ হতাম?
জার্মান ও ইউরোপীয়ানরা তা করেনি। হিটলারের নাৎসী বাহিনীর অত্যাচারের দলিল হিসেবে “কন্সেট্রেশান ক্যম্প” গুলো জার্মানী সহ ইউরোপের বিভিন্ন এখনো তাদের কুকর্মের কথা মরে করিয়ে দেয়।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন করে তাদের উত্তরসুরীদের ভবিস্যতকে সামনে রেখে তারা এই বোধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। তাদের উত্তরসুরীরা নাৎসীদের কুকর্মের এই দলিল দেখে লজ্জিত, ব্যথিত হয়, মানবিকতার এই অবমাননায় নিজেদের জাতিকে সামনে রেখে প্রতিবাদী হয়, তাদের নিজস্ব পাপ ও দু:খবোধের প্রভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এদেরকে অযোগ্য ঘোষনা করে। এমনকি শিশুদেরকেও সচেতন করার উদ্দ্যশ্যে স্কুল থেকেই এসব ক্যাম্পগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা তাদের শিক্ষারও একটি অংশ।
আমাদেরও এমনি এক শিক্ষার প্রয়োজন ছিল।
শুধুমাত্র শহীদ স্মৃতিসৌধ, আমাদের গৌরব ও বীরত্বগাথার প্রকাশ না করে, আমাদের সত্যিকারের শত্রু কারা, তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। শহরে শহরে ছবি-যাদুঘর, নানা ধরণের প্রতিষ্ঠান, পাঠ্যবই রাখা দরকার ছিল, যা আমাদেরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের দোসর জামাতে ইসলামীর ভুমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতো। আমরা আমাদের ইতিহাসকে তুলে ধরতে পারিনি। আমাদের এই ব্যার্থতা আমাদের স্বাধীনতাপরবর্তি প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সুবিধাবাদী কর্মেরই ফসল। মাঝে মাঝে নিজেদের পাল্লা ভারী করার জন্যে জামায়াতকে তারাও ব্যাবহার করেছেন।
তাদের এ ব্যার্থতা, সুবিধাবাদী কর্মের জন্যে এদেরকে ধিক্কার জানাই।
আমরা আমাদের মুল্যবোধকে আবার সঠিকভাবে ফেরৎ পেতে চাই। সেজন্যে দাবী, সঠিক ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরা হোক। এখনো অনেকের কাছেই যথেষ্ট দলিল ও প্রামানাদি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করে তুলে ধরা হোক সবার সামনে স্বাধীনতা বিরোধীদের কুকর্ম।
এ প্রদর্শনী কে ভিত্তি করে শহরে শহরে স্থায়ী মিউজিয়াম স্থাপন করা হোক, যাতে এ ইতিহাস আমাদের সত্বা ও বোধের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। যতদিন না এ ইতিহাস আমাদের সত্বা ও বোধের অংশ হয়ে না দাঁড়াতে পারে, ততদিন কুচক্রীর কদর্য থাবা ঠেকানোর সাধ্য আমাদের হতে পারে না। জানিনা, দেশের ভবিস্যত শাসনভার কোন রাজনৈতিক দল গ্রহন করতে যাচ্ছে। সে যে দলই হোক না কেন, তাদেরন প্রতি এই দাবী জানানো প্রতিটি সমাজ ও মানবতা সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। এ দাবী পুরণ হলে আমরা এক ইতিহাস-সচেতন জাতি হিসেবে আমাদের শত্রুদের সঠিক ভাবে চিনে নিতে পারবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।